শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৪

প্লাস্টিক দূষণ সমাধানে সার্কুলার ইকোনমি

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জিডিপি বৃদ্ধির সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক উৎপাদন হয়েছিল ৩৯০.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন এবং ২০২০ সালের তুলনায় এই সংখ্যা চার শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে । বিশ্ব ব্যাংকের  প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে প্রায়ই ৩ গুণ। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি পেলেও টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা সর্বনিম্নে আনতে সচেষ্ট হয়েছে। কিন্ত বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য না হলেও, প্লাস্টিক দূষণের শিকার হওয়া দেশগুলোর তালিকার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম । বিশেজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে দ্রুত প্রবৃদ্ধি ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে, যেমন প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি, প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার কারণে দূষণ ও বেড়ে গেছে। তাছাড়া, মহামারি করোনাভাইরাস প্লাস্টিক দূষণকে আরও ত্বরানিত করেছে। ওইসিডি’র গ্লোবাল প্লাস্টিক আউটলোক’ ২০২২ প্রতিবেদনে বলা হয় বৈশ্বিকভাবে উৎপাদিত প্লাস্টিকের মাত্র ০৯ শতাংশ পুনঃচক্রায়ন সম্ভব হয়েছে, ২২ শতাংশ ব্যবস্থাপনা বাইরে বা পরিবেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, ৪৯ শতাংশ ল্যান্ডফিলে পরিত্যজন বা ডাম্পিং করা হয়েছে এবং ১৯ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলা (ইনসিনারেশন) হয়েছে। 

অর্থাৎ ৭৯ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্যই দীর্ঘদিন মাটি ও পানিতে তথা পরিবেশে থেকে গেছে। এই প্লাস্টিক এখন সমগ্র পৃথিবীকে দূষিত করছে । এই অব্যবস্থনাকৃত প্লাস্টিক বর্জ্য মাটি ও পানির সাথে মিশে মাটির গুনাগুন নষ্টের সঙ্গে সঙ্গে পানিতে থাকা জীববৈচিত্রের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলছে ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। গবেষণায় জানা যায় সাধারণ মানুষ খাদ্য এবং জলের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করে, এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরে প্রবেশের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি করছে। শুধু তাই নয়, এইসব প্লাস্টিক বর্জ্য নালা বা ড্রেনের মাধ্যমে নদী বা খালে গিয়ে জমা হয়ে নদীর ও খালের তলদেশে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে ও সামান্য বৃষ্টিতে নগরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।  

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায়ই ৮, ২১,২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর। বর্তমানে এই শহরের জনসংখ্যা ৬০ লক্ষের বেশি। জীবন জীবিকার তাগিদে প্রতিনিয়ত মানুষ চট্টগ্রাম শহরে পাড়ি জম্মাচ্ছে। ভাবনার বিষয় হলো, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে শহরাঞ্চলে মানবসৃষ্ট বর্জ্যের পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে । চট্টগ্রাম নগরীতে প্রতিদিন গড়ে ২৫০০ টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয় (জাইকা প্রতিবেদন- ২০২২)। চট্টগ্রাম শহরের উৎপাদিত বর্জ্যের একটি বড় অংশ প্লাস্টিক ও পলিথিন,  এটি প্রায় মোট উৎপদিত বর্জ্যের ৮.৮%। চুয়েটের এক গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রাম শহরে প্রতিবছর গড়ে ৭৫০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিটি কর্পোরেশনের অন্যতম নিয়মিত কাজ। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ৭৫% বর্জ্য সংগ্রহ করতে পারে, বাকী ২৫% বর্জ্য অসংগৃহীত থেকে যায় (বর্জ্য প্রতিবেদন, ২০১৯-২০২০)। পরিবেশে পড়ে থাকা এইসব প্লাস্টিক বর্জ্যর বড় একটি অংশ হলো পলিথিন ব্যাগ, পণ্যের মোড়ক, মিনারেল ওয়াটার, জুস ও কোমল পানীয় বোতল ইত্যাদি । এই ধরনের অসংগৃহীত বর্জ্য নগরের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের উপর বিশাল প্রভাব ফেলে। অপরপদিকে প্লাস্টিক সহজলভ্য, অপচঁনশীল, পুনঃচক্রায়ন ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য। অব্যবস্থপনা ও টেকসই ব্যবস্থাপনার অভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য ল্যান্ডেফিলে পরিত্যজন হচ্ছে বা পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে। যার ফলে বর্জ্য থেকে সম্পদ তৈরীর সুযোগ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। আমার এই প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে সার্কুলার ইকোনমি বা বৃত্তাকার অর্থনীতির মাধ্যমে কিভাবে আমরা  প্লাস্টিক দূষণ কমিয়ে আনতে পারি ও টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারি।

উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সার্কুলার ইকোনমি বা বৃত্তাকার অর্থনীতির বিকাশ অত্যন্ত জরুরি। সার্কুলার ইকোনোমি এমন একটি অর্থনৈতিক মডেল যেখানে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। এতে তুলনামূলক কম প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্পদের অপচয় কমিয়ে আনা হয় এবং বর্জ্য উৎপাদন হ্রাস করার উপর গুরত্বারোপ করা হয়।

সার্কুলার ইকোনমি মডেলে উৎপাদন ও ভোগের মধ্য সমন্বয় সাধন করে। এটি পণ্যের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে এবং পণ্যের জীবনচক্রকে প্রসারিত করে। এটি রৈখিক অর্থনীতি বা লিনিয়ার ইকোনমি মডেলের বিপরীত অবস্থা (উৎপাদন-ভোগ-বর্জ্য)। ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন, ২০৩১ সাল নাগাদ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হতে হলে সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আর সেজন্য সার্কুলার ইকোনমির বিকাশ অত্যন্ত জরুরী।

প্লাস্টিক বর্জ্যে’র ভ্যালু চেইনের অংশীদারদের ক্ষমতায়ন ও সংযোগের মাধ্যমে পরিত্যক্ত, অব্যবহৃত পলিথিন, প্লাস্টিক সংগ্রহ করে রিসাইক্লারদের নিকট পৌছানো বিষয়ে কাজ করছে চট্টগ্রামের বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ইপসা। এই চর্চার মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বৃত্তাকার অর্থনীতির চর্চা শুরু হয়েছে। এই এপ্রোচের মাধ্যমে প্লাস্টিক সংগ্রহের সাথে সম্পৃত্ত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে ও পরিবেশের উন্নতি হচ্ছে। ইপসা, গত ১.৫ বছরে প্রায় ১০০০০  টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে রিসাইকেলারদের কাছে প্রেরণ করছে পুনঃচক্রায়নের জন্য। ইপসা মনে করছে এই সার্কুলার ইকোনমি মডেল প্রয়োগের মাধ্যমে বাজারে ভার্জিন প্লাস্টিকের অনুপ্রবেশ কমে আসছে এবং বর্জ্যের উপকরণগুলি নিরাপদে প্রকৃতিতে ফিরে যাচ্ছে। এই বৃত্তাকার অর্থনীতির ফলে সরকারের এ্যাকশান প্লান ফর প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট (২০২১-২০৩০) বাস্তবায়ন সম্ভব হবে এবং  ২০৩০ সালের মধ্যে বাজারে ৫০% শতাংশ ভার্জিন প্লাস্টিকের অনুপ্রবেশ কমিয়ে আনা সম্ভবপর হবে।

সার্কুলার ইকোনমি প্রয়োগের সুবিধাসমূহঃ

সার্কুলার ইকোনমি প্রয়োগের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব তথা পৃথিবীর তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব। গ্রীনহাউস গ্যাস  বায়ুমন্ডলে নির্গত হওয়ার মাধ্যমে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন তথা পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলছে। সার্কুলার ইকোনমি প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা সম্ভব। সাধারণত, সার্কুলার ইকোনমি লিনিয়ার ইকোনমি’র তুলনায় কম কার্বন নিঃসরণ করে। সার্কুলার ইকোনমিতে প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার সর্বাধিক নিশ্চিত করে যার ফলে নতুন প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দেয়। সার্কুলারিটি গ্যাপ রিপোর্ট-২০২১ এ দাবি করা হয় সার্কুলার ইকোনমি’র মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ৩৯ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা সম্ভব।

সার্কুলার ইকোনমি’র মাধ্যমে পণ্যের উৎপাদান খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব। প্লাস্টিক বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদান খরচ ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। বৃত্তাকার অর্থনীতির মাধ্যমে পুনর্ব্যবহার ও পুনঃচক্রায়ন করে কাঁচামালের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা সম্ভব।

প্লাস্টিক বর্জের সার্কুলার ইকোনমি’র মাধ্যমে আমরা এনার্জি (শক্তি) উৎপাদন ও যোগান দেওয়া সম্ভব। পাইরোলাইসিস প্রক্রিয়ায় প্লাস্টিক বর্জ্যকে শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর অন্যতম দেশ যারা প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে বিদুৎ উৎপাদন করছে ও বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনে এই শক্তিকে ব্যবহার করছে। পরিত্যক্ত প্লাস্টিক ব্যাগ থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদন করা সম্ভব। এই তেল পরিশোধনের মাধ্যমে সব ধরনের যানবাহন ও সেচপাম্পে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।

বৃত্তাকার অর্থনীতি 3R (হ্রাস, পুনর্ব্যবহার ও পুনঃচক্রায়ন) 7R পর্যন্ত প্রসারিত করে যেমন; নতুন করে ডিজাইন (redesign); কমাতে (reduce); মেরামত (repair); পুনর্নবীকরণ (renewal); পুনরুদ্ধার (recover); পুনঃচক্রায়ন (recycle); এভাবে, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহস্থাপনায় সার্কুলার ইকোনমি প্রবর্তন করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় 3R  থেকে 7R পর্যন্ত প্রসারিত করা সম্ভব।

বৃত্তাকার অর্থনীতি মাধ্যমে স্থানীয় বাজারে বিপুল পরিমাণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। দেশে অনানুষ্ঠানিক খাতে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত হয় এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতা বাড়ছে। চট্টগ্রাম রিসাইাক্লং প্লাস্টিক ব্যবসায়ী সমিতির এর মতে চট্টগ্রামে ৫০০ এর অধিক রিসাইকালার রয়েছে, যেখানে প্রায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অর্ধ-লক্ষাধিক লোক জীবিকা নির্বাহ করছে। রিসাইকেল খাতকে শিল্প হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলে দেশের বৃত্তাকার অর্থনীতির বিকাশ আরো গতিশীল হবে। বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত বাংলাদেশ তৈরিতে সাহায্য করবে সার্কুলার ইকোনমি ।

সর্বোপরি, বাংলাদেশের জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় গৃহীত টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনার আওতায় ২০২৬ সালের মধ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার ৯০ শতাংশ কমানো, ২০৩০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহার ৮০ শতাংশে উন্নীত করা এবং একই সময়ে প্লাস্টিক বর্জ্য সৃষ্টি ৩০ শতাংশে কমিয়ে আনতে সার্কুলার ইকোনমি’র বিকল্প নেই। সার্কুলার ইকোনমি’র সঠিক বাস্তবায়ন ও সমন্বয়ের জন্য চাই টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, উৎসে বর্জ্য হ্রাস ও পৃথকীকরণ, ভোক্তা ও বর্জ্য সৃজনকারীদের (সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা) দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে সংবেদনশীলতা তৈরি, প্লাস্টিক পণ্য প্রস্ততকারক বা আমদানিকারকেদের প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ, স্থানীয় সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের ক্ষমতায়ন ও দায়িত্বপালন, শিল্প ও পরিবেশবান্ধব নীতিমালা, কঠিন বর্জ্য বিধিমালা ২০২১ এর প্রয়োগ, গবেষণা এবং বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন। এভাবে সবার সম্মনিত প্রচেষ্টায় সার্কুলার ইকোনমি’র মাধ্যমে প্লাস্টিক দূষণ কমানো সম্ভব।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন