রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

মোবাইল ওয়্যারলেস জেনারেশন (জি) টেকনোলজির বিবর্তন ও আসন্ন ফাইভ জি’র জন্য আমরা কতটুক প্রস্তুত

মানবসভ্যতার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত তিনটি শিল্পবিপ্লব পাল্টে দিয়েছে সারা  বিশ্বের গতিপথ তাদের মধ্যে ১৯৬৯ সালে আবিস্কৃত ইন্টারনেট অন্যতম, যার মাধ্যমে তৃতীয় শিল্পবিপ্লব ঘটে। এই ইন্টারনেট আবিস্কার পৃথিবীর শিল্প উৎপাদনের মাত্রা কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং পৃথিবীকে বিনা সুতায় গেথে ফেলে দিয়েছে। দূরত্বকে নিয়ে এনেছে হাতের মুঠোয়, পৃথিবীকে পরিণত করেছে গ্লোবাল গ্রামে। ইন্টারনেট আবিস্কারের ফলে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মোবাইল ওয়্যারলেসের নেটওর্য়াক আসে ব্যাপক পরিবর্তন। মোবাইল ওয়্যারলেস জেনারেশন (জি) সাধারণত সিস্টেমের গতি, প্রযুক্তি, ফ্রিকোয়েন্সি, ডাটা সক্ষমতা ও বিলম্বিতা ইত্যাদির পরিবর্তনকে বুঝায়। প্রতিটি প্রজন্মের কিছ ু মান,  ভিন্ন ক্ষমতা, নতুন কৌশল ও বিশেষত্ব রয়েছে যা পূর্বের জেনারেশন থেকে স্বতন্ত্র। মোবাইল ওয়্যারলেসে যোগাযোগের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১জি এর মধ্য দিয়ে পরবর্তীতে ২জি, ৩জি, ৪জি এবং ৫জি আসন্ন। এই লেখার মাধ্যমে মোবাইল ওয়্যারলেস জেনারেশন’স (জি) এর মান, ডাটা রেট, ক্যাপাসিটি, প্রাথমিক সেবা, চ্যালেঞ্জ এবং বৈশিষ্ট তুলনামূলক আলোচনা সহ আসন্ন মোবাইল ওয়্যারলেস জেনারেশন ৫জি’তে কি কি পরিবর্তন ও চমক থাকছে তা সংক্ষেপে বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

ফাস্ট জেনারেশন (১ জি)
১৯৮১ সাল থেকে মোবাইল সেলুলার যুগ শুরু হয়েছিল এবং তারপর থেকে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। ধারনা করা হয় ১৯৭৯ সালে জাপানের এনটিটি দ্বারা প্রথম বাণিজ্যিক স্বয়ংক্রিয় সেলুলার নেটওর্য়াকটি চালু করা হয়েছিল। এটি শুধু মাত্র ভয়েস প্রেরণ এর জন্য ব্যবহ্রত হয়েছিল। এখানে ব্যবহ্যত প্রযুক্তিকে বলা হত এডভান্স মোবাইল ফোন সিস্টেম (এএমপিএস)। এতে ব্যবহ্যত চ্যানেলের ক্ষমতা ছিল ৩০ কিলোহার্টজ, ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ড ছিল ৮২৪-৮৯৪ মেঘাহার্টজ এবং ডাটা স্পীড ছিল ২.৪ কিলোবাইটস পার সেকেন্ডে  (কেবিপিএস)।

সেকেন্ড জেনারেশন (২ জি)
১৯৮০ দশকের শেষের দিকে সেকেন্ড জেনেরেশন ২ জি মোবাইল আবির্র্ভূত হয়েছিল। এটি ভয়েস ট্রান্সমিশনের জন্য ডিজিটাল সংকেত ব্যবহার করেছে। এই প্রযুক্তির মূল ফোকাস ছিল ডিজিটাল সংকেত এর মাধ্যমে কম আয়তনের টেক্সট ও ছবি পাঠানো যেত। এটি ৩০ থেকে ২০০ কিলোহার্টজ এর ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করে। পরবর্তীতে ২জি ২.৫জি’তে রুপান্তরিত হয়ে প্যাকেট সুইচড এবং সার্কিট সুইচড এর মাধ্যমে ডাটা ১৪৪ কিলোবাইটস পার সেকেন্ড রেটে ট্রান্সমিশন করতে পেরেছে। যেমন জিএসএম  গ্লোবাল সিস্টেমস ফর মোবাইল (জিএসএম), জেনারেল প্যাকেট রেডিও সার্ভিস (জিপিআরএস) ও এনহান্সড ডাটা রেইটস ফর জিএসএম ইভ্যুলুশ্যান (ইডিজিই)। এই ২জি’র মাধ্যমে ডাটা’র গতি ৬৪ কেবিপিএস পর্যন্ত হতে পারে ও ট্রান্সমিশন করা যায় টেক্সট, ছবি এবং মাল্টিমিডিয়া মেসেজ।

২.৫ জি
এই জিএসএম প্রযুক্তির মাধ্যমে আরও উন্নত সেবা প্রদান করা সম্ভব হয়েছে যা ২জি এবং ৩জি মাঝামাঝি যেমন; মোবাইলে ই-মেইল প্রেরণ ও গ্রহন, ওয়েব ব্রাউজিং, ডাটা ট্রান্সমিশন ৬৪-১৪৪ কেবিপিএস এবং ক্যামেরা ফোন।

থার্ড জেনারেশন (৩ জি)
থার্ড জেনারেশন (৩ জি) মোবাইল নেটওর্য়াক চালু হয়েছিল ২০০০ সালে জিএসএম ভিত্তিক সেলুলার ফোনে। এই প্রযুক্তির লক্ষ্য ছিল উচ্চ গতির ডাটা সরবরাহ করা। এটিতে ওয়াইড ব্যান্ড ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে পরিধি বাড়ানো হয়েছে। এই প্রযুক্তিতে ডাটার ভলিয়ম বৃদ্ধি করা হয়েছে,  যাতে মোবাইলে টেলিভিশন/ভিডিও দেখা যায় এবং গ্লোবাল রুমিং করা যায়। এটি ২১০০ মেঘাহার্টজ ব্যপ্তিতে কাজ করে এবং ব্যান্ডউইথ (ব্যান্ডউইথ হল কোনো নেটওর্য়াক মাধ্যমের একক সময়ে সর্বাধিক যে পরিমাণ ডাটা এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে প্রেরণ। এটি নির্ণয়ের একক হল বিট পার সেকেন্ড (বিপিএস)/ মেগাবাইটস পার সেকেন্ড/ গিগাবাইটস পার সেকেন্স)। ১৫-২০ মেঘাহার্টজ ব্যবহার করে উচ্চগতির ইন্টারনেট এর মাধ্যমে ভিডিও চ্যাটিং করা যায়। এই প্রযুক্তির মোবাইল ফোনে ডাটা ট্রান্সমিশন গতি ২ এমবিপিএস যার মাধ্যমে সহজে যোগাযোগ, ভারী ইমেইল প্রেরণ ও গ্রহন, ভিডিও কল, মোবাইলে টিভি দেখা ও থ্রিডি গেমিং করা যায়। এজন্য একে স্মার্ট ফোন ও বলা হয়।

চতুর্থ জেনারেশন (৪ জি)
চতুর্থ জেনারেশন মোবাইল সিস্টেম হল সমস্ত আইপি ভিত্তিক নেটওর্য়াক সিস্টেম। ৪জি প্রযুক্তির প্রধান লক্ষ্য হল ভয়েস এবং ডাটা সার্ভিস, মাল্টিমিডিয়া এবং ইন্টারনেট ওভার আইপি জন্য হাই স্পিড, উচ্চ মানের, উচ্চ ক্ষমতা, নিরাপত্তা এবং কম খরচে সেবা প্রদান। এই প্রযুক্তিতে গতি ১০০ এমবিপিএস থেকে ০১ জিবিপিএস পর্যন্ত, উচ্চ মানের ভিডিও স্ট্রিমিং, ওয়াইফাই এবং ওয়াই-ম্যাক্সের সংমিশ্রণ এবং ব্যান্ডউইথ ৫-২০ মেগাহার্টজ পর্যন্ত। 

পঞ্চম জেনারেশন (৫ জি)
মোবাইল ফোনের পঞ্চম জেনারেশন ইন্টারনেটকে সংক্ষেপে ফাইভ জি বলে। অনেক দ্রুত গতিতে ইন্টারনেট তথ্য ডাউন লোড এবং আপলোড করা যাবে ফাইভ জি’র মাধ্যমে এবং এর সেবার আওতা হবে ব্যাপক। ৫জি’র মূল ফোকাস হবে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবে। এর মাধ্যমে মাল্টিমিডিয়া সংবাদপত্রগুলো এবং টিভির প্রোগ্রাম অধিকতর স্পষ্ট দেখা যাবে। বিশ^ব্যাপি ৫জি শুরু হওয়ার কথা ২০২০ সালে, আর বাংলাদেশে ২০২১ সালের মধ্যেই ফাইভ জি নেটওর্য়াক চালু করা হবে বলে জানিয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী। ফাইভ জি নেটওর্য়াক ১ গিগাবাইট পার সেকেন্ড গতিতে ডাটা ট্রান্সপার করবে।

ফাইভ জি নেটওর্য়াক চালু হলে বর্তমানের তুলনায় ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি গতির ইন্টারনেট পাওয়া যাবে। চালক বিহীন গাড়ির ক্ষেত্রে সহায়তা করবে ফাইভ জি প্রযুক্তি। অগমেন্টেড রিয়েলিটি, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, উন্নত মানের ভিডিও আমাদের জীবনকে স্মার্ট করে তুলবে। ড্রোনের মাধ্যমে গবেষণা এবং উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা হবে। মোবাইল গেমাররা আরো বেশি সুবিধা পাবেন। ভিডিও কল আরো পরিস্কার হবে। সহজেই কোনোরকম বাধা ছাড়াই মোবাইলে ভিডিও দেখা যাবে। শরীওে লাগানো ফিটনেস ডিভাইসগুলো নিখুঁত সংকেত দিতে পারবে, জরুরী চিকিৎসা বার্তা পাঠাতে পারবে। ফাইভ জি সুবিধা পেতে নতুন কম্পিউটার চিপ দরকার হবে, অর্থাৎ প্রচলিত ফোনটি হয়তো পাল্টাতে হবে। হয়ত আপনার ফোর জি’র ফোনটিতে ও এটি কাজ করতে পারে। তবে প্রান্তিক এলাকার জনগণ এর সুবিধা পেতে সময় লাগবে, কারণ এটি উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির ব্যান্ডে কাজ করে। এটা একসঙ্গে অনেক মানুষকে সেবা দিতে পারে, কিন্ত এর আওতা ততটা বড় নয়।

মোবইল জেনারেশনের তুলনামূলক বিভাজন (Comparison of Mobile Generation: 1G to 5G)

আমরা মোবাইল জেনারেশনের কতটুকু সেবা টা পাচ্ছি?
বাংলাদেশে গত ১৯ শে ফেব্রুয়ারী ২০১৮ আনুষ্ঠানিকভাবে চতুর্থ প্রজন্মের টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি বা ফোরজি সেবা চালু করে। কিন্তু গ্রাহক পর্যায়ে অভিযোগ রয়েছে অনেক স্থানেই এই ফোরজি সেবা এখনও পাওয় যায় না। এমনকি খুদঁ রাজধানীর অনেক জায়গায় এখনও ফোরজি নেটওর্য়াক পাওয়া যায় না, আর প্রান্তিক পর্যায়ে তা কল্পনাতীত। যেখানে বিশ্বে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেটের গড় গতি ১৬ এমবিপিএসের উপরে আর বাংলাদেশে তা গড় গতি ৪ এমবিপিএসের নিচে। আর যদি ২০২১ সালের মধ্যে ৫জি মোবাইল নেটওর্য়াক চালু করতে যাই সে ক্ষেত্রে আমাদের সবার আগে বাংলাদেশের সব জায়গায় ফোরজি সেবা নিশ্চিত করতে হবে। অপরদিকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন মতে ২০২০ সালের মধ্যে সারাদেশে ফোরজি বিস্তৃতি সময়সীমা বেধে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে ফোরজি ইন্টারনেটের গতি  কত হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন ধারনা দিচ্ছে না মোবাইল অপারেটররা। সেই বিষয়ে আমাদের ভাবা উচিত। 


ইন্টারনেট স্পিড পরিমাপ করার কিছু লিংক নি¤েœ দেওয় হল, যার মাধ্যমে আমরা নিজে নিজেই ইন্টারনেটের স্পিড পরিমাপ করতে পারি যেমন;
পাশাপাশি আমরা বিভিন্ন অ্যাপস এর মাধ্যমেও আমরা আমাদের মোবাইলের ইন্টারনেট স্পিড পরিমাপ করতে পারি যেমন;
SpeedSmart

V-SPEED
Meteor

পরিশেষে, বলতে চাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বাংলাদেশের শুধু বিভাগীয় শহরে নয় প্রান্তিক পর্যায়ে মোবাইল ওয়্যারলেসের নেটওর্য়াক ফাইভ জি লেভেলে নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বের সংঙ্গে তাল মিলিয়ে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য আমাদের প্রস্তত থাকতে হবে।