রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৯

আমাদের প্রজন্মকে যোগ্য করে তুলতে বই পাঠের বিকল্প নেই

বই পড়ার সাথে জ্ঞানের গভীর সর্ম্পক রয়েছে। বই পড়লে মানুষের জ্ঞান বাড়ে। জ্ঞানের চর্চা মানুষকে মহৎপ্রাণ করে তুলে, চিত্তকে মুক্তি দেয় এবং মানবাত্মাকে জীবনেবোধে বিকশিত করে। বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন ও মানসিক শান্তি লাভ করতে হলে বই পড়া দরকার। বই পড়ার গুরুত্ব আমরা জ্ঞানী ও মনীষীদের উক্তি থেকে বুঝতে পারি। 

ওমর খৈয়াম বলেন; মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্ত বইখানা অনন্ত যৌবনা- যদি তেমন বই হয়।

স্পিনাজো বলেন- ভাল খাদ্য বস্ত পেট ভরে কিন্ত ভাল বই মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে। নেপোলিয়ান বলেন-অন্তত ষাট হাজার বই না থাকলে জীবন অচল। নর্মান মেলর বলেন-আমি চাই যে, পাঠরত অবস্থায় যেন আমার মৃত্যু হয়। যুগে যুগে এই রকমভাবে মনীষীরা বই পড়ার গুরুত্ব মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। গ্রীসের থিবসের লাইব্রেরির দরজায় খোদাই করা আছে “আত্মার ঔষুধ”। তাদের বিশ^াস বই হলো আত্মার চিকিৎসার প্রধান উপকরণ। 

বই পড়া সচেতন মানুষের কাছে দেশ নিরাপদ ও স্থিতিশীল। যারা বড় হতে চাও তাদের প্রয়োজন বেশি বেশি করে বই পড়া। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বই পড়ার প্রতি এত বেশি আসক্ত ছিলেন যে, লাইব্রেরি কক্ষে কর্মচারীরা তার নির্বিষ্ট পাঠক মনের উপস্থিতি পর্যন্ত টের পেত না। তাই বহুবার তিনি লাইব্রেরি কক্ষে তালাবন্দি হয়েছেন। বই পাঠের প্রতি আসক্তির কারণেই তিনি হয়ে উঠেন অগাধ পন্ডিত্য ও বহুমুখী জ্ঞানের অধিকারী। 

একটি ভালো বই যেকোনো সময় মানুষকে বদলে দিতে পারে। তার মানবিক সুকোমল বৃত্তিগুলোকে বিকশিত করে দায়িত্বসচেতন, দেশপ্রেমিক নাগরিকে পরিণত করে। বই পড়া’র অভ্যাস না থাকার কারণে সমাজে, মানকিবতা, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যপ্রীতি বিনিষ্ট হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের ভবিষৎ প্রজন্ম বই ছেড়ে প্রযুক্তির অপব্যবহারে আসক্ত। গবেষণায় দেখা যায়, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা দিনে পাচঁ থেকে আট ঘন্টা ইন্টারনেট ও ডিজিটাল যন্ত্র নিয়ে মেতে থাকছে। ভ্রমনে, অবসরে বা বিনোদনে হাতে বই নিয়ে বসা তো দূরের কথা ডিজিটাল যন্ত্রের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা মেতে থাকছে। এমনকি সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে পাশাপাশি বসলেও একে অপরের সাথে কোনো কুশল বিনিময় হয় না। ডিজিটাল যন্ত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। যার ফলে বর্তমান প্রজন্ম ও আমাদের ভবিষৎ উন্নত শারিরীক গঠন, সামাজিক সংহতি ও মানসিক প্রশান্তি মধ্যে বেড়ে ওঠার সুযোগ হারিয়ে ফেলছি। বর্তমান প্রজন্মকে এর থেকে উত্তরণের উপায় হল তাদেরকে বইমুখী করতে হবে। ছোট সস্তানদের সামনে ফোন বের করবেন না। ওরা যখন ফোন দেখবে না তখন এর প্রতি আর্কষণ অনুভব করবে না। তাদের হাতে বই তুলে দেন। 

দেশের ভবিষৎকে সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তুলতে বই পড়ায় সচেষ্ট করতে হবে। উন্নত জাতি ও রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে হলে জ্ঞান ও শিক্ষার সমন্বয়ে বড় মনের আলোকিত মানুষ হতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে যত বেশি বই পৌছে দেওয়া যাবে ততই তারা জ্ঞানসমৃদ্ধ হবে। গবেষণায় দেখা যায় নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস করলে ব্রেনের কর্মক্ষমতা বাড়ে ও জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা হ্রাস পায়।

তরুণ প্রজন্মকে যোগ্য করে তুলতে পাঠের বিকল্প নেই। ’একটি ঘর, একটি লাইব্রেরি’ এ স্লোগানকে বাস্তবায়ন করতে হবে। ছাত্রজীবন থেকে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। গ্রামগঞ্জে পাঠগারের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠি বই পড়া ও কেনার সুযোগ পায়। পাশাপাশি স্কুল কলেজে বিজ্ঞান মেলার সাথে বই মেলার আয়োজন করতে হবে। যার ফলে শিক্ষার্থীরা নতুন নতুন বইয়ের সাথে পরিছয় হবে এবং বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি হবে। স্কুল-কলেজে বার্ষিক খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় পুরুষ্কার হিসেবে বই দিতে হবে। সামাজিক অনুষ্ঠানে বই উপহার হিসেবে দেবার ও গ্রহণ করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংস্থায় এমনকি কর্মস্থলে/ঘরে একটি করে লাইব্রেরি স্থাপন করতে হবে। যার ফলে মানুষের বই পড়ার আগ্রহ তৈরী হবে ও জ্ঞান নির্ভর জাতি গড়ে ওঠবে। 

শনিবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৯

টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যুবদের জন্য প্রযুক্তি ও চাহিদা নির্ভর কর্মপযোগী শিক্ষা নিশ্চিতকরুন

শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হল ব্যক্তির দেহ-মনের উন্নয়ন ও বিকাশের মাধ্যমে সুনাগরিক গড়ে তোলা, মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা, জ্ঞান, দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে সৃজনশীল, উৎপাদনশীল ও বিশ্বমানের মানুষ গড়া। খ্রিস্টের জন্মের সাত’শ বছর আগে চৈনিক দার্শনিক কুয়ান চাং (Kuan Chang) বলেছিলেন If you plan is for one year, plant rice. If you plan for ten years, plant trees. If you plan for hundred years, educate children. শিক্ষা মানুষের আশা আকাঙ্খা জাগ্রত করে, জীবনকে সমৃদ্ধ করে, জাতিকে উন্নত করে। উন্নত বিশ্বর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তারা তাদের যুব সমাজকে  প্রযুক্তি ও চাহিদা নির্ভর কর্মপযোগী শিক্ষা শিক্ষিত করে জাতি হিসেবে উন্নত হয়েছে, পাশাপাশি উচ্চ আয়ের দেশ ও অর্থনৈতিক মডেল হয়েছে। এই জন্য ২০৪১ এর মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হতে হলে এই দেশের  ৬কোটি  যুবককে প্রযুক্তি ও চাহিদা নির্ভর কর্মপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত করা আজ সময়ের দাবি।

শিক্ষা মানুষের অধিকার, ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে’র ২৬ নং অনুচ্ছেদে ঘোষণা করা হয়েছে প্রত্যেকেরই শিক্ষার অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশ এই ঘোষণাপত্রের অনুস্বাক্ষরকারী দেশ। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে। শিক্ষাকে বাংলাদেশ সরকার গুরুত্ব দিয়ে আসছে, তার প্রেক্ষিতে আমাদের সাফল্যও প্রশংসনীয়। বর্তমানে স্বাক্ষরতার হার ৭২.৮৯ শতাংশ। এদের মধ্যে পুরুষ হার ৭৫.৭০ শতাংশ আর নারীর স্বাক্ষরতার হার  ৭০.০৯ শতাংশ। নারী শিক্ষার অগ্রগতী প্রশংসনীয়, অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীরা ভাল ফলাফল করছে। স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীর সংক্ষ্যা বাড়ছে, ১৯৯০ সালে মাত্র ৬০ শতাংশ শিশু স্কুলে নিবন্ধিত ছিল, ২০১৫ সালে তা বেড়ে ৯১ শতাংশে উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে তা বেড়ে চলছে। আশা করা যায় বিদ্যালয়ে শিশুদের জন্য সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার সরবরাহ করা হলে তা ১০০ শতাংশে উন্নতি হবে এবং ঝড়ে পড়া শিশুর সংখ্যা কমে আসবে।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা তিন স্তর বিশিষ্ট- প্রাথমিক স্তর, মাধ্যমিক স্তর এবং উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় স্তর। সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয় ৫ বছর মেয়াদী প্রাথমিক, ৭ বছর মেয়াদী মাধ্যমিক - এর মধ্যে ৩বছর মেয়াদী জুনিয়র, ২ বছর মেয়াদী মাধ্যমিক এবং ২ বছর মেয়াদী উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে তৃতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা ৩-৫ বছর মেয়াদি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত ৩৬টি পাবলিক ও ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন -এর তত্ত্বাবধানে অধিভুক্ত কলেজের মাধ্যমে এ শিক্ষা দেয়া হয়। শিক্ষার্থীরা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা বা ইংরেজির মধ্যে যেকোনোটিকে বেছে নিতে পারে। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয় হলো শিক্ষার জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দফতর। এর অধীন কয়েকটি অধিদপ্তরে রয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প (শিক্ষা প্রকল্প ও কারিগরি প্রকল্প )’র মাধ্যমে এ অধিদপ্তরসমূহের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দশটি (১০) শিক্ষা বোর্ডে অধিভুক্ত। বোর্ডগুলো তিনটি পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনা কওে; জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা,মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা এবং উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষা। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্স (ব্যানবেইনস) গঠন করেছে, যা সব পর্যায়ের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট তথ্য সংরক্ষণ করে (সূত্রঃ www.moedu.gov.bd )। 

বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে গঠিত বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন থেকে পাওয়া তথ্য ও অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে একটি শিক্ষানীতি প্রকাশ করেছে। ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশ আমলে  উডস এডুকেশনাল ডেসপাচের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষানীতি বা শিক্ষা কমিশনের যাত্রা শুরু। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২ সালে একটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। এ পর্যন্ত কুদরত-ই-খুদা কমিশন রিপোর্টের ভিত্তির ওপর সমসাময়িক বাস্তবতা ধারণের চেষ্টা করা হয়েছে সব শিক্ষা কমিশনের নতুন রিপোর্টে। সর্বশেষ কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে ২০০৯ সালের রিপোর্ট, বর্তমানে কার্যকর রয়েছে। এত এত রিপোর্টের পরেও কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মূলনীতি পাশ কাটানো চলছেই।

প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ৩.২ মিলিয়ন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় স্তর ভর্তি হয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের মতে ২০৩০ সাল নাগাদ উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় স্তর শিক্ষার্থী সংখ্যা হবে প্রায়ই ৪.৬ মিলিয়ন। এবং এই উচ্চশিক্ষা স্তরের ৭২ শতাংশ শিক্ষার্থী হল জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অধিভূক্ত শিক্ষার্থী। প্রতিবছর শ্রম বাজারে অর্ন্তভূক্ত হচ্ছে ২.২ মিলিয়ন গ্রাজুয়েট । তাদের মধ্যে মাত্র ৮-১০ হাজার গ্রাজুয়েট সরকারী ও আধা সরকারী চাকুরীর সুযোগ পায়। প্রায়ই ১-২ লাখের মত বেসরকারি চাকুরীর সুযোগ পান। ৮-১০ লাখের মত বিদেশে শ্রম অভিবাসী হিসেবে কাজ করতে যান। আর ব্যাপক একটি অংশ বেকার থাকেন (যার কোন সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই)। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ জন গ্রাজুয়েট এর মধ্যে ০৫ জনই বেকার। গবেষণায় বলা হয়, এই গ্রাজুয়েট পাস বেকার সংখ্যার বৃদ্ধির পেছনে কারণ হল, প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষার নিম্নমান ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গতানুগতিক পুরানো পাঠক্রম। বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা শুধু সার্টিফিকেট নিয়ে বের হচ্ছে। আর শিক্ষার্থীদের বুঝতে হবে এই সার্টিফিকেট শুধুমাত্র একটি প্রিন্টেড কাগজ যা, অপনাকে প্রতিযোগিতায় প্রবেশের এন্ট্রিকার্ড মাত্র। বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় সার্টিফিকেটধারী গ্রাজুয়েট তৈরী করছে কিন্ত উৎপাদনশীল মানবসম্পদ নয়। তার কারণ হল, একজন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ শিক্ষার্থী মনে করে তাকে যে কোন ভাবে গ্রাজুয়েটধারী হতে হবে। তাই গ্রাজুয়েট সার্টিফিকেট এর জন্য সে চার থেকে ছয় বছর ব্যায় করে একটি গ্রাজুয়েট সার্টিফিকেট অর্জন করে, যা মূলত অর্থহীন। মুনাফালোভী কিছু উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক স্বার্থে শিক্ষার্থীদেরকে গতানুগতিক শিক্ষার সার্টিফিকেট প্রদান করে যাচ্ছে। কিন্ত ভবিষ্যত কর্মপযোগী শিক্ষা দিচ্ছে না। আমরা জানি, ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা বিশে^র অন্যতম সেরা শিক্ষা ব্যবস্থা। ফিনল্যান্ডে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত কারিগরী শিক্ষার কোর্স গ্রহন করতে হয়। সিভিল সার্ভিসে কাজ করার আগ্রহ থাকলে স্নাতক ডিগ্রির জন্য কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়। কেবলমাত্র স্কুল শিক্ষকদের জন্য মাস্টার্স এবং গবেষকদের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি থাকতে হয়। 

আমাদের শিক্ষার্থীদের স্নাতক ডিগ্রির জন্য যে উম্মত্ততা তা কমাতে হবে। বিষয় ভিত্তিক পারদর্শিতাকে কাজে লাগিয়ে কারিগরি শিক্ষায় মনোনিবেশ করতে হবে। এবং রাষ্ট্রকে এই পরিবেশ নিশ্চিত  করতে হবে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণতি হতে হলে অন্তত এই পরিবর্তনটুকু আমাদের করতে হবে। যুবদের প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় যেতে উৎসাহিত করতে হবে। নতুন নতুন প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে, উপজেলায় উপজেলায় বৃত্তিমূলক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যুবদের জন্য ভবিষৎত কর্মপযোগী বিষয় ও ট্রেড এই সমস্ত ইনস্টিটিউটে চালৃ করতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে আকৃষ্ট করতে হবে।

এটা লক্ষনীয়, ১০ বছর আগে, যারা উচ্চ বিদ্যালয়ে পাস করেছে তাদের মধ্যে মাত্র এক শতাংশ বৃত্তিমূলক বা প্রযুক্তিগত প্রতিষ্ঠানে ভর্ত্তি হত। বর্তমানে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ শতাংশ। আশা করা হচ্ছে যে হারে তালিকাভুক্তি বাড়ছে, ২০২১ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ২০ শতাংশ পর্যন্ত যেতে পাওে, এটি একটি ভাল লক্ষণ। তবে উদ্বেগজনক বিষয় হ'ল মৌলিক বিজ্ঞানগুলিতে ভর্তিও সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। এটি একটি বিশ্বব্যাপী ঘটনা, এবং যদি এটি পরিবর্তন না হয় তবে নতুন জ্ঞান তৈরি করা কঠিন প্রমাণিত হতে পারে। ¯œাতক পর্যায়ে নতুন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ ও আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ধরে রাখা বা শিক্ষকদের অবসর বয়স বাড়ানো। অনেক দেশে, নির্দিষ্ট পেশাদাররা অবসর গ্রহণ করেন না, তাদের মধ্যে অন্যতম শিক্ষক। চাহিদা নির্ভর কর্মপযোগী কোর্সের জন্য পাঠক্রম তৈরীর জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিল্প বা নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে ইনপুট নেওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। তেমনিভাবে বিশ^মানের ও নিজের প্রয়োজনমাপিক কর্মী তৈরীর জন্য শিল্প বা নিয়োগকর্তাদের কোন পরিকল্পনাও নেই। অনেকক্ষেত্রে শুনতে হয়, চাকুরী আছে কিন্ত ভালো মানের কর্মী পাওয় যাচ্ছে না। তাই অনেক ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তারা বিদেশ বা পাশর্^বর্তী দেশ থেকে জনবল নিয়োগ করে থাকেন। গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে ৪০০,০০০ বিদেশী বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছেন এবং ৫ বিলিয়ন ডলার এই দেশ থেকে তারা নিয়ে যাচ্ছেন। আর অপরপক্ষে প্রায় ১০ মিলিয়ন বাংলাদেশী প্রবাসী মধ্যপ্রাচ্য সহ পৃথিবীর বিভিন্নদেশে কাজ করে বছরে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছেন ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। স্থানীয় নিয়োগকর্তারা বিদেশী কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে বলেন যে, দেশে দক্ষ, শিক্ষিত জনবলের অভাব রয়েছে। এই ক্ষেত্রে স্থানীয় নিয়োগকর্তারা দক্ষ কর্মী তৈরীতে বিনিয়োগ করতে পারেন। সেই ক্ষেত্রে দুটি লাভ এক দক্ষ জনশক্তি তৈরী হবে। দেশীয় কর্মসংস্থানের চাহিদা মেটাবে ও দেশের টাকা দেশে থাকবে। বোনাস হিসেবে বাংলাদেশীরা বিদেশে কর্মসংস্থান যুগিয়ে দেশে বেশি করে রেমিট্যান্স পাঠাবে, দেশের অর্থনীতি দৃড় হবে।

বাংলাদেশের যুবকদের মধ্যে আইটি বা কম্পিউটার সাক্ষরতা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে কম্পিউটার ব্যবহারকারীর বেশিরভাগের মধ্যে আইটি ধারণাটি ইন্টারনেট ব্রাউজিং বা ফেসবুকের মধ্যে সীমাবদ্ধ।ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম দ্বারা প্রকাশিত গ্লোবাল প্রতিযোগিতা সূচক অনুসারে, ১৩৮ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আইটি প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে ১০৬ তম স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে আইটি সম্পর্কিত বেশিরভাগ শীর্ষ চাকরি বিদেশী আইটি বিশেষজ্ঞরা করছেন। আমাদের বিশ^বিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এই ব্যাপারে আরও মনোযোগী হতে হবে। যাতে আামদেও শিক্ষার্থীরা দেশের চাহিদা মিটিয়ে গুগল, ইয়াহু, ফেসবুক এরম ত ওয়ার্ল্ড লিডিং আইটি প্রতিষ্ঠানে জব করতে পারে। তাই আমাদের আর কালক্ষেপন করা যাবে না, শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি গুনগত প্রযুক্তি ও চাহিদা নির্ভর কর্মপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেটের বরাদ্দ বাড়াতে হবে। স্বল্প বরাদ্দ দিয়ে উচ্চশিক্ষার উন্নতি ও প্রযুক্তি শিক্ষার প্রসার করা যায় না।

টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট (এসডিজি) অর্জনে যুবদের জন্য প্রযুক্তি, চাহিদা নির্ভর কর্মপযোগী এবং মান সম্পন্ন শিক্ষা করতে হবে। আজকে যারা যুব ২০৩০ সালের মধ্যে তারাই দেশ পরিচালনা করবে। তাই টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট (এসডিজি) অর্জনে যুবদের কার্যক্রর অংশগ্রহন খুবই প্রয়োজনীয়। যুবদের জন্য চাহিদা নির্ভর কর্মপযোগী এবং মান সম্পন্ন শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে হিসেবে প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা কাঠামো চালু করে, ডিজিটাল বাংলাদেশের গড়ে তোলার ব্যপারে কার্যক্রর পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে। এসডিজি অর্জনে যুব সমাজকে সম্পৃক্ত করার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। প্রানিÍক ও বিশেষ জনগোষ্ঠির যুবদের মত প্রকাশ ও উন্নয়নে অংশগ্রহন করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। যুব উদ্যোক্তাদের জন্য বাজার সৃষ্টি (স্থানিক ও বৈশি^ক পর্যায়ে), উদ্যোক্তা হিসেবে আত্ম-প্রকাশের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা, যুবদের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করা, সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ক্ষেত্র নিশ্চিত করা। বেসরকারি ও উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান সমূহ যুব উন্নয়ন বিষয়ক বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা, কারিগরি প্রশিক্ষণ ও বৃত্তিমূলক কোর্স বাস্তবায়ন বিষয়ক প্রকল্প বেশী করে চালু করা। আর সর্বোপরী যুবদের মন-মানষিকতা পরিবর্তন করতে হবে। চাকুরি না খোঁজে উদ্যোক্তা হবার মানষিকতা তৈরী করতে হবে। গতানুগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়ে প্রযুক্তি ও চাহিদা নির্ভর কর্মপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে।

রবিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৯

টেকসই উন্নয়নে অভিবাসীদের অবদান

স্থানীয় ও বৈশি^ক উন্নয়ন তথা টেকসই উন্নয়নে প্রবাসীরা ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন। জাতিসংঘের তথ্যানুসারে, ২০১৭ সালে অভিবাসীরা তাদের নিজ নিজ দেশে ৫৯৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন। আর এই অর্থে পরিমাণ হচ্ছে সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত উন্নয়ন সহায়তার তিনগুন বেশি। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রেকে দারিদ্রসীমার ওপরে উঠাতে প্রবাসীরা ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অভিবাসীরা ১৫.৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন, যা আমাদের বৈদিশিক রির্জাভ এর ৬৬ শতাংশ। 

প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের পরিমান এখন তৈরী পোশাক খাত থেকে আয়কৃত অর্থের সম-পরিমান বা তারও বেশি। সর্বোপরি বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছে প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ বা রেমিট্যান্স। ধারনা করা হয়  বৈধ পথে এই প্রেরিত অর্থের ছেয়ে হুন্ডি বা অবৈধভাবে আসছে তার সমপরিমাণ অর্থ। গবেষণায় দেখা যায় প্রবাসীরা তাদের উপার্জনের ২০-৩০ শতাংশ নিজ দেশ পাঠিয়ে দেন। আর নারী অভিবাসীরা তাদের উর্পাজনের ৬০-৮০ শতাংশ নিজ দেশ পাঠিয়ে দেন। অথচ পুরুষের তুলনায় নারী শ্রমিকের আয় কম। বৈশি^কভাবে পৃথিবীর ৪৮ শতাংশ অভিবাসী শ্রমিক হল নারী। নারী অভিবাসীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি হয়রানি ও কঠোর শ্রমনীতির মুখোমুখি হন । বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে উঠে আসবে প্রথিবীর ১৬২ দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী প্রবাসীদের নীরব অবদানের কথা। যাদের একনিষ্ঠ শ্রম, মেধা, ত্যাগ ও ভালবাসার মাধ্যমে দেশ মাতৃকা, পরিবার, সংসার ও প্রিয়জন ছেড়ে প্রবাসে কাজ করছেন আর পরিবারের জন্য রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। সাদা চোখে, প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ দিয়ে তাদের সংসার চলছে, তার পরিবারের সদস্যদের ভরন পোষন হচ্ছে। আর একটু গভীর ভাবে ভেবে দেখলে দেশের দ্রারিদ্যতা কমছে (এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা-০১), বেকার যুবকদের উন্নত কর্ম-সংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে (এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা-০৮), কর্ম-সংস্থান এর সুযোগ এর ফলে সমাজে অস্থিরতা, উগ্রবাদ, সন্ত্রাস কমছে (এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা-১৬) যা কিনা বৈশি^ক টেকসই উন্নয়নে সরাসরি অবদান রাখছে। যেসব, প্রবাসীরা দেশে ফেরত আসছেন তাদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও টেকনোলজির পারদর্শিতা উন্নত বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখছে। যদিও ফেরত আসা প্রবাসীদের সঠিক ডাটবেজ নেই, তবে সে ক্ষেত্রে আমাদের মনোনিবেশ করা উচিত কিভাবে ফেরত আসা অভিবাসীদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও টেকনোলজির পারদর্শিতাকে কাজে লাগানো যায়। মাইগ্রেশান একটি বৈশি^ক বিষয় গত এক দশকে প্রায় ১০০ মিলিয়ন অভিবাসীস যোগ হয়েছে বৈশি^ক অভিবাসীর সংখ্যায় যার বর্তমান সংখ্যা প্রায় ২৫০ মিলিয়ন (অভিবাসী বৃদ্ধি হার বৈশি^ভাবে ৩.৪%)। ঝুকিঁপূর্ণে রুটে মাইগ্রেশন করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত অসংখ্য অভিবাসী প্রাণ হারাচ্ছে, শুধুমাত্র ২০১৪-২০১৫ বছরে প্রায় ১০,৪০০ অভিবাসী মৃত্যুবরণ করে। সম্প্রতী বাংলাদেশী অভিবাসীদের ভূমধ্য সাগরে সলিল সমাধি তারই প্রমাণ।

সর্বোপরি পৃথিবীর সামগ্রিক উন্নয়নে অভিবাসীদের অবদানকে স্বিকার করতে হবে। তাদের অধিকার ও স্বার্থকে প্রাধান্য  দিতে হবে। উন্নত বিশ^কে বুঝতে হবে তাদের  এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্বাছন্দ্য জীবনের পিছনে রয়েছে উন্নয়নশীল দেশ থেকে আগত অভিবাসীরা আত্মত্যাগ ও অসামান্য অবদান। আর উন্নয়নশীল দেশকে উপলব্দি করতে হবে তার দেশের প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ স্থানিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে ও টেকসই উন্নয়নে অবদান রেখে চলছে।


শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৯

নগরীকরণ, নাগরিক সেবা ও প্রতিবন্ধি বান্ধব শহর

বিশ্ব ব্যাংকের মতে গত এক দশকে বাংলাদেশে নগরীকরণের হার ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রথম। বাংলাদেশে জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখন শহরে বসবাস করছে। নগরীকরণের হার এভাবে চলমান থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের মোট জনসংখ্যার  অর্ধেকের ও বেশী নগরে বসবাস করবে। ধারনা করা হয় বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই বসবাস করে। এবং ঢাকার পরেই রয়েছে চট্টগ্রামের অবস্থান। নগর কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হল নগরগুলোতে অবস্থানরত নাগরিকদের নাগরিক সেবা প্রদান। বিশাল এই জনগোষ্ঠিকে  যথাযথ নাগরিক সেবা প্রদান করা নগর কর্তৃপক্ষের জন্য একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। তারপরও সীমিত সম্পদ ও অপ্রতুল বাজেটের মধ্যে সরকার, নগর কর্তৃপক্ষ ও বেসরকারি সংস্থা-সমূহ যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যাতে সমস্ত নাগরিককে নগরের সেবার আওতায় নিয়ে আসা। এখন দরকার হল নাগরিকদের সহযোগিতা, উন্নয়ন কাজে সমন্বয়, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও দেশপ্রেম। তাহলেই আমরা পারব সীমিত সম্পদের মধ্যেও সবার জন্য নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ প্রতিবন্ধি এবং তার মধ্যে প্রায় ৪ মিলিয়ন দৃষ্টি প্রতিবন্ধি। তাদের বিশাল একটা অংশ শহরে বসবাস করছে। 

আমরা কি পেরেছি এই বিশেষ জনগোষ্ঠিকে সঠিক নাগরিক সেবা পৌছে দিতে? আমার মতে, আমরা এখনও যথাযথ পারিনি। এখনও দেখি সিটি বাসগুলোতে প্রতিবন্ধি ব্যক্তিদের জন্য সিট খালি থাকেনা। যদিও অনেকক্ষেত্রে বাসে সিট নির্ধারিত লেখা থাকে, আমরা সেটা আমলে নেইনা কারণ তা মনিটরিং কোন ব্যবস্থা নেই। একই ভাবে আমাদের বাস স্ট্যান্ডগুলোও প্রতিবন্ধি ব্যক্তিদের জন্য কোন বিশেষ ব্যবস্থা নেই। সেজন্য আমাদের গণপরিবহনগুলো প্রতিবন্ধি ব্যক্তিদের ব্যবহারে উপযোগী নয়। একইভাবে আমাদের শহরের ফুটপাতগুলো তাদের চলাচলের জন্য উপযোগী নয়। অন্ধ নারীদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। শহরের রাস্তায় তাদের অন্ধত্বের সুযোগ নিয়ে যৌন হয়রানির ঘটনাও ঘটছে। আমাদের ফুটপাতগুলো বেদখল, যেখানে সেখানে বৈদ্যুতিক খুটি, খোলা ম্যানহল এই শহরে প্রতিবন্ধিদের চলাচলকে বিপদজনক করে তুলছে। একইভাবে, নগরের পথচারীদের সুবির্ধাথে চালু হয়েছে পাবলিক টয়লেট। সেই পাবলিক টয়লেটেও প্রতিবন্ধি ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থা নেই। আর ব্যবস্থা থাকলেও তা অকার্যকর। তাহলে প্রতিবন্ধি ব্যক্তিদের জন্য এই শহরগুলো কতটুকু নিরাপদ। আশার কথা, সম্প্রতি আমার নজরে পরে, প্রতিবন্ধি ব্যক্তিদের চলাচলের সুবির্ধাথে ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকার ফুটপাতে ব্লক টাইলস বসানো হয়েছে। 
এই টাইলসগুলোর একপাশে হলুদ টাইলস। এবং এই হলুদ টাইলসগুলোতে সোজা সোজা স্ট্রেপস আছে যাতে করে, দৃষ্টি প্রতিবন্ধি ব্যক্তিরা তাদের গন্ত্যবে যেতে পারে। ফুটপাতের ঢাল বরাবর বিশেষ চক্রাকার ডিজাইনের টাইলস বসানো হয়েছে, যাতে করে ফুটপাতের ঢাল সমূহ দৃষ্টি প্রতিবন্ধি ব্যক্তিরা সহজেই বুঝতে পারে। 

ঢাকার পরে, আমার দেখা চট্টগ্রাম শহরেও বেশ কয়েকটি এলাকার ফুটপাতে ব্লক টাইলস বসানো হয়েছে। তবে সেখানে মাঝখানের যে, হলুদ রংয়ের সোজা সোজা স্ট্রেপস আছে সে টাইলস ব্যবহ্রত হচ্ছে না। এইক্ষেত্রে যদি আমরা একটু সমন্বয় করি ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধি ব্যক্তি চলাচল উপযোগী টাইলস ব্যবহার করি তাহলে আমাদের ফুটপাথগুলো অন্তত প্রতিবন্ধিদের চলাচল উপযোগী ও নিরাপদ হবে। তাই আমি অনুরোধ করব নগরীর ফুটপাতে যাতে ব্লক টাইলস বসানো হয়। গণ-পরিবহনে, (সিটি বাস) বাসে যে সংরক্ষিত নয়টা সিট রাখা প্রতিবন্ধি, শিশু ও নারীদের জন্য। সে ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করতে হবে, প্রয়োজনে মনিটরিং করতে হবে। বাস স্ট্যান্ডগুলোতে প্রতিবন্ধিদের ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি প্রতিবন্ধিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইনের বাস্তবায়ন, মনিটরিং ও সবার সমন্বয়সাধনই নিশ্চিত করতে পারে, প্রতিবন্ধি বান্ধব শহর। যা, আমাদের সহযোগিতা করবে ২০৪০ এর মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়তে, পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার, লক্ষ ১১ টেকসই নগর ও কমিউনিটি গঠনে । 

সোমবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

কম্পিউটার ও ওয়েব তথ্যের নিরাপত্তা বিষয়ক সহজ সরল টিপস

ডিজিটাল যুগে কম্পিউটার সহ বিভিন্ন আইসিটি গ্যাজেট এখন আমাদের নিত্যসঙ্গি ও নির্ভরতা কেন্দ্র। ব্যস্ততার জীবনকে সহজ করে দিচ্ছে আইসিটি ও তার বিভিন্ন সেবা-সমূহ যেমন অন-লাইন মার্কেটিং, অন-লাইন ব্যাকিং, ই-কমার্স, অন-লাইন স্টোরেজ ও ক্লাউডিং। আইসিটি এই নির্ভরতা আমদেরকে আবার অনেক ঝুকিঁর মধ্যে ফেলে দিয়েছে। হ্যাকার ও স্ক্যামার’রা বসে অছে কিভাবে আমাদেরকে ফাঁদে পেলে সব তথ্য ও অর্থ ছিনিয়ে নেবার। সে জন্য আমাদের ভাবা উচিত আইসিটি ও ওয়েব এর ব্যবহারের  নিরাপত্তা নিয়ে। সহজ কিছু নিয়ম মেনে চললেই আমরা রোধ করতে পারি সম্ভব হ্যাকিং, ওয়ার্ম, ভাইরাস, তথ্য চুরিসহ আরও অনেক কিছুই। নি¤েœ কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহারের কিছু সহজ সরল নিরাপত্তা’র ট্রিপস নিয়ে আলোচনা করা হল;

ওয়েব ব্রাউজারে WOT (web of trust)  এড অনটি ইনস্টল করা। এই এড-অনটি ব্যবহার করলে, আপনি কোন সাইটে গেলেই সেই সাইটের রেটিং ৪ ধাপে (Trust Worthiness, Privacy, Vendor Reliability, Child Safety) দেখিয়ে দিবে এবং খারাপ সাইটগুলোর জন্য আপনাকে সতর্ক করে দিবে। পাশাপাশি লিংকগুলোর জন্যও দেখিয়ে দিবে তার রেটিং।

সিকিউরিটি সফটওয়্যার বা অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করা। কম্পিউটারের নিরাপত্তা যদি অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যারের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে অবশ্যই ভাল মানের একটি অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করা এবং এটাকে নিয়মিত আপডেট রাখা। বিনা মূল্যে অনেক অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার পাওয়া যায় কিন্তু সেগুলোতে নিরাপত্তার সকল ব্যবস্থা থাকে না।

ফায়ারওয়াল কে সক্রিয় রাখা। ফায়ারওয়াল হল একটি বিশেষ ধরনের সফটওয়্যার ব্যবস্থা। এটা ইনকামিং ও আউটগোয়িং ইন্টারনেট সংযোগ পর্যবেক্ষণ করাসহ হঠাৎ করে হ্যাকারদের আক্রমণ রোধ এবং নিজ থেকেই ছড়িয়ে পড়া ওয়ার্ম প্রতিহত করতে কাজ করে। এটি সক্রিয় করার জন্য উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের Run এ গিয়ে firewall.cpl  লিখে এন্টার দিলে ফায়ারওয়াল সেটিংস খুলবে। এরপর প্রয়োজন অনুযায়ী ফায়ারওয়াল সেটিং করে নিন।

কম্পিউটার অপারেটিং সিষ্টেম সহ, ব্যবহ্রত অন্যান্য সফটওয়্যার আপডেট রাখা।  কম্পিউটারে ব্যবহ্যত সফটওয়্যার সমূহকে নিয়মিত আপডেট রাখলে তা হ্যাকিং, ওয়ার্ম, ভাইরাস থেকে কম্পিউটারতে সুরক্ষা করে।

ই-কর্মাস ব্যবহার বা অন-লাইনে তথ্য ও অর্থ লেনদেনে সর্তক থাকা। অনলাইনে তথ্য ও অর্থ লেনদেনের সময় ঐ সাইট সর্ম্পকে বিস্তারিত জানুন। প্রয়োজনে রিভিউ দেখুন। তথ্য ও অর্থ লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানের ফোন নম্বর ও ঠিকানা আছে কিনা তা খেয়াল করুন। যদি এই সমস্ত তথ্য না থাকে তাহলে তথ্য ও অর্থ লেনদেনে থেকে বিরত থাকুন।

তথ্য ও অর্থ লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানের ওয়েব সাইটের লিংকে  https আছে কিনা ভাল করে খেয়াল করুন। https থাকলে বুঝবেন সাইটটি নিরাপদ। আর https না থাকলে অর্থ ও তথ্য লেনদেন থেকে বিরত থাকুন।

পাসওয়ার্ডে বিশেষ ক্যারেক্টারের ব্যাবহার করুন।  অধিকাংশক্ষেত্রে আমরা ইন্টারনেট ব্যবহারের ইমেইল, ফেইসবুক ছাড়াও অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সাবধান নই। সহজেই মনে রাখা যায়, এমন ধরনের পাসওয়ার্ড সবাই ব্যবহার করতে চাই। কিন্তু আপনি কি জানেন? আপনার কাছে যেটা মনে রাখা সহজ, হ্যাকারদের কাছে সেটা অনুমান করা তার চেয়েও সহজ। এজন্য সর্বদা পাসওয়ার্ড বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কিবোর্ডের বিশেষ অক্ষর যেমন- F@$*G%r#  ইত্যাদি মিলিয়ে পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন। তাহলে হ্যাকার অথবা অন্য কেউ সহজে আপনার পাসওয়ার্ড অনুমান করতে পারবে না, ফলে অনলাইনে আপনি থাকবেন নিরাপদ। এক পাসওয়ার্ড বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন আর আপনার নাম ও জন্ম সাল ব্যবহার না করাই উত্তম। প্রয়োজনে আপনার বিশেষ পাসওয়ার্ডটি অন্য কোথায় সংরক্ষণ করুন ও কাউকে শেয়ার করবেন না। বিশেষ করে অন্য কারো মোবাইল বা কম্পিউটারে লগ-ইন করলে, ব্যবহার শেষে অবশ্যই লগ-আউট করবেন।

ইন্টারনেট ব্যবহারের (ওয়েব ব্রাউজিং) সময় সতর্ক থাকুন। ইন্টারনেটের যথাযথ ব্যবহার আমরা অনেকেই করতে জানি না। বিভিন্ন ধরনের লিংক এবং আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দেখে এতে হুটহাট করে ক্লিক করি,  তা থেকে বিরত থাকতে হবে। না বুঝেই ইমেইল এর স্প্যাম ফোল্ডারে আসা ইমেইলের লিংকে ক্লিক করা থেকে বিরত থাকুন। কোনো কিছু ডাউনলোড করার সময় সতর্ক থাকুন কোন ধরনের তথ্য আপনি ডাউনলোড করতে চাচ্ছেন। ভুলবশত কোন ওয়ার্ম বা ভাইরাস ডাউনলোড দিচ্ছেন না তো? অনলাইনে হ্যাকার বা দুষ্কৃতকারীরা সবসময় আপনাকে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন এবং ডলারের প্রলোভন দেখিয়ে আপনার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে। এজন্য আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন বা লিংকে ক্লিক করার আগে ভেবে চিন্তা ক্লিক করুন। নয়তো এক ক্লিকেই কখনো আপনার কম্পিউটার বা নিজের বিপদ ডেকে আনবেন।

সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে সর্তক থাকুন। সোশ্যাল মিডিয়া’তে (ফেসবুক/টুইটার/স্কাইপে/হুয়ার্টস অ্যাপ ইত্যাদি) অপরিছিত কারও রিকোয়েস্ট এসেপ্ট করবেন না। প্রয়োজনে তার প্রোফাইল দেখুন ও মিউটাল ফ্রেন্ড তালিকা দেখে শিউর হন। অথবা তার ছবিটি গুগলে সার্ছ দিয়ে দেখতে পারেন, সোশ্যাল মিডিয়া’র প্রোফাইলে ব্যবহ্যত ছবি টি আসলে তার কিনা। অনেক সময় স্ক্যামার’রা সেলিব্রেটিদের ছবি ব্যবহার করে আপনাকে বন্ধু বানিয়ে ফাঁদে পেলতে পারে।

কম্পিউটারে রক্ষিত মূল্যবান তথ্য সমূহ নিয়মিত ব্যাকআপ রাখা। অনেক সময় আমরা না বুঝে কম্পিউটারের ক্ষতি সাধন করি ও সেট আপ বা ফরমেট করি ফেলে। সেজন্য আমাদের অপূরনীয় ক্ষতি হয়ে যায়। সে অপূরনীয় ক্ষতি হতে রক্ষা পেতে মূল্যবান তথ্য সমূহ এক্রটা হার্ডডিস্কে নিয়মিত ব্যাকআপ রাখা। সি ড্রাইভ ও ডেস্কটপে গুরুত্বপূর্ণ কোন ফাইল না রাখা। পারসনাল কম্পিউটারটিতে পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা।

প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষণের জন্য ক্লাউড ব্যবহার করা। আপনার ডিভিডি বা পোর্টেবল হার্ডডিস্ক তো হারিয়ে যেতে পারে, নষ্টও হতে পারে। তাই প্রয়োজনীয় ফাইলগুলো এখন ক্লাউডে সংক্ষণ করুন। এর জন্য খুব ভালো ভালো কিছু সার্ভিস আছে, যেমন ড্রপবক্স, স্পাইডারওক, গুগল ড্রাইভ বা স্কাইড্রাইভ। এভাবে ক্লাউডে রাখলে সেগুলা খুব সহজে নষ্ট হবে না। 

উপরোক্ত বিষয় গুলো মেনে চললে খুব সহজেই বাড়িয়ে নিতে পারবেন আপনার কম্পিউটার সহ প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধ  জীবন ।

সোমবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৯

চা’য়ের নেশায় চা’য়ের রাজ্যে ভ্রমন

শরীর সুস্থ ও ভালো রাখতে নিয়মিত চা পানের বিকল্প নেই। বাঙালিদের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় চা। ক্লান্তি দূর করতে চা পানের বিকল্প নেই। ‘‘'চা পানে নাহি দোষ, চা করে চিত্ত পরিতোষ” । সম্ভবত বাঙালিদের মধ্যে সর্ব প্রথম চা পান করেছিলেন জ্ঞান তাপস অতীশ দীপঙ্কর। সম্ভবত ১০২০ সালে তিনি তিব্বত ভ্রমণ করার সময় চা পান করেছিলেন। আঠারশ' শতকের দিকে ব্রিটিশরা আমাদের চা পানে উৎসাহ জোগাতে বিনাপয়সায় আমাদের চা খাওয়াতেন। সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিকাশে চা এর অবদান উল্লিখিত। যেন চায়ের পত্তরে রসদ পেতেন লেখার উপকরণ। আমার মনে হয় রবিন্দ্রনাথ, নজরুল ও শরৎ এর সাহিত্য বিকাশে চা পান এর অবদান রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সকালে উঠে তার বিশ্বস্ত বনমালীর হাতে তৈরি এককাপ চা পান না করে লিখতে পারতেন না। 

চা’য়ের উপর ভক্তি থেকে, চায়ের দেশে ভ্রমন করার ইচ্ছা অনেক আগ থেকেই, তবে সেটা অন্যরকম ভাবে। যেমন রাত্রে চা বাগানে অবস্থান করে বাগানের সৌর্ন্দয উপভোগ করা আর অরিজিনাল চা’য়ের ফ্লেভার নেওয়া। ছোট কাল থেকে শুনেছি অরিজিনাল চা নাকি বিদেশে চলে যায়। আর অমরা পান করি চা ফেক্টরির কোরানো চা।  স্বাদ এর সাথে এবার সাধ্য মিলল,  সুযোগ হল চা’ এর দেশে বেড়িয়ে আসবার,  ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ বড় দিনের ছুটির সাথে পারসোনাল ছুটি সমন্বয় করে দু-দিনের ছুটি বাড়িয়ে নিলাম। ২৪ ড়িসেম্বর রাত ১০ টায় উদয়ন এক্রপ্রেস করে শুরু হল চট্টগ্রাম থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা। পরের দিন সকাল ৭টায় সিলেট গিয়ে পৌছলাম। এবং সেখানে আমার  বড় আপার বাসায় (স্ত্রীর বড় বোন) উঠলাম যেখানে পূর্বে থেকে আমার পরিবারের সদস্যরা অবস্থান করছে। বড় আপুর প্রতিবেশী সিলেটের একটা নাম করা চা বাগানের ব্যবস্থাপক। আমার ইচ্ছার কথাটি উনি উনার প্রতিবেশীকে আগ থেকে অবহিত করেন। এবং সেই প্রতিবেশী ব্যাপারটিকে সানন্দে গ্রহন করেন এবং আামার এই ভিজিটে উনার চা বাগানে ভ্রমনের আমনত্রন জানান। আমরা সেই অফারটিকে গ্রহন করি। এবং ২৫ ডিসেম্বর বেলা ৩টায় ভাড়া করা গাড়ি করে হবিগঞ্জে, তেলিয়াপাড়ায় চা বাগানে গমনের উদ্দেশ্যে আমরা রওনা হই। সাথে ছিলেন আমার পরিবার, বড় বোনের পরিবার ও বাগান ব্যবস্থাপকের বেগম। আমাদের এই ভ্রমনে সদস্য সংখ্যা প্রায়ই ১১ জন। প্রায় ৩ ঘন্টা যাত্রা করে কাঙ্খিত চা বাগানে পৌছি। তবে পৌছতে পৌছতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। চা বাগানে পৌছেই আমার যাত্রার ক্লান্তি ঘুছিয়ে যায়। অনেকটা বাংলা প্রবাদ প্রবচন এরম মত আগে দর্শনদারী পরে গুণ বিচারী। আমরা পূর্বে থেকেই নির্ধারিত  চা বাগানের বাংলোতে অবস্থান নেই। বাংলোর পরিবেশ ও কাঠামোর সৌর্ন্দয দেখে আমি অভিভূত। এই যেন এক রাজকীয় সৌর্ন্দয। সত্যিই আমি অভিভূত। 

বাংলোর সৌর্ন্দয বিবরণে, বাংলোটি প্রায় ১০ একর জায়গার উপর অবস্থিত, চারদিকে সাজানের ফুল ও ফলেরে বাগান। আর বাংলোটি কাঠর তৈরী দ্বিতল, নিচতলায় সুবিশাল লবি, চারদিকে অর্কিড আর সিজেনাল ফুলের সমাহার, সুবিশাল গোছানো ড্রয়িং রোম, বিস্তুত ডাইনিং ও কিছেন। দ্বিতলে উঠার সিড়িটি পাথরের তৈরী আবার কাঠের রেলিং। বাংলোর দ্বিতলা টা বেশ গুছানো, যেখানে রয়েছে তিনটি বিশাল বেড রুম। প্রত্যেকটি বেড রুম বেশ গুছানো, ছিমছাম ও রয়েছে এটাছ বাথরুম। এবং রয়েছে বিশাল একটি বারান্দা, যেখানে বসার জন্য রয়েছে সুন্দর আয়োজন। 

আমি আমার পরিবারকে নিয়ে দ্বিতলের একটি রুমে উঠি এবং ফ্রেশ হই। পরবর্তীতে আমরা চা শ্রমিকের আমন্ত্রণে বড় দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহনের জন্য রওনা হই। উল্লেখ্য আমাদের ভ্রমণকৃত চা বাগানটিতে প্রায় ১২০০ শ্রমিক ভিন্ন ভিন্ন লেয়ারে কাজ করছে। শ্রমিকের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠি ও ধর্মের জনবল রয়েছে। তার মধ্যে সাওঁতাল, ওরাও, মনিপুরী ও ওড়িস্যা নামক জনগোষ্ঠি উল্লেখযোগ্য। আর ধর্ম দিক থেকে সেখানে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও মুসলিম ধর্মাবলী উল্লেখযোগ্য। আমরা ১০ মিনিটের মধ্যে বাংলোর পাশের্^ ও বাগানের মধ্যে অবস্থিত একটি চার্চে যাই। যেখানে খ্রিষ্টান ধর্মাবলীদের আয়োজনে বড় দিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করি। উল্লিখিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আদিবাসীদের আয়োজনে গান, নৃত্য প্রদর্শনী হয়। উল্লেখ্য, এখানে একটা সংকটের বিষয় আমি উপলব্দি করি, যেমন প্রদর্শিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিদেশী সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব পরিল্লখিত হয় এবং পোশাক পরিচ্ছেদে বিদেশী সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষনীয়। সেখানে আমি স্থানীয় আদিবাসীর সংস্কৃতির অভাব লক্ষণ করি। চা শ্রমিকদের আতিথিয়তায় আমরা তুষ্ট হই এবং আমরা আবার বাংলোয় ফিরে আসি। বাংলোয় এসে দেখি বার বি কিউ’র আয়োজন। শীতের এই রাতে বার বি কিউ’র আয়োজন প্রক্রিয়া বেশ উপভোগীয়।

 বার বি কিউ’র আয়োজনের ফাঁকে ফাঁকে আমি কথা বলি বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক এর সাথে, কথা বলি বাগান শ্রমিকের স্বার্থ স্লশিষ্ট বিষয়ে। কথার মাধ্যমে উঠে আসে চা শ্রমিকের সুবিধার বিষয়াবলী যেমন, চা শ্রমিকের জন্য আবাসন সুবিধা, রেশন সুবিধা, চিকিৎসা সুবিধা, চা শ্রমিক সন্তানদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা ও উৎসব পার্বণে সহযোগীতা। এবং উঠে আসে চা শ্রমিকের বেতনাদি বিষয়গুলি। স্বিকার করা হয় বেতন তুলনামূলক কম হলেও জীবন যাপনের অন্যান্য সুযোগগুলো চা বাগান কর্তৃপক্ষ থেকে প্রদান করা হয়। অভিযোগ আসে চা-শ্রমিকদের কাজের একাগ্রতার অভাব ও পেশাদারিত্বের অভাবের কথা। তবে চা বাগানের সিবিএর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে এবং এরা শ্রমিকদেও অধিকার আদায়ের ব্যাপারে সচেতন। আমার সার্বিক পর্যবেক্ষণে মনে হয়, চা শ্রমিক সন্তানদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির বেশ ঘাটতি রয়েছে, রয়েছে মান সম্পন্ন শিক্ষার অভাব। ঐ রাতে আমরা বার বি কিউ’র আয়োজন শেষ করে ঘুমাতে চলে যায়। এবং শান্তির একটি ঘুম দেই। 

পরের দিন সকালে (২৬ ডিসেম্বর ২০১৮) ঘুম থেকে উঠে বাংলোর আশপাশ দেখতে বের হই। বাংলো থেকে বাহির হতে চোখে পড়ল একটি  স্মৃতি স্তম্ভ। আমি আগ্রহ ভরে সেই স্মৃতি স্তম্ভ এর নিকট যাই, গিয়ে দেখি সেখানে রয়েছে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি ও ইতিহাস সমৃদ্ধ বেশ কয়েকটি দলিল। 
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মতে এই বাংলোটি মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সেনা দপ্তর। ৪ঠা এপ্রিল ১৯৭১ সালে এই বাংলোতে প্রথম সেনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে কর্ণেল মোহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানিকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক মনোনিত করে দেশটিকে চারটি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে সেক্টর কমান্ডার নির্বাচন করা হয়। মেজর কে এম সফিউল্লার নেতৃত্ব প্রায় ২০০০ সদস্যকে এই বাগানে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকহানাদার বাহিনীর অনেকগুলো গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে অনেক সৈনিক ও মুক্তিবাহিনীর সদস্য শাহাদৎ বরণ করেন। তাই এই চা বাগান ও বাংলোটি মহান মুক্তিযুদ্ধেও ইতিহাসে স্মরনীয় হয়ে আছে। আমি ও আমার পরিবার এই স্মৃতি স্তম্ভ এর সামনে গিয়ে নিরবে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে শ্রদ্ধ ও কৃতজ্ঞ ভরে স্মরণ করি সেই সমস্ত মহান মুক্তিযোদ্ধাদের যাদের প্রাণের বিনিময়ে পেয়েছি একটি স্বাধীন বাংলাদেশ। আমি এই গেীরবজজ¦ল ইতিহাসের কথা আমার মেয়েকে (ফাইযা) জানায়। সে খুব আগ্রহ ভরে মুক্তিযুদ্ধের কথা ও মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের কথা শুনে এবং তাদের জন্য দোয়া করে। 

পরবর্তীতে আমরা বাংলোতে ফিরে আসি এবং সকালের নাস্তা সম্পন্ন করি। নাস্তা শেষ করে আমরা সবাই বের হয়ে পরি চা বাগানের সৌর্ন্দয উপভোগ করার জন্য। প্রথমে আমরা চলে যায় সীমান্ত নীকটবর্তী স্থানে যেখানে নেই কোন কাটাতারের বেড়া। সেই স্থান থেকে আমরা বাংলাদেশ আর ভারতের সীমান্ত সৌর্ন্দয উপভোগ করলাম। 
চা বাগান যেন দুই দেশকে এক করে দিয়েছে। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। সবুজ কার্পেট যেন দুই দেশের সেতু বন্ধনের আচ্ছাদন। সীমান্ত আর চা বাগান এর সৌর্ন্দয উপভোগ করে আমরা রওনা দেই সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান দেখতে। গাড়ি থেকে আমরা সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান এর সৌর্ন্দয অবলোকন করি। যেখানে রয়েছে সাড়ি সাড়ি উচুঁ বৃক্ষ, লতা ও গুল্মের সমাহার। মাঝে মধ্যে চোখে পড়ছে বানরের ঝাকঁ। বানরের শব্দে ভাঙ্গছে বনের নীরবতা । প্রকৃতি এখানে উদার, মাঝে মাঝে বনের চুড়া দিয়ে উড়ে যাচ্ছে এক ঝাঁক সাদা বক। এক অপরুপ সৌর্ন্দয়ের আধার যেন সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। প্রায় আধা ঘন্টা সময় ধরে গাড়ি চেপে আমরা সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে আবার তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে ফিরে আসি। এখন মিশন শুরু করি পাহাড়ি ছরা দেখার। 

তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে প্রায় ১.৫ থেকে ২ কিমি. উত্তর পূর্বে হল এই পাহাড়ি ছরার অবস্থান, যার উৎস হল সীমান্ত তীরবর্তী পাহাড় সমূহ থেকে। শুস্ক মৌসুমে এই ছরায় টাকনু থেকে হাটু সমান পানি থাকে। আমরা ছরার নিকট পৌছার আগ থেকেই ছরার ছল ছল শব্দ শুনতে পেলাম। যা মনের ভিতর বিশেষ ছন্দ তৈরী করল। ছরার কাছে গিয়ে সবাই ছড়ায় নেমে পড়লাম। ছরার উপর দিয়ে আমরা হাটতে শুরু করলাম। আমার মেয়ে তাতে খুব আনন্দিত অনুভব করল। ছরার ¯্রােতের প্রতিকূলে আমরা প্রায় মাইল খানেক হাটলাম। চারদিকে উচুঁ উচুঁ টিলা আর মাঝে ছরা এই মধ্যে আমরা হাটছি এই যেন বিশেষ অনুভূতি যা লিখে প্রকাশ করার মত নয়।
ছরার সৌর্ন্দয উপভোগ শেষে আমরা বাংলো’র উদ্দেশ্যে রওনা দেই। দেখতে দেখতে অনেক বেলা গড়াল এইবার যাবার পালা। বাংলোতে পৌছে গিয়ে দেখি বেয়ারা আমাদের জন্য দুপুরের খাবার প্রস্তত রেখেছে। খাবারে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ আর মেন্যুতে রয়েছে দেশীয় সব খাবার। যেমন ছোট মাছে, মাগুর মাছ, আইর মাছ ও রুই মাছ আর ও রয়েছে মাংস। আমরা সারাদিন ঘুরাঘুরি করে বেশ ক্ষুধার্ত সবাই খুব মজা করে পেট ভরে খেলাম। খাবার শেষে আমরা সবাই চা খেলাম, এই চা দোকনে কেনা চা থেকে অনেক ভিন্ন। এক কাপ চা খাবার পর আমাদের সবার ক্লান্তি যেন ঘুচিয়ে গেল। এবার বিদায় জানানোর পালা।

যার কথা না বললে এই ভ্রমন কাহিনী অতৃপ্ত থেকে যাবে তিনি হলেন এই চা বাগানের বড় মালিক (ব্যবস্থাপক) মহোদয়। উনার আতিথিথেয়তা, সহজ সরলতা, নেতৃত্ব, ব্যবস্থাপনা, ব্যক্তিত্ব সবই আমার কাছে অতুলনীয় মনে হয়েছে। মধ্য বয়সী একটি লোক কিভাবে যেন মন্ত্র মুগ্ধেও মত এত বড় একটি বাগান সুদৃড় ভাবে ম্যানেজ করছেন। উনার জনপ্রিয়তা ও নেতৃত্বের গুনাবলী চোখে পড়েছে বড় দিবস উদযাপনে শ্রমিকদের মাঝে নিজেকে এবং উনার বেগমকে মিশে যেতে। আমাদের প্রত্যেকটা ইভেন্ট ভিজিটে উনি এবং উনার অধীনস্থ সহকর্মীরা উপস্থিত থেকে আামাদের সঙ্গ দিয়েছেন। আমরা সত্যিই বাগান ব্যবস্থাপক ও উনার অধীনস্থ সহকর্মীদের নিকট কৃতজ্ঞ। আর বাগান ব্যবস্থাপক  এর সহ-ধর্মীনি (আপা’র) কথা  না বলেলেই নয়, এই আয়োজন প্রক্রিয়ার প্লান থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে সুনিপুন তদারকি করেছেন, যার ফলে আমরা সবাই এই ভ্রমনটিকে উপভোগ করেছি। 

ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি আমাদের বড় আপা (পারভিন আপা) ও দুলাভাই (নাজমুল ভাই) কে, উনারা আয়োজন প্রক্রিয়ায় চালিকা শক্তি ও নিয়ামকের ভূমিকা পালন করার জন্য। উনাদের উদ্যেগ না হলে এই ভ্রমন অসম্ভ হত। আমরা প্রায়ই তিন ঘন্টা’র মধ্যে সিলেট শহরে প্রবেশ করি ও একটি সুন্দর ভ্রমনের ইতি টানি। ভবিষৎ সময় ও সুযোগ ফেলে আবার বেরাতে যাব হবিগঞ্জের, মাধবপুর উপজেলার, তেলিয়াপাড়া চা বাগানে।