বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট, ২০২৩

লাইফ ইজ বিউটিফুল

তুমি হারবে, তারপরেও তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। 

আমরা প্রায়ই আমাদের সন্তানদের বলি " জিততে তোমাকে হবে, তোমাকে প্রথম হতে হবে, জিপিএ গোল্ডেন ফাইভ পেতে হবে, মেডিকেল চান্স পেতে হবে, বুয়েটে চান্স পেতে হবে, নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে হবে, ভালো চাকরি করতে হবে "। তাকে কখনও বলিনা, তুমি হারতেও পারো। জিতে যাওয়া মানেই জীবন না, হেরে যাওয়ার মধ্যেও থাকে বেঁচে থাকার আনন্দ। তুমিও তো রক্ত মাংসেরই মানুষ, তোমারও ক্লান্ত লাগবে। একটু বসো। সবসময়ই উঠে দাঁড়ানোর দরকার নাই। সবসময়ই দৌড়ানোর দরকার নাই। একটু বিশ্রাম করো। কথাটি কেউ বলি না। বলি না বলেই, অনেক ছেলেমেয়ে ঝুলে পড়ে। কেউ রিলেশনশিপের জন্য, কেউ টাকার জন্য, কেউ ক্যারিয়ারের জন্য, কেউ রেজাল্ট বা সিজিপি'র জন্য, কেউ বা একটুখানি ভালোবাসার জন্য।


হেলাল হাফিজ এক বুক কষ্ট নিয়ে লিখেছিলেন,

কেউ বলেনি,

ক্লান্ত পথিক,

দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে জিরিয়ে নিও...


মা বাবা, শিক্ষক, গার্জিয়ান, বন্ধু, সমাজ, পৃথিবী, আপনাদের সবার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, সন্তানদের জিতে যাওয়ার মোটিভেশন দেন, সমস্যা নাই। কিন্তু হেরে যাওয়াদের কথাও একটু বলবেন, স্মরণ করিয়ে দিবেন, পৃথিবীতে সবাই জিততে আসে নাই। সবার জেতার দরকারও নাই। হেরে যাওয়াটা খুব  স্বাভাবিক। কিন্তু এই পৃথিবীতে সবাই বাঁচতে আসছে। সবার বাচাঁর অধিকার আছে,  জীবনটা একবার সেটাকে উপভোগ করতে হবে। Life is beautiful. এই পৃথিবীর আলো বাতাস, জল বা জোছনায় হেরে যাওয়া মানুষের যেমন অধিকার জিতে যাওয়া মানুষেরও অধিকার  আছে। সবার সমান অধিকার

সফলতার পরিমাপক কি ও এর নিয়ন্ত্রক কে!

সফলতা বা সাফল্য আসলে কি? ভাল রেজাল্ট, ভাল চাকুরী, অনেক ডিগ্রী, অনেক নামযশ, অনেক প্রতিপত্তি, ভাল পার্টনার, সুখের সংসার, কোনটা সাফল্যের পরিমাপক!

যিনি সফল হতে পারেনি তাহলে তার সফলতার নিয়ন্ত্রক কে! ব্যার্থ মানুষরা যেহেতেু তাদের ব্যার্থতা নিয়ে লেখেন না, তাই তাদের কথা কেউ জানতে পারি না। সবখানে কেবল সফলদের জয়জয়কার। কিন্ত আমার কাছে মনে হয় সফলতার সংজ্ঞাটি আপেক্ষিক, নিয়ন্ত্রিত ও পূর্ব-নির্ধারিত। কারণ, আমি দেখছি,  সর্বোচ্চ সফল পেশায় থাকা মানুষটিকে দুঃখ করতে, অতি সুখী দম্পতিকে দেখেছি নিঃসন্তানের যন্ত্রণায় কাদঁতে, সফল যুগলকে দেখেছি ডিভোর্স হতে, উচ্চশিক্ষিত স্মার্ট তরুন ও সুন্দরী তরুনীকে দেখেছি পার্টনার না খুঁজে পেয়ে চিরকুমার বা চিরকুমারী থেকে যেতে, আবার ব্যাক বেঞ্চার মানুষটিকেও সাফল্যের চুড়ায় উঠতে দেখেছি, সাধারণ ছেলেটি বা মেয়েটির  অত্যন্ত ভালো পার্টনার ও সুখের জীবন পার করতে।

আসলে মানুষের জীবনে সুখ, সফলতা, ভাল পার্টনার, এসব কিছু  কিন্তু সৌন্দর্য্য, মেধা, ভাল ক্যারিয়ার এসবের উপর নির্ভর করেনা। একসময় সবচেয়ে পিছিয়ে যাওয়া মানুষটিও এগিয়ে যেতে পারে। আবার সবচেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষটিও দিন শেষে ব্যর্থ হতে পারে।

ভালো বেতনের চাকুরী বা বিদেশে সেটেল হওয়া মানেই এইনা সে সবচেয়ে সফল ব্যাক্তি, সবচেয়ে সুন্দরী  বা সুদর্শন হওয়া মানেই এইনা যে সে ভাল পার্টনার পাবে। ফার্স্ট স্টুডেন্ট হওয়া মানে এইনা সে সবচেয়ে ভাল চাকরী পাবে।

জীবনের এই প্যারামিটারগুলোর উপর ভিত্তি করে আমরা সফলতা পরিমাপ করতে যাই। অথচ জানি না এই প্যারামিটারগুলো ফিক্সড হওয়া মানেই যে সে সফল হবে তার নিশ্চয়তা নেই। কারণ এর নিয়ন্ত্রন আমাদের হাতে নেই। কারণ তার সাথে জড়িত রয়েছে তাকদীর বা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ভাগ্য। ইসলামে তাকদীরের ওপর বিশ্বাস করা আল্লাহ তা'আলার রবুবিয়াত বা প্রভুত্বের ওপর বিশ্বাস করার অন্তর্ভুক্ত এবং তা ঈমানের ছয়টি রুকনের অন্যতম একটি রুকন।

মানুষের ভালো মন্দ যা কিছু হোক তা সবই আল্লাহর হুকুমে হবে। দুনিয়ায় ভালো কিছু পাওয়া গেলে আত্মহারা বা অহংকারী হয়ে যাওয়া যাবে না আবার কোন বিপদ আপদে পড়লে হতাশ হওয়া যাবে না। বিশ্বাস করতে হবে আল্লাহর ইচ্ছা ও জ্ঞান অনুযায়ী সে ফল পেয়েছে, নিশ্চয় এর মধ্যে কোনো কল্যাণ নিহিত রয়েছে। কাজেই ব্যার্থ হলে হতাশ না হয়ে নিজের কর্মের ভুলগুলো সারিয়ে নতুন করে তৈরি হতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে, ফলাফলের দায়িত্ব আল্লাহর উপর ছেড়ে দিতে হবে। কারন আল্লাহপাকই সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী।

শুক্রবার, ১২ মে, ২০২৩

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ইপসা’র ৩৮ বছর

দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বেসরকারি সমাজউন্নয়নমূলক সংস্থার কার্যক্রমকে উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণণা করা হয়। বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়ন, সীমিত সম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণে বেসরকারি সমাজউন্নয়নমূলক সংস্থার ভূমিকা অপরিসীম। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীতে যুদ্ধবিধস্ত রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্র যেমন এগিয়ে আসে তেমনি ত্রাণ ও পুনবার্সন কার্যক্রমে বেসরকারিভাবে কর্মকান্ড চলতে থাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। ত্রাণ ও পুনবার্সন কার্যক্রম শক্তিশালী করার জন্য ১৯৭২ সালে গঠিত হয় ব্রাক। এরপর ১৯৭৬ সালে প্রশিকা ও গ্রামীণ ব্যাংক গঠিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠান ত্রাণ পুনবার্সনের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়ননে গুরুত্বারোপ করে। আশির দশকে বেসরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রম ইস্যুতে পরিবর্তন আসে। তার প্রেক্ষাপটের কারণ ছিল সামরিক শাসন ও সকল স্তরে সামরিকায়নের ফলে ঐ সময় দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে দুর্দশা তৈরি হয়। এই অবস্থার থেকে উত্তরণের জন্য তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশে বেশ কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও ‍সিভিল সোসাইটির জন্ম নেয়, তাদের মধ্যে ইপসা (ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল এ্যাকশান) অন্যতম।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯০ সালকে “যুব দশক” ও ১৯৮৫ সালকে “আন্তর্জাতিক যুব বর্ষ” ঘোষনা করে। উন্নয়ন ও মানবিক কর্মসূচীতে যুবকদের সম্পৃক্ত করতে ব্যাপক প্রচারনার ব্যবস্থা নেয়া হয়। এমনি প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার কয়েকজন সমাজ সচেতন যুবক ইপসা’র প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নির্বাহী মোঃ আরিফুর রহমানের নেতৃত্বে একটি উন্নয়ন সংগঠন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এলাকার যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করে। আর এভাবেই “১৯৮৫ সালের ২০ মে” সচেতন যুবকদের সক্রিয় উদ্যোগে সমাজ উন্নয়ন সংগঠন “ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল এ্যাকশন (ইপসা)’র পদযাত্রা শুরু হয়। কালের পরিক্রমায় ও সময়ের সাথে পালা দিয়ে ইপসা (ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল এ্যাকশন) বিশ্বস্ততা অর্জন করে লক্ষিত জনগোষ্ঠির ও নিবন্ধন লাভ করেন বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের, আস্থা অর্জন করে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার। ইপসা’র ভিশন হলো “এমন একটি দারিদ্রমুক্ত সমাজ যেখানে সকলের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে।” তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে সংগঠিত করে বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নে কাজ করে যাচ্ছে ইপসা। দেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাড়া প্রদান ও পুনবার্সন, পরিবেশ সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা, স্বাক্ষরতা হার বৃদ্ধি, শিক্ষার মান উন্নয়ন, স্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা, কোভিড-১৯ সাড়া, শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা, যুবদের ক্ষমতায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শোভন কর্মপরিবেশ সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, মূলধন গঠন, জাতীয় আয় বৃদ্ধি, বলপূর্বক স্থানচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের মানবিক সাড়া প্রদান ও শিশু, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে ইপসা। ১৯৮৫ সালে ইপসা তার যাত্রা শুরু করে বর্তমানে প্রায় ০৩ হাজার কর্মী সারাদেশে ১৪ মিলিয়ন মানুষের জীবন সংগ্রামে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

ইপসা’র মূল্যবোধ

  • দেশপ্রেম এবং জাতীয় স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় গৌরবের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা
  • ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা
  • পারষ্পরিক শ্রদ্ধা এবং জেন্ডার বান্ধব মনোভাব সম্পন্নতা
  • মান সম্পন্নতা এবং উৎকর্ষতা
  • বিনম্রতা এবং আত্মবিশ্বাস
  • বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ
  • পরিবেশ এবং প্রতিবেশের প্রতি সহমর্মিতা

সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্য
  • পারিবারিক পরিবেশ
  • দায়িত্ব সচেতনতা
  • ব্যয়সাশ্রয় নীতি
  • গঠনমূলক সমালোচনা ও সংস্থার পরিচিতি প্রসার
  • বিভিন্ন জাতি ধর্ম ও বর্ণ’র সাম্য ও সমপ্রীতি
  • সুস্থ বিনোদন
ইপসা’র কার্যক্রমঃ
ইপসা’র কার্যক্রমকে ছয়টি থিমে ভাগ করা হয়, যথা;
  • শিক্ষা
  • স্বাস্থ্য
  • পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন
  • অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন
  • মানবাধিকার ও সুশাসন
  • দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও মানবিক সাড়া প্রদান
উক্ত উন্নয়ন থিমের আওতায় বর্তমানে ইপসা’র সকল উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

লিংক অরগানাইজেশন সমূহঃ
  • আইসিটি এন্ড রিসোর্স সেন্টার অন ডিসএ্যাবিলিটিস (আইআরসিডি)
  • ইপসা- সেন্টার ফর ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট (ইপসা-সিওয়াইডি)
  • ইপসা- ডেভেলপমেন্ট রিসোর্স সেন্টার (ইপসা-ডিআরসি)
  • ইপসা- পরিচালিত স্কুল সমূহ (এভারগ্রীন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, কাজী পাড়া শিশু নিকেতন ও আলেকদিয়া শিশু নিকেতন)
  • ইপসা মানব সম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্র (ইপসা এইচআরডিসি)
  • রেডিও সাগর গিরি এফ এম ৯৯.২
  • ইন্টারনেট রেডিও দ্বীপ
  • কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
সম্মাননা ও স্বীকৃতিঃ
সুদীর্ঘ ৩৮ বছরের পথচলায়, ইপসা জয় করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির বিশ্বস্ততা, সরকার ও দাতা জনগোষ্ঠির আস্থা। ইপসা তার কার্যক্রমের মাধ্যমে অবদান রাখছে স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা থেকে বৈশ্বিক লক্ষমাত্রা অর্জনে। তার স্বীকৃতিস্বরুপ স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অর্জন করে বেশ সম্মাননা ও স্বীকৃতি। নিম্নে বিশেষ কিছু সম্মাননা ও স্বীকৃতির নাম উল্লেখ করা হল;
  • তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিবন্ধী নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য ২০২১ সালে WSIS Prize অর্জন করে।  
  • দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পাঠ উপযোগী বই তৈরীর জন্য, ইপসা ২০২০ সালে  জিরো প্রজেক্ট এওয়ার্ড অর্জন করে। জাতিসংঘ সদর দপ্তর অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় এই এওয়ার্ড প্রদান করা হয়।
  • ২০২০ সালে ইপসা নয়া দিল্লি, ভারত থেকে  ই-এনজিও চ্যালেঞ্জ এওয়ার্ড অর্জন করে।
  • নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতকরনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়, চট্টগ্রাম ইপসাকে চট্টগ্রাম জেলায় শ্রেষ্ঠ বেসরকারি সংগঠন ২০২০ সম্মাননা প্রদান করে।
  • তামাক নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অবদান রাখার জন্য, তামাক বিরোধী জাতীয় প্লাটফর্ম ও পিকেএসএফ, ইপসাকে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ পদক ২০১৯ প্রদান করে।
  • ইপসা ২০১৮ সালে বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদক অর্জন করে।
  • সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তর কর্তৃক ইপসা ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে সেরা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা স্বীকৃতি সম্মাননা লাভ করে।
  • প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ডিজিটাল ক্ষমতায়নে ইপসা, ২০১৮ সালে ইউনেস্কো-আমির আল আহমেদ আল জাবের সম্মাননা লাভ করে (প্যারিস, ফ্রান্স)।
  • ইপসা ইনোভেটিব সার্ভিস ডেলিভারির জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিল বিকন এওয়ার্ড ২০১৭ অর্জন করে। 
  • ইপসা, দৃষ্টি ও পঠন প্রতিবন্ধী শিক্ষাথীদের রিডিং মেটেরিয়ালস তৈরীর স্বীকৃতিস্বরূপ ডব্লিউএসআইএস এওয়ার্ড অর্জন করে ২০১৭ সালে।
  • ইপসা ২০১০ সালে নয়া দিল্লি, ভারত হতে আর্ন্তজাতিক মন্থন এওয়ার্ড অর্জন করে ।
  • জাতিসংঘ এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (UN-ECOSOC) কর্তৃক কনসালটেটিভ স্ট্যাাটাস অর্জন করে ২০১৩ সালে ।
  • যুব ও উন্নয়ন কর্মসুচিতে অনবদ্য ভূমিকা রাখায়  ইপসা  ১৯৯৯ সালে আর্ন্তজাতিক যুব শান্তি পুরস্কার  অর্জন করে।
আমাদের বিশ্বাস ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ ‍ও অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণে ইপসা’র এই ধারা অব্যাহত থাকবে। সমাজের অসঙ্গতিগুলো নিরসনে ইপসা স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের কার্যক্রমগুলো চলমান রাখবে। একটি সাম্য, মর্যাদা ও ন্যায্যতার পৃথিবী বিনির্মাণে ইপসা’র এই ধারা অব্যাহত থাকুক, ইপসা’র ৩৮ বছর পূর্তিতে এটি আমাদের কামনা।


সোমবার, ১ মে, ২০২৩

শ্রমিকের কর্মপরিবেশটি যেন হয় পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকিমুক্ত, নিরাপদ ও মর্যাদাকর!

শ্রম ছাড়া উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণ সম্ভব নয়, শ্রমিকের মর্যাদা ছাড়া অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, শ্রমিকের ঝুঁকিমুক্ত পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ছাড়া উৎপাদনশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কর্মচারীরা একটি কোম্পানির বা প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও প্রাণশক্তি। যখন প্রতিষ্ঠানের একজন সদস্য অসুস্থ বা আহত হন, তখন তাকে সুস্থ করা প্রতিষ্ঠানের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়টি জনস্বাস্থ্য বিভাগের এমন একটি বিষয় যেখানে চাকুরীর বা পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মীর আঘাত বা অসুস্থতার প্রতিরোধ ও চিকিৎসার বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা করা হয়। পেশাগত স্বাস্থ্যের সাথে বেশ কিছু বিভাগ জড়িত, যেমন পেশাগত ওষুধ, নার্সিং, এরগনোমিক্স, মনোবিজ্ঞান, স্বাস্থ্যবিধি, নিরাপত্তা এবং অন্যান্য।

উল্লেখ্য যে, এখানে স্বাস্থ্য বলতে শুধু রোগবালাই না হওয়াকে বোঝানো হয় না, বরং স্বাস্থ্য বলতে সামগ্রিক স্বাস্থ্য, অর্থাৎ দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক, আর্থিক স্বাস্থ্যকে বোঝানো হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়টির প্রধান কাজ হলো কর্মক্ষেত্রে যেকোনও ধরনের ঝুঁকি বা সম্ভাব্য বিপদ প্রতিরোধ করা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর মতে পেশাগত স্বাস্থ্য হল সমস্ত পেশায় নিয়োজিত কর্মীদের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতার সর্বোচ্চ স্তরের প্রচার এবং রক্ষণাবেক্ষণ। এবং পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ ও মানুষের সাথে কাজের পরিবেশের অভিযোজন। সর্বোপরি, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরপত্তা বিষয়টি কর্মীদের স্বাস্থ্য এবং তাদের কাজের পরিবেশ সম্পর্কিত নির্দেশিকা এবং নিয়মগুলির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এটি নিয়োগকর্তাদের সকল কর্মচারীদের জন্য একটি নিরাপদ কাজের পরিবেশ প্রদান করতে সচেষ্ট করে।

কর্মীর পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা লক্ষে বাংলাদেশ সরকার শ্রম আইন ২০০৬ প্রণয়ন করছেন ও তা বাস্তবায়ন করছেন। এই আইনের ৫১ হতে ৯৯ ধারাসমূহে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। তাছাড়াও বৈশ্বিকভাবে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে প্রতি বছর ২৮ এপ্রিল আন্তর্জাতিক পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবস ও ১মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালন করা হয়ে থাকে।  তাছাড়াও অন্যান্য আইন ও আন্তর্জাতিক সনদে এই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করা হয়েছে। এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি’।

কর্মপরিবেশে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার মূল উদ্দেশ্যঃপেশাগত স্বাস্থ্যে ও নিরাপত্তার মূল উদ্দেশ্য হল কর্মীদের জন্য একটি নিরাপদ এবং আস্থার পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং কাজের সাথে সম্পর্কিত অসুস্থতা বা আঘাতের ঝুঁকি হ্রাস করা। প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ প্রদানের আইনত বাধ্যতামূলক রয়েছে, এবং এটি শুধুমাত্র সঠিক পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক পলিসির প্রতিষ্ঠা, বাস্তাবায়ন, অরিয়েন্টশন এবং নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমেই সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার মূল উদ্দেশ্য হলঃ

• শ্রমিকের স্বাস্থ্য এবং কাজের ক্ষমতা রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রচার;

• কাজের অবস্থার উন্নতি এবং কর্মপরিবেশ স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী;

• নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত;

• কর্মক্ষেত্রে কাজের সামগ্রিক অবস্থা নিরীক্ষণ এবং উন্নতির সুযোগ সন্ধান;

• অসুস্থ বা অসুস্থতার কারণে দীর্ঘ সময়ে কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত কর্মীকে সহায়তা;

• কর্মীর শারীরীক সুস্থতার পাশাপাশি সামাজিক, আর্থিক ও মানবিক মর্যাদা প্রসিষ্ঠা;

• যে সমস্ত কর্মীরা কর্মক্ষেত্রে বা বাড়িতে মানসিক চাপে রয়েছেন তাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান;

• শ্রমিকদের কল্যাণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের স্থায়ীত্বশলতা আনয়ন;

• আন্তর্জাতিক মানদন্ড, প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকা ও গ্রাহকের সন্তুষ্টি অর্জনে।

পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বজায় রাখার সুবিধাঃ কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিধিবদ্ধ এবং নৈতিক বাধ্যবাধকতা ছাড়াও আরো অনেকগুলো কারণে এটি গুরুত্বপূর্ণ। কোন কারণে এটি করতে ব্যর্থ হলে সংস্থা এবং কর্মচারী/কর্মকর্তা ভয়ের জন্যই ক্ষতির কারণ হবে।

কর্মক্ষেত্রে কর্মীর মনোবল বৃদ্ধির জন্যঃ কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের মনোবল বজায় রাখা পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিধান খুব গুরুত্বপূর্ণ। পেশাগত স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে, কর্মীরা সংস্থার ভিতরে নিজেকে নিরাপদ ও মূল্যবান/গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। যার ফলে কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে একই প্রতিষ্ঠানে তৃপ্তির সাথে কাজ করে ও সংস্থার উৎপাদনশীলতা বাড়ায়।

সংস্থার সুনাম ও খ্যাতির জন্যঃ কর্মীর পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বজায় রাখলে কোম্পানির সুনাম ও খ্যাতি বৃদ্ধি পায়। আজ, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ইউজারে মুখের কথা কোম্পানির সুনাম ও খ্যাতির ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একজন গ্রাহক থেকে একজন কর্মচারী যে কেউ, সোশ্যাল মিডিয়ায় পর্যালোচনা/রিভিউ লিখতে বা তাদের মন্তব্য সামাজিক মিডিয়া প্রোফাইল আপডেট করতে পারে। আপনার কোম্পানি যদি পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত পরিমাণে বিনিয়োগ করে, তাহলে এর খ্যাতি বাড়বে।

নতুন সুযোগের সন্ধান লাভ করার জন্যঃ কর্মীর পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রতিষ্ঠান অনেক নতুন সুযোগ আনলক করে। যা সাফল্যের জন্য সংগঠনকে সেট আপ করে।

বিশ্বস্ততা অর্জন ও প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্যঃ কর্মীর পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রতিষ্ঠান গ্রাহক, কর্মচারী ও স্টেকহোল্ডারদের (সরকারি, বেসরকারি, দাতা সংস্থা) কাছে বিশ্বস্ততা অর্জন করে। যার ফলে নতুন কোন সুযোগ আসলে ঐ প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সুযোগটি সহজে লাভ করে।

পেশাগত দুর্ঘটনা পেশাগত ব্যাধির পরিচয়ঃ কর্মরত অবস্থায় অথবা ব্যবসার প্রয়োজনে কর্মস্থলের বাইরে অবস্থানকালে সংঘটিত কোন দুর্ঘটনায় শ্রমিক জখম প্রাপ্ত হওয়ার ঘটনায় পেশাগত দুর্ঘটনা। মানুষের আচরণগত প্রদান ও পরিবেশগত উপাদান দুর্ঘটনার নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। কর্মক্ষেত্রে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক বস্তু, ধুলি, ধোঁয়া, বা ক্ষতিকর কোন জৈব উপাদানের সংস্পর্শে দীর্ঘদিন যাবত কাজ করার ফলে শরীরে যে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তাই পেশাগত রোগ বা ব্যাধি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের শ্রম আইনে এমন ৩৩ প্রকার স্বাস্থ্য সমস্যাকে পেশাগত ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পেশাগত ব্যাধির বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে যা নির্ণয় হয় কাজের ধরন ও কাজের পরিবেশের উপর। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) পেশাগত ব্যাধির একটি তালিকা প্রকাশ করেছে এই তালিকাটিতে তিনটি ক্যাটাগরিতে পেশাগত ব্যাধির ধরন নির্ণয় করা হয়েছে;

১. কর্মীর কর্ম পরিবেশের উপর ভিত্তি করে (এজেন্ট ভিত্তিক); 
শারীরিক এজেন্ট (ফিজিক্যাল)  দ্বারা সৃষ্ট রোগঃ শব্দের কারণে শ্রবণ প্রতিবন্ধকতা; আয়নাইজিং বিকিরণ দ্বারা সৃষ্ট রোগ; লেজার সহ অপটিক্যাল (আল্ট্রাভায়োলেট, দৃশ্যমান আলো, ইনফ্রারেড) বিকিরণ দ্বারা সৃষ্ট রোগ; অত্যধিক তাপমাত্রার সংস্পর্শে আসার ফলে সৃষ্ট রোগ ইত্যাদি।

জৈবিক এজেন্ট (বায়োলজিক্যাল) এবং সংক্রামক বা পরজীবী দ্বারা সংঘটিত রোগঃ ব্রুসেলোসিস, হেপাটাইটিস ভাইরাস, হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি), টিটেনাস, যক্ষ্মা, অ্যানথ্রাক্স, কোভিড-১৯, লেপ্টোস্পাইরোসিস ইত্যাদি।

রাসায়নিক এজেন্ট (কেমিক্যাল) দ্বারা সৃষ্ট রোগ: ক্যাডমিয়াম, বেরিলিয়াম, ফসফরাস, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, পারদ, সীসা, ফ্লু ইউরিন বা এর যৌগ দ্বারা সৃষ্ট রোগ। কীটনাশক, অ্যামোনিয়া ও অন্যান্য কেমিক্যাল এজেন্ট দ্বারা সৃষ্ট রোগসমূহ।

২. টার্গেট অরগান সিস্টেম এর উপর ভিত্তি করে;
শ্বাসযন্ত্রের রোগ (নিউমোকোনিওসিস, ব্রংকাইটিস, অ্যাজমা/হাঁপানি ইত্যাদি); 
ত্বকের রোগসমূহ (এলার্জি, বিরক্তিকর যোগাযোগ ডার্মাটাইটিস, ভিটিলিগো ইত্যাদি); 
Musculoskeletal ডিসঅর্ডারস (রেডিয়াল স্টাইলয়েড টেনোসাইনোভাইটিস, ক্রনিক টেনোসাইনোভাইটিস, এপিকন্ডাইলাইটিস ইত্যাদি); 

৩. মানসিক এবং আচরণগত ব্যাধি (দুর্ঘটনা পরবর্তী মানসিক বৈকল্য, অন্যান্য মানসিক বা আচরণগত ব্যাধি);

৪. পেশাগত ক্যান্সার; নিম্নলিখিত এজেন্ট দ্বারা ক্যান্সার (অ্যাসবেস্টস, ক্রোমিয়াম, ভিনাইল ক্লোরাইড, আয়নাইজিং বিকিরণ, কোক ওভেন নির্গমন, কাঠের ধুলো, ক্যাডমিয়াম) সংঘটিত হয়।

উল্লেখযোগ্য পেশাগত ব্যাধির নাম ও কারণঃ উল্লেখযোগ্য পেশাগত ব্যাধির নাম ও কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হলে; এই তালিকাটি সিডিসি, সিসিওএইচএস, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর অকুপেশনাল হেলথ অ্যান্ড সেফটি (এনআইওএসএইচ), আইএলও এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের জন্য ইউরোপীয় সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে তৈরী করা হয়েছে।

ডার্মাটাইটিসঃ পেশাগত ব্যাধির মধ্যে চর্ম জনিত রোগ (অ্যালার্জিক এবং বিরক্তিকর ডার্মাটাইটিস) অন্যতম। এক রিপোর্টে দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেশাগত ব্যাধির ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হল চর্ম জনিত রোগ যা বিস্তৃত ঘটে শারীরিক, জৈবিক বা রাসায়নিক এজেন্টের মাধ্যমে। এই রোগ রোগীর দেহে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।

শ্বাসযন্ত্রের রোগঃ শ্বাসযন্ত্রের রোগ এর মধ্যে অ্যাজমা, ফুসফুসের রোগ এবং ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD) অন্যতম। OHCOW-এর মতে, হাঁপানি কানাডায় সবচেয়ে বেশি পেশাগত ফুসফুসের রোগ হিসেবে বিবেচিত । OHCOW বলে যে কর্মক্ষেত্রে ৩০০ টিরও বেশি রাসায়নিক বস্ত/দ্রব্য রয়েছে যা হাঁপানির কারণ হিসাবে পরিচিত। এই রোগটি গাড়ির যন্ত্রাংশ, ফোম এবং প্লাস্টিক উত্পাদন শিল্পে শ্রমিকদের বেশি সংক্রমিত করে। 

Musculoskeletal Disoders (MSDs)ঃ পেশাগত ব্যাধিরক্ষেত্রে এমএসডি (কারপাল টানেল সিন্ড্রোম বা টেন্ডোনাইটিসের মতো পুনরাবৃত্তিমূলক স্ট্রেন ইনজুরির (RSI)) অন্যতম। সাধারণত যারা অফিসিয়াল এনভায়রনমেন্টে (ডেস্কে) কাজ করেন তারা এই ব্যাধির শিকার হউন। এমএসডি বিকাশ লাভ করে অতিরিক্ত কাজের চাপ, একটানা কাজ করলে, সঠিকভাবে বিশ্রাম না নিলে, ক্রটিপূর্ণভাবে বসার ফলে।
শ্রবণ ক্ষমতার হ্রাসঃ একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে খনি, নির্মাণ এবং উত্পাদন শিল্পে শ্রমিকরা এই সমস্যার সম্মুখীন হন। শ্রবণশক্তি হ্রাস এবং শ্রবণশক্তির সমস্যাগুলি আতিথেয়তা এবং স্বাস্থ্যসেবা সেটিংসেও একটি বড় সমস্যা।

ক্যান্সারঃ  বিশ্বব্যাপী কর্ম সংক্রান্ত মৃত্যুর ২৪ শতাংশের জন্য দায়ী করা হয় ক্যান্সারকে। পেশাগত ক্যান্সার হয় যখন কর্মীরা তাদের কর্মক্ষেত্রে কার্সিনোজেনিক পদার্থের সংস্পর্শে থাকে। কার্সিনোজেন প্রাকৃতিকভাবে পরিবেশে ঘটতে পারে (যেমন সূর্যালোকে অতিবেগুনী রশ্মি এবং নির্দিষ্ট কিছু ভাইরাস) অথবা মানুষের দ্বারা উৎপন্ন হতে পারে (যেমন অটোমোবাইল এক্সস্ট ধোঁয়া এবং সিগারেটের ধোঁয়া)। অ্যাসবেস্টস-সম্পর্কিত রোগগুলি এখন পেশাগত ব্যাধির সবচেয়ে সুপরিচিত। এর মধ্যে রয়েছে ফুসফুসের ক্যান্সার, গ্যাস্ট্রো-অন্ত্রের ক্যান্সার, স্বরযন্ত্রের ক্যান্সার এবং মেসোথেলিওমা (একটি ক্যান্সার যা বেশিরভাগ অভ্যন্তরীণ অঙ্গকে আবৃত করে টিস্যুর পাতলা স্তরে ঘটে)।

স্ট্রেস এবং মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধিঃ মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাধিগুলিকে পেশাগত রোগ হিসাবেও বিবেচনা করা হয়। স্ট্রেস এবং মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধির মধ্যে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য। সাধারণত, সামরিক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও উচ্চ পদে আসন্ন লোকেরা এই ব্যাধির শিকার হন।

সংক্রামক রোগঃ সাধারণত স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা হেপাটাইটিস বি এবং সি, যক্ষ্মা (টিবি) এবং এমনকি হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি) এর মতো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। আরও উল্লেখযোগ্য যে সামাজিক পরিষেবা কর্মীরা টিবি সংক্রমনের ঝুঁকিতে থাকে কারণ তারা উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ জনসংখ্যার সাথে ক্রমাগত যোগাযোগ করে। এবং ল্যাব কর্মীরা সংক্রামক রোগ আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে থাকেন।


পেশাগত স্বাস্থ্যের বিপদ ও ঝুঁকির সাথে পরিচয়ঃ কর্মক্ষেত্রে কর্মীর নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে হলে বিপদ এবং ঝুঁকি সম্পর্কে ধারনা থাকা আবশ্যক। বিপদ হলো কর্মপরিবেশের এমন একটি ত্রুটিপূর্ণ উপাদান বা অস্বাভাবিক অবস্থা বা পদ্ধতি যা দুর্ঘটনা ঘটানো, ক্ষতি করা বা পেশাগত ব্যাধির সৃষ্টির কারণ হতে পারে।  ঝুঁকি হলো কর্মপরিবেশের বিদ্যমান পরিমাপযোগ্য এমন কোন বিপদজনক অবস্থা বা উপকরণ যা ব্যবহারিক পক্রিয়ায় বা আপনা থেকেই দুর্ঘটনা বা ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেমন ভবনে ফাটল সৃষ্টি হওয়া একটি বিপদ, এরুপ ফাটলযুক্ত ভবনে কাজ করা উচ্চমাত্রার ঝুঁকি রয়েছে, যেসব মার্কেটে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নেই সেসব মার্কেটে অগ্নিদুর্ঘটনার উচ্চমাত্রার ঝুঁকি রয়েছে, আবার যেসব কর্মীরা নিরাপত্তা/সেফগার্ডিং নির্দেশিকা সম্পর্কে অবগত নয় তারা তাদের কর্মস্থলে ঝুঁকিতে রয়েছেন। করোনাভাইরাস বর্তমানে বিশ্বে একটি বিপদ হিসেবে কাজ করছে ভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে যিনি বা যারা সেবা দিচ্ছেন তুলনামূলক বেশি মাত্রায় তিনি বা তারা সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। তাই কর্মপরিবেশের বিপদ ও ঝুঁকি পরিমাপ/নির্ণয় করার মাধ্যমে কর্মীর নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব। এবং এই ঝুঁকি কমিয়ে আনা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা কর্মী, নিয়োগকর্তা, গ্রাহক, অংশীজনসহ সবার দায়িত্ব।

কর্মীর পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক আইনি কাঠামোঃ কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের সামগ্রী কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে অনেকগুলো আইন প্রবিধান নীতিমালা রয়েছে। এসব আইনে অন্যান্য বিষয়ের সাথে পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক বিধান সন্নিবেশিত হয়েছে। এ সকল আইন ও বিধি বিধানে তালিকা নিচে দেওয়া হল;
বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ 
বাংলাদেশ শ্রম ও বিধিমালা-২০১৫ 
বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০২০ 
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ 
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭ 
অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন আইন-২০০৩ 
অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন বিধিমালা-২০১৪
শিপব্রেকিং এন্ড রিসাইক্লিং অ্যাক্ট- ২০১৮ 
শিপব্রেকিং এন্ড রিসাইক্লিং রুলস-২০১১ 
জাতীয় শিল্পনীতি-২০১০ 
জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০
জাতীয় শ্রমনীতি-২০১২ 
জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি নীতিমালা-২০১৩ 

নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং শ্রমিকের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৭ অনুচ্ছেদ-১৪, অনুচ্ছেদ-২০ সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কনভেনশন ১৫৫, ১৮৭, ১৬১, প্রটোকল ১৫৫ এবং সুপারিশমালা ১৬৪ ও ১৯৭ কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে । এছাড়াও জাতিসংঘ ঘোষিত অভিবাসী শ্রমিক কনভেনশন ১৯০, সম্প্রতি ঘোষিত কনভেনশন ১৮৯ এবং সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা অন্যতম দলিল। তাছাড়া ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৬০ তম সম্মেলন Global Plan of Action of Workers Health 2008-2007 বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ৫টি উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল।

সর্বোপরি জাতিসঙ্ঘ ২০১৬ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের রোড ম্যাপ ঘোষণা করেছে। ইতোমধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য নির্ধারিত সময় সীমার দুই-তৃতীয়াংশ সময় অতিবাহিত হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টি লক্ষ্যের ৮ নম্বর লক্ষ্য হচ্ছে শোভন কাজ বাস্তবায়ন। শোভন কাজের অন্যতম শর্ত হচ্ছে কর্মক্ষত্রে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটঃ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ বলছে (২০১৬-১৭), দেশে মোট শ্রমশক্তি রয়েছে পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে কাজ করছে পাঁচ কোটি ৫১ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে বস্ত্র ও পোশাক খাতে কাজ করে ৪০ লাখ শ্রমিক। এই পরিসংখ্যানেও দেখা যায়, বিপুলসংখ্যক শ্রমিক পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশের শ্রম আইনে বলা হয়েছে, ৫০ অথবা এর বেশি কর্মী কাজ করে এমন সব প্রতিষ্ঠানে সমান সংখ্যক মালিক ও কর্মী প্রতিনিধিদের নিয়ে সেফটি কমিটি গঠনের কথা। পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি নীতিমালা প্রণয়ন, সেফগার্ডিং নীতিমালা প্রণয়ন, নীতিমালার অরিয়েন্টশন, প্রচার ও বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ। এই কমিটি, নীতিমালা কর্মক্ষেত্রের ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিবে, দুর্ঘটনা ঘটলে সাড়া দিবে, যাতে করে নিরাপদ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করা যায় ও ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায্যতা আদায় হয়। কিন্তু বাস্তবিকক্ষেত্রে অনেক প্রতিষ্ঠানে এই কমিটি ও নীতিমালা অনুপস্থিত যার ফলে কর্মীর পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত। দেখা যায় দুর্ঘটনার পর সবকিছু নেড়েছড়ে বসে, কিছুদিন পর আবার সবকিছু তলিয়ে যায় বা আপোষ হয়ে যায়। গত দশকে বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলিতে এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে,২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরিন ফ্যাশনসে আগুন,২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধস, ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াল অগ্নিদুর্ঘটনা,২০১৯ সালের ২৮ মার্চ দুপুরে ঢাকা, বনানির এফআর টাওয়ারে আগুন, ২০২৩ সালে ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটে আগুন ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। এসব কাঠামোগত দুর্ঘটনার পাশাপাশি অনেক মানবিক দুর্ঘটনাও ঘটে প্রতিষ্ঠানে যেমন, যৌন হয়রানি, শারিরীক অত্যাচার, মানসিক নির্যাতন, বোলিং, অবহেলা, নিপীড়ন, বৈষম্য ও শোষণ ইত্যাদি। এরকম অসংখ্য ঘটনা নিত্যনৈর্মিত্তিক ঘটে চলেছে যেগুলোর কারণগুলো খুব কাছাকাছি।  এমন দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি ও প্রানহাণির জন্য প্রধানত আমাদের অজ্ঞতা ও অসচেতনতাই দায়ী। আমরা একটু সচেতন হলেই অধিকাংশ সংঘটিত দুর্ঘটনা এড়াতে সক্ষম হতাম।  তাই আমি বলব, যথাযথভাবে কর্মক্ষেত্রের কাঠামো উন্নয়নের/নির্মাণ (ভবন নির্মাণ, এবং কারখানা ও রাসায়নিক গুদামের ঝুঁকিমুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ঝুঁকি নির্ণয়) ও কর্মস্থলে কর্মীর অধিকার ও মর্যাদা সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ ও নিরাপত্তা/সেফগার্ডিং পলিসি প্রণয়ন (জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সমন্বয় করে) ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সচেতন করে তুলতে পারলে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। নিশ্চিত করা সম্ভব কর্মীবান্ধব কর্মপরিবেশ, যেখানে সকলে অধিকার মর্যাদা নিয়ে কাজ করবে, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সুনাম, খ্যাতি ও স্থায়ীত্বশীলতা আনয়নে সচেষ্ট হবে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে আমার এই আহবান ও প্রত্যাশা। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়টি আজ অপরিহার্য।

রেফারেন্সঃ
https://www.dailynayadiganta.com/news/printarticle/744061
https://bn.approby.com
https://www.prothomalo.com/bangladesh/
https://mywage.org.bd/labour-laws/health-and-safety-at-work
https://bangla.bdnews24.com/opinion/comment/56004
https://www.who.int/health-topics/occupational-health#
https://www.ecoonline.com/glossary/occupational-health






বৃহস্পতিবার, ৯ মার্চ, ২০২৩

শক্তিশালী ভূমিকম্প আসন্ন; আমাদের প্রস্ততি ও করণীয়

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ ছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে, ভূমিকম্পের ঝুঁকির দিক থেকে বাংলাদেশ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশ ইউরেশিয়ান এবং ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেটের মধ্যে অবস্থিত। তাছাড়া বাংলাদেশে কিছু সক্রিয় সিসমিক ফল্ট রয়েছে যেমন সীতাকুণ্ড-টেকনাফ ফল্ট, রাঙ্গামাটি-বরকল ফল্ট, মধুপুর ফল্ট, সিলেট- আসাম ফল্ট ইত্যাদি। অতীতে এইসব ফল্ট বরাবর বহু ভূমিকম্প হয়েছে। সে জন্য ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা এই সব অঞ্চলকে ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে সতর্ক করেছেন। ১৮৯৭ সালে এই অঞ্চলে ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল যা, গ্রেট ইন্ডিয়া ভূমিকম্প নামে পরিচিত। এই ভূমিকম্পে সিলেট শহরের মারাত্মক ক্ষতি হয়, যেখানে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৪৫ এবং ধসে পড়ে বহু ভবন। সম্প্রতী তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমান্তে আঘাত হানা ভয়াবহ  ভূমিকম্পের ফলে জনে মনে আতংক দেখা দিয়েছে  ভূমিকম্প নিয়ে। তুরস্কের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭.৮। সেই ক্ষেত্রে তুরস্কের ভূমিকম্পকে আমাদের দেশে সংঘটিত ভূমিকম্পের তুলনায় ছোটই বলা চলে। ভূমিকম্পের রিটার্ন পিরিয়ড ধরা হয় ১৫০-২০০ বছর। সে হিসেবে সাইকেলটি এখনো ফিরে আসেনি। সেটি কখন হবে কেউ জানে না। আসলে ভূমিকম্পের পূর্বানুমান করা সম্ভব না। পরিসংখ্যানগত রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে যে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ফ্রিকোয়েন্সি বেড়েছে। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে ঘন ঘন হালকা কম্পন একটি সংকেত দেয় যে একটি শক্তিশালী কম্পন আসছে, যা সবার জন্য উদ্বেগের বিষয়। তার জন্য আমাদের আতংকিত না হয়ে প্রস্ততি নিতে হবে, ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকি বিষয়গুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা্ নিতে হবে। আমরা যদি পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারি তাহলে এসব দুর্যোগ মোকাবিলা করে টিকে থাকা ও ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা আমাদের জন্য অনেক সহজ হবে। তাই জাতীয় দুর্যোগ প্রস্ততি দিবসে এই হউক আমাদের প্রত্যয়, ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের এখনি প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। সেই প্রেক্ষাপটে এবারের জাতীয় দুর্যোগ প্রস্ততি দিবস ২০২৩ এর প্রতিপাদ্য বিষয় “স্মার্ট বাংলাদেশের প্রত্যয় দুর্যোগ প্রস্ততি সবসময়”। 

বিল্ডিং হল ভূমিকম্পের সময় বিপর্যয় সৃষ্টি করে অন্যতম প্রধান উপাদান । নগরায়নের ফলে শহরের জনসংখ্যা দিনদিন বেড়ে চলছে। এই ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠির চাগিদা মিটাতে শহরগুলোতে গড়ে ওঠছে অপরিকল্পিত আবাসন, মানা হচ্ছে না বিল্ডিং কোড। যার ফলে এই ভবনগুলো ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাড়িয়েছে। সম্প্রতী ঘটে যাওয়া তুরস্কের ভূমিকম্পে প্রায় ১ লক্ষ ভবন ধসে পরে, তার কারণ হিসেবে দেখা যায় ঐ শহরের বিদ্যমান পুরাতন বিল্ডিংগুলির খুব কম রেট্রোফিটিং (মজবুতিকরণ) হয়েছে এবং নতুন বিল্ডগুলিতে বিল্ডিং স্ট্যান্ডার্ডগুলির খুব কম প্রয়োগ করা হয়েছে বলে মতামত দিয়েছেন অক্সফোডের গবেষক প্রফেসর এলেক্সজেন্ডার। চুয়েটের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বন্দর নগরী চট্টগ্রামের ৭৮ শতাংশ ভবন বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) লঙ্ঘন করে নির্মিত হয়েছে। এবং ধারনা করা হচ্ছে চট্টগ্রাম শহরের প্রায় ৭০শতাংশ উচ্চ ভবন ধসে পড়বে যদি রিখটার স্কেলে ৭-৮ মাত্রার ভূমিকম্প চট্টগ্রাম শহরে আঘাত হানে। সেই তুলনায় রাজধানীর ঢাকায় আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমাদের দেশের পুরনো ২-৩ বা ৫ তলার যেসব ভবন আছে, যেগুলো ভূমিকম্প সহনীয় নয়, সেক্ষেত্রে এখনই সে ভবনগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল ভূমিকম্প অপ্রত্যাশিত, অনিয়ন্ত্রিত এবং ভূমিকম্প মোকাবেলায় আমাদের দেশের জনগণের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিল্ডিং কোড না মেনে চলা এবং বাসিন্দাদের ভূমিকম্পে সাড়াঁ দেবার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, শহর এলাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়াও, আমাদের শহরগুলোর রাস্তা তুরস্ক ও সিরিয়ার রাস্তার মতো এত চওড়া না, খুবই সরু। আমাদের পুরাতন ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে যদি ভূমিকম্প হয়, দেখা যাবে সেখানে উদ্ধারকর্ম পরিচালনা করার জন্য কোনো গাড়িই বা যন্ত্রপাতি ঢুকতে পারবে না। ফলে উদ্ধার অভিযান বিলম্বিত হবে, ভূমিকম্পে তাৎক্ষণিকভাবে যে পরিমাণ প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হবে তার চেয়ে বেশি প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে, উদ্ধার অভিযানের দীর্ঘতা ও সরঞ্জমাদির অভাবে। তাই আমাদের এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।

ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় আমাদেরকে প্রথমে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলির ম্যাপিং করতে হবে। সেক্ষেত্রে জিআইএস প্রযুক্তির ব্যবহার করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলির অবস্থান নির্ণয় করতে হবে। চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ বিল্ডিংগুলিকে রেট্রোফিটিং (মজবুতিকরণ) নিশ্চিতকরণ করতে হবে এবং নতুন বিল্ডগুলিতে বিল্ডিং স্ট্যান্ডার্ড  বা বিল্ডিং কোড সঠিকভাবে মানা হচ্ছে কি না সেটা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন তৈরি করতে হবে। এইক্ষেত্রে জাপানের ভূমিকম্প প্রমাণ পরিকল্পনা পদ্ধতি অনুসরন করা যেতে পারে। কর্তৃপক্ষকে মাঝে মধ্যে মোবাইল কোট চলমান করে দেখতে হবে, বিল্ডিংগুলো অনুমোদিত প্লানে যেমন ছিল বাস্তবে সেরকম আছে কিনা। ফায়ার সার্ভিসের ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতা বাড়াতে হবে, প্রয়োজনীয় ও আধুনিক সরঞ্জাম কিনে দিতে হবে। স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারের ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং ওয়ার্ড অফিসে কিছু সরঞ্জাম রেখে দিতে হবে। 

ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) মত আমাদের মহল্লায় মহল্লায়ও এরকম ভূমিকম্প প্রস্তুতি কর্মসূচি চালু করতে হবে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে ক্যাম্পেইন আয়োজন করতে হবে। ভূমিকম্প নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা করতে হবে এবং গবেষণার ফলাফল অভিষ্ট জনগোষ্ঠিকে জানাতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভূমিকম্প বিষয়ে জ্ঞানের চর্চা ও বিদ্যমান সম্পদ ব্যবহারে সমন্বয় করতে হবে। ভূমিকম্প নিয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সমূহ কর্মসূচি তৈরী ও বাস্তবায়ন করতে হবে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় ফান্ডিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। বেসরকারি  উন্নয়ন সংস্থাগুলো সরকারের সাথে সমন্বয় করে ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন মহড়া (মকড্রিল) আয়োজন করতে হবে। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের এই মহড়া (মকড্রিল) অংশ নিতে হবে। স্থানীয় কমিউনিটিকে ভূমিকম্পে সাড়াদানে ক্ষমতায়িত করতে হবে, কিছু সরঞ্জাম তাদের কাছে রেখে দিতে হবে এবং নিয়মিতভাবে তা ব্যবহারের চর্চা করতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরকে এই সমস্ত বিষয়গুলোকে সমন্বয় করতে হবে। প্রয়োজনে ভূমিকম্প নিয়েই সরকারের আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান দাড় করাতে হবে, যে প্রতিষ্ঠান শুধু ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলার কাজ করবে। সবার সামগ্রিক প্রচেষ্টায় পূর্ব প্রস্ততির মাধ্যমে ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলায় টিকে থাকা ও ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সহজ হবে।

মঙ্গলবার, ৭ মার্চ, ২০২৩

ভূমিকম্পঃ তুরস্কের ভূমিকম্পে কেন এত প্রাণহানি ও ভবন ধসে পড়ল, সেখান থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা ও করণীয়

গত ৬ ফেব্রুয়ারী ‘২০২৩ সোমবার তুরস্কের স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে এই শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এই ভূমিকম্পটির কেন্দ্র বা ইপিসেন্টার ছিল সিরিয়ার সীমান্তবর্তী তুরস্কের গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে। প্রথম ভূমিকম্পটি ছিল খুবই শক্তিশালী রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭.৮। প্রায় চার ঘন্টাপর উক্ত অঞ্চলে আরেকটি বড় মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়, রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭.৫। এভাবে ভূমিকম্পের পর অর্ধশতাধিক পরাঘাত (বড় ভূমিকম্পের পর ছোট ছোট ভূমিকম্প) হয়। 

তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমান্তে আঘাত হানা ভূমিকম্পটি সাম্প্রতিক সময়ে এই অঞ্চলে আঘাত হানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলির মধ্যে অন্যতম। বেরকারি তথ্যমতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এই ভূমিকম্পে নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে লক্ষাধিক মানুষ, ৯০ হাজারের মত বিল্ডিং ধসে পড়েছে, অগণিত মানুষ শীতের মধ্যে খোলা আকাশের নিছে বসবাস করতে হয়েছে, স্কুল ও হাসপাতালগুলো ধ্বংস হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে শিশুরা। তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে মানুষকে নতুন করে জানতে আগ্রহ তৈরী করেছে ভূমিকম্প কি? কেন হয়? ভূমিকম্পের প্রবণতা, ঝুঁকি ও মোকাবেলায় আমাদের করণীয়। 

ভূমিকম্প কি ও কেন হয়?

ভূমিকম্প হল পৃথিবীর লিথোস্ফিয়ারে শক্তির আকস্মিক মুক্তির ফলে ভূপৃষ্ঠের কম্পন যা সিসমিক তরঙ্গ সৃষ্টি করে। সাধারণত তিনটি প্রধান কারণে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে যেমন; ভূপৃষ্ঠজনিত কারণ, আগ্নেয়গিরিজনিত কারণ, শিলাচ্যুতিজনিত কারণ। 

ধারনা করা হয়, পৃথিবীর সব স্থলভাগ আগে একত্রে ছিল, যা প্যানজিয়া নামে পরিচিত। এটি প্যান্থালাসা (Panthalassa) নামক একটিমাত্র মহাসাগর দ্বারা বেষ্টিত ছিল। পৃথিবীর উপরিভাগে কতগুলো অনমনীয় প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত বলে ধীরে ধীরে তারা আলাদা হয়ে গেছে। এই প্লেটগুলোকেই ভূ-বিজ্ঞানীরা বলেন টেকটোনিক প্লেট। টেকটোনিক প্লেটগুলো একে অপরের সঙ্গে পাশাপাশি লেগে আছে। 

ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীতে সাতটি প্রধান প্লেট রয়েছে যেমন আফ্রিকান, অ্যান্টার্কটিক, ইউরেশিয়ান, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকান, ভারত-অস্ট্রেলীয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট। এবং কিছু ক্ষুদ্র প্লেটের রয়েছে যেমন আরব, ক্যারিবিয়ান, নাজকা স্কোটিয়া প্লেট এবং বার্মিজ প্লেট। কোনো কারণে এগুলোর নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ হলেই তৈরি হয় শক্তি। এই শক্তি সিসমিক তরঙ্গ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। যদি তরঙ্গটি শক্তিশালী হয়, তাহলে সেটি পৃথিবীর উপরিতলে এসে পৌঁছায়। আর তখনো যদি যথেষ্ট শক্তি থাকে, তাহলে সেটা ভূত্বককে কাঁপিয়ে তোলে। এই কাঁপুনিই মূলত ভূমিকম্প।

ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে কোনো স্থানে ভূকম্পনের জন্য ফল্ট লাইনের বড় ভূমিকা রয়েছে। ভূত্বকের বিশাল খণ্ডকে টেকটোনিক ফল্ট বলা হয়। আর দুটি টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে থাকা ফাটলকে ফল্ট লাইন বলা হয়। তুরস্কের পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টের অবস্থান অ্যারাবিয়ান প্লেট ও আনাতোলিয়ান প্লেটের মাঝে। পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টকে বহু আগে থেকেই খুবই বিপজ্জনক উল্লেখ করে সতর্ক করেছিলেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা। একইভাবে বাংলাদেশ ইউরেশিয়ান এবং ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেটের মধ্যে অবস্থিত, যার কারণে এই অঞ্চলটি ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, এই প্লেটটি সক্রিয় রয়েছে। ভারতীয় প্লেটটি উত্তর-পূর্ব দিকে প্রতি বছর ৬ সেমি হারে এবং উত্তর ও পূর্বে ইউরেশিয়ান এবং বার্মিজ ক্ষুদ্র প্লেটটি নিচে যথাক্রমে প্রতি বছর ৪৫ মিমি এবং প্রতি বছর ৩৫ মিমি হারে সাব-ডাক্টিং করছে। তাছাড়া বাংলাদেশে কিছু সক্রিয় সিসমিক ফল্ট রয়েছে যেমন সীতাকুণ্ড-টেকনাফ ফল্ট, রাঙ্গামাটি-বরকল ফল্ট/চ্যুতি, মধুপুর ফল্ট/চ্যুতি, সিলেট- আসাম ফল্ট/চ্যুতি ইত্যাদি। সে জন্য ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা এই সব অঞ্চলে ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে সতর্ক করেছেন।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী বাংলাদেশকে চারটি প্রধান ভূমিকম্প অঞ্চলে বিভক্ত;

জোন-০১: সিলেট-ময়মনসিংহের অঞ্চলসমূহ, যেখানে ভূমিকম্পের সম্ভাব্য মাত্রা রয়েছে ৭ রিখটার স্কেল;
জোন-০২: চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল ও রংপুরের কিছু এলাকায় , যেখানে ভূমিকম্পের সম্ভাব্য মাত্রা রয়েছে ৬ রিখটার স্কেল;
জোন-০৩: কুমিল্লা, ঢাকা, দিনাজপুর, নাটোর ও খুলনার কিছু এলাকায়, যেখানে ভূমিকম্পের সম্ভাব্য মাত্রা রয়েছে ৬ রিখটার স্কেল;
জোন-০৪: যশোর, বরিশাল, রাজশাহ ‘র কিছু এলাকায়, যেখানে ভূমিকম্পের সম্ভাব্য মাত্রা রয়েছে ৫ রিখটার স্কেল;

এছাড়াও কতগুলো কারণে ভূমিকম্প হতে পারে,  যেমন: ভূগর্ভস্থ প্রবল বাষ্পচাপ; ভূ-সংকোচন অথবা প্রসারণ; খনিজ পদার্থের মাত্রারিক্ত উত্তোলন; অধিক পলি উৎপাদন; ভূ-গর্ভস্থ পানির মাত্রারিক্ত ব্যবহার।

বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ইতিহাস
যদিও সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাদেশ কোনো বড় ধরনের ভূমিকম্পে হয়নি, তবে এই অঞ্চলে বড় আকারের ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে এবং এর আশেপাশে অতীতের বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে যেমন; ১৫৪৮ সালের ভূমিকম্প যা সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে আঘাত করেছিল, ১৬৪২ সালের ভূমিকম্পে সিলেট জেলায় বিভিন্ন ভবনের ও কাঠামোর ক্ষতি হয়েছিল, ১৭৬২ সালের ভূমিকম্পে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সহ বাংলাদেশের বেশিরভাগ অংশে জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছিল, ১৮৯৭ সালে এই অঞ্চলে ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল যা, গ্রেট ইন্ডিয়া ভূমিকম্প নামে পরিচিত। এই ভূমিকম্পে সিলেট শহরে ভবনের মারাত্মক ক্ষতি হয়, যেখানে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৪৫। 

১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই ৭.৬ মাত্রার বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছিল যেটি শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প নামে পরিচিত । এর কেন্দ্রস্থল ছিল শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজারে।

১৯৯৭ সালের ২১ নভেম্বর চট্টগ্রামে ৬.১ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত এনেছিল, এটি বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চলে ঘটেছিল। ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল ভারতের দক্ষিণ মিজোরামে। ভারতের মিজোরামে কোনো প্রাণহানির খবর পাওয়া না গেলেও, বাংলাদেশের চট্টগ্রামে একটি ৫ তলা ভবন ধসে ২৫ জন নিহত হয়েছে।

১৯৯৯ সালের ২২ জুলাই, মহেশখালী দ্বীপে একটি ভূমিকম্প হয়েছিল যার কেন্দ্রস্থল ছিল একই স্থানে, ৫.২ মাত্রার ভূমিকম্পটি মহেশখালী দ্বীপ এবং সংলগ্ন সমুদ্রের চারপাশে তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছিল। ঘরবাড়ি ফাটল এবং কিছু বাড়িঘর ধসে পড়েছে।

২০০৩ সালের ২৭ জুলাই চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত এনেছিল, এটি কেন্দ্র ছিল দক্ষিণ-পূর্ব কাপ্তাই জলাধারের পূর্ব পাড়ে। এই ভূমিকম্প বোরকোল ভূমিকম্প নামে পরিচিত। এই ভূমিকম্পে চট্টগ্রামে তিনজন নিহত, ২৫ জন আহত এবং প্রায় ৫০০টি ভবন ক্ষতিগ্রস্থ  হয়। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মদুনাঘাট গ্রিড সাবস্টেশনে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণে কয়েকটি এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। রাজধানী ঢাকায় এই ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৪। এই মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকা শহর কেঁপে ওঠে। উঁচু ভবনের বাসিন্দাদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পরে।

ভূমিকম্পের প্রবণতা ও ঝুঁকি
তুরস্ক-সিরিয়ার মতো বাংলাদেশও ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। বাংলাদেশে ৪-৫টি সচল ফল্ট লাইন আছে। ১৮৯৭ সালে এই অঞ্চলে ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল যা, গ্রেট ইন্ডিয়া ভূমিকম্প নামে পরিচিত। সেই ক্ষেত্রে তুরস্কের ভূমিকম্পগুলোকে আমাদের দেশে সংঘটিত ভূমিকম্পের তুলনায় ছোটই বলা যায়। ভূমিকম্পের রিটার্ন পিরিয়ড ধরা হয় ১৫০-২০০ বছর। সে হিসেবে সাইকেলটি এখনো ফিরে আসেনি। সেটি কখন হবে কেউ জানে না। আসলে ভূমিকম্পের পূর্বানুমান করা সম্ভব না। পরিসংখ্যানগত রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে যে গত ৫০ বছরে ভূমিকম্পের ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ছে। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে ঘন ঘন হালকা কম্পন একটি সংকেত দেয় যে একটি শক্তিশালী কম্পন আসছে, যা সবার জন্য উদ্বেগের বিষয়। তার জন্য আমাদের আতংকিত না হয়ে প্রস্ততি নিতে হবে, ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকি বিষয়গুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা্ নিতে হবে।

বিল্ডিং হল অন্যতম প্রধান উপাদান যা ভূমিকম্পের সময় বিপর্যয় সৃষ্টি করে। সম্প্রতী ঘটে যাওয়া তুরস্কের ভূমিকম্পে প্রায় ১ লক্ষ ভবন ধসে পরে, তার কারণ হিসেবে দেখা যায় ঐ শহরের বিদ্যমান পুরাতন বিল্ডিংগুলির খুব কম রেট্রোফিটিং (মজবুতিকরণ) হয়েছে এবং নতুন বিল্ডগুলিতে বিল্ডিং স্ট্যান্ডার্ডগুলির খুব কম প্রয়োগ করা হয়েছে বলে মতামত দিয়েছেন অক্সফোডের গবেষক প্রফেসর এলেক্সজেন্ডার। চুয়েটের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বন্দর নগরী চট্টগ্রামের ৭৮ শতাংশ ভবন বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) লঙ্ঘন করে নির্মিত হয়েছে। এবং ধারনা করা হচ্ছে চট্টগ্রাম শহরের প্রায় ৭০শতাংশ উচ্চ ভবন ধসে পড়বে যদি রিখটার স্কেলে ৭-৮ মাত্রার ভূমিকম্প চট্টগ্রাম শহরে আঘাত হানে। সেই তুলনায় রাজধানীর ঢাকায় আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমাদের দেশের পুরনো ২-৩ বা ৫ তলার যেসব ভবন আছে, যেগুলো ভূমিকম্প সহনীয় নয়, সেক্ষেত্রে এখনই সে ভবনগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল ভূমিকম্প অপ্রত্যাশিত, অনিয়ন্ত্রিত এবং আমাদের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলি এখনো চিহ্নিত করা হয়নি । এবংভূমিকম্প মোকাবেলায় আমাদের জনগণের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিল্ডিং কোড না মেনে চলা এবং বাসিন্দাদের ভূমিকম্পে সাড়াঁ দেবার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, শহর এলাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাছাড়াও, আমাদের শহরগুলোতে রাস্তাগুলো তুরস্ক ও সিরিয়ার রাস্তার মতো এত চওড়া না,  শুধু চিপা গলি আর গলি। আমাদের পুরান ঢাকা ও চট্টগ্রামের যদি ভূমিকম্প হয়, দেখা যাবে সেখানে উদ্ধারকর্ম পরিচালনা করার জন্য কোনো গাড়িই বা যন্ত্রপাতি ঢুকতে পারবে না। ফলে উদ্ধার অভিযান বিলম্বিত হবে, ভূমিকম্পে তাৎক্ষণিকভাবে যে পরিমাণ প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হবে তার চেয়ে বেশি প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে, উদ্ধার অভিযানের দীর্ঘতা ও সরঞ্জমাদির অভাবে। তাই আমাদের এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে..!

ভূমিকম্পের ঝুঁকি ও মোকাবেলায় আমাদের করণীয়
আমার একটি গবেষণায় দেখিছি, চট্টগ্রাম শহরের প্রায় ৯০ শতাংশ ভবন ভূমিকম্পের জন্য মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ ও মাত্র ৪ শতাংশ মানুষের ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভাল জ্ঞান রাখে । এবং গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে মাত্র ৩২ শতাংশ বিল্ডিংগুলিতে অগ্নি সুরক্ষা সরঞ্জাম রয়েছে এবং কোনও ভবনে জরুরি বহির্গমন সুবিধা নেই। সুতরাং, এই নিরাপত্তা সরঞ্জাম, সুবিধা এবং জ্ঞানের অনুপস্থিতি শহরে এলাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকির মাত্রা অনেকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। সুতরাং ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় আমাদেরকে প্রথমে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলির ম্যাপিং করতে হবে। চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ বিল্ডিংগুলিকে রেট্রোফিটিং (মজবুতিকরণ) নিশ্চিতকরণ করতে হবে এবং নতুন বিল্ডগুলিতে বিল্ডিং স্ট্যান্ডার্ড  বা বিল্ডিং কোড সঠিকভাবে মানা হচ্ছে কি না সেটা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন তৈরি করতে হবে। জাপানের ভূমিকম্প প্রমাণ পরিকল্পনা পদ্ধতি অনুসরন করা যেতে পারে। কর্তৃপক্ষকে মাঝে মধ্যে মোবাইল কোট চলমান করে দেখতে হবে, বিল্ডিংগুলো অনুমোদিত প্লানে যেমন ছিল বাস্তবে সেরকম আছে কিনা।

ফায়ার সার্ভিসের ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতা বাড়াতে হবে, প্রয়োজনীয় ও আধুনিক সরঞ্জাম কিনে দিতে হবে। স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারের ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং ওয়ার্ড অফিসে কিছু সরঞ্জাম রেখে দিতে হবে। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) মত আমাদের মহল্লায় মহল্লায়ও এরকম ভূমিকম্প প্রস্তুতি কর্মসূচি করা চালু করতে হবে, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে ক্যাম্পেইন আয়োজন করতে হবে। ভূমিকম্প নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে হবে এবং গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভূমিকম্প বিষয়ে জ্ঞানের চর্চা ও বিদ্যমান সম্পদ ব্যবহারে সমন্বয় করতে হবে। ভূমিকম্প নিয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সমূহ প্রজেক্ট তৈরী ও বাস্তবায়ন করতে হবে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় ফান্ডিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। বেসরকারি  উন্নয়ন সংস্থাগুলো সরকারের সাথে সমন্বয় করে ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন মহড়া (মকড্রিল) আয়োজন করতে হবে। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের এই মহড়া (মকড্রিল) নিমন্ত্রণ করতে হবে। স্থানীয় কমিউনিটিকে ভূমিকম্পে সাড়াদানে ক্ষমতায়িত করতে হবে, কিছু সরঞ্জাম তাদের কাছে রেখে দিতে হবে এবং নিয়মিতভাবে তা ব্যবহারের চর্চা করতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরকে এই সমস্ত বিষয়গুলোকে সমন্বয় করতে হবে। প্রয়োজনে ভূমিকম্প নিয়েই সরকারের আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে হবে, যে প্রতিষ্ঠান শুধু ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলার কাজ করবে।

সূত্র:
https://bangla.thedailystar.net/environment/climate-change/natural-disasters/news-448236
https://www.un.org/en/t%C3%BCrkiye-syria-earthquake-response?
https://www.prothomalo.com/world/middle-east/d109g4mybl
https://nagorikvoice.com/16718/
https://www.bbc.com/news/science-environment-64540696
https://www.bbc.com/news/64568826





বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

হেলথ বিলিভ মডেলঃ ভবিষৎ করোনা সংক্রমণকে প্রতিহত করতে অধিক কার্যকর

স্বাস্থ্য বলতে শুধু রোগ বা অসুখের অনুপস্থিতি বোঝায় না, স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও সামাজিকভাবে ভালো থাকাকে বোঝায়। সুস্বাস্থ্যের জন্য ব্যক্তির আচরণ, মানসিকতা ও পরিবেশ সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। হেলথ বিলিভ মডেল অনুসারে মানুষের স্বাস্থ্যের অবস্থা তার  ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণবিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত। এই ধারনা বা মতবাদ কে হেলথ বিলিভ মডেল বলা হয়। মানুষের আচরণগত স্বাস্থ্য তত্ত্বগুলির মধ্যে হেলথ বিলিভ মডেল বা স্বাস্থ্য বিশ্বাস মডেল (HBM) অন্যতম।  হেলথ বিলিভ মডেল মতে মানুষের স্বাস্থ্য প্রোগ্রাম/কর্মসূচী ডিজাইন করা উচিত মানুষের জীবনধারা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে অনুসরন করে বা সেগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে।

হেলথ বিলিভ মডেল ধারনাটি প্রথম মানুষের সামনে নিয়ে আসেন মার্কিন সামাজিক মনোবৈজ্ঞানিকদের একটি দল ১৯৫০ সালে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে কারণ খুজতে গিয়েছিলেন কেন এত কম লোক বিনামূল্যে যক্ষ্মা স্ক্রীনিং প্রোগ্রামে রেসপন্স করল। পরবর্তীতে তারা দেখল যক্ষ্মা স্ক্রীনিং প্রোগ্রামটি স্থানীয় জনগোষ্ঠির বিশ্বাসে ও আচরণে সাথে বৈরী ছিল। পরবর্তীতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা একটি মতে পৌছল যে, স্বাস্থ্য পরিষেবা মানুষের জ্ঞান, মতামত, অবস্থান, পরিবেশ, কর্ম, আচরণবিধি ও সংস্কৃতিকে পর্যালোচনা করে নির্ণয় ও পরিকল্পনা করা উচিত যাতে কাংখিত লক্ষে পৌছানো যায়। আর এটাই  হেলথ বিলিভ মডেলেরে মুল লক্ষ্য।

আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে সিপাহী বিপ্লবের। কেউ কেউ একে মহাবিদ্রোহ বলে থাকেন। মহাবিদ্রোহ ১৮৫৭ কে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন রূপে গণ্য করা হয়। আর এই সিপাহী বিপ্লবের অন্যতম কারণ ছিল ৫৫৭ ক্যালিবার এনফিল্ড (পি/৫৩) রাইফেল এর কার্তুজ। রাইফেল গুলোর কার্তুজ গরু ও শুকরের চর্বি দিয়ে তৈরী হতো। সৈন্যরা তাদের রাইফেলের কার্তুজ লোড করার সময় তা দাঁত দিয়ে খুলে লাগাতে হতো। গরু ও শুকরের চর্বি মুখে দেয়া হিন্দু-মুসলিম সৈন্যদের জন্য অধার্মিক ও গর্হিত কাজ। ফলশ্রুতিতে, ১৮৫৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে সিপাহীরা (ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ভারতীয় সৈন্য) নতুন কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করেছিল। যার ফলে ব্রিটিশ শোসকগোষ্ঠীকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল।

আমরা যদি লক্ষ্য করি কোভিড-১৯ এর টিকাদান কর্মসূচীতে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজে জনগণের যে পরিমাণে আগ্রহ ও অংশগ্রহণ ছিল, তৃতীয় ডোজ বা বোস্টারে সে পরিমাণে আগ্রহ নেই। তার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায়, করোনা প্রতিরোধে মানুষের মানসিক শক্তি ও সাহস বেড়েছে, সংক্রামণের হার কমেছে। অন্যদিকে বলা যায় তৃতীয় ডোজ বা চতুর্থ ডোজের প্রচার ও কার্যকারীতে নিয়ে সংলাপ কমে গেছে। যার ফলে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে সে ভবিষৎ করোনা সংক্রমণকে প্রতিহত করতে পারবে।

কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, প্রথম ডোজ নেওয়ার তিন মাস পর ভাইরাসটির বিরুদ্ধে টিকার কার্যকারিতা কমতে শুরু করে। দ্বিতীয় ডোজের কার্যকারিতা  ছয় মাস। কিন্তু ছয় মাস পর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় আগের চেয়ে ১৫ গুণ। এই টিকার প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার বিষয়টি জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। গবেষণায় দেখা গেছে, দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পর শরীরে যে পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, বুস্টার ডোজ নিলে তৈরি হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। এ কারণে  বিশেষজ্ঞরা বুস্টার ডোজ এর ব্যাপারে বিশেষ জোর দিচ্ছেন। তাই হেলথ বিলিভ মডেল অনুসারে অবস্থার উন্নতিতে আমরা বেশ কিছু প্রোগ্রাম ও কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে পারি যার ফলে মানুষের মধ্যে বোস্টার ডোজের ব্যাপরে আগ্রহ তৈরী হবে। এবং কোভিড-১৯ এর ঝুঁকি কমে আসবে।

হেলথ বিলিভ মডেল মতে মানুষের স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত আচরণের দুটি উপাদান রয়েছে। স্বাস্থ্য আচরণ মডেলের দুটি উপাদান হল:

  • অসুস্থ হলে সুস্থ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা;
  • স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত কর্মসূচীগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে অসুস্থতা থেকে মুক্তি ও রোগ প্রতিরোধ করা যায় এটা বিশ্বাস করা;

যেমন; নিয়মিত স্বাস্থ্যকর/পুষ্টিকর খাবার , ব্যায়াম ও অ্যালকোহল সেবন না করার মাধ্যমে অসুস্থতা থেকে মুক্তি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়। যার ফলে সুস্থ থাকা যায় এটি বিশ্বাস করা ও মান্য করা। এবং কোভিড-১৯ এর ঝুঁকি কমিয়ে আনতে বোস্টার ডোজ গ্রহণ।  বোস্টার ডোজ এর কার্যকারীতা, ফলাফল ও অপরিহার্যতা সেটি জনগণের কাছে তুলে ধরা।