শুক্রবার, ১২ মে, ২০২৩

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ইপসা’র ৩৮ বছর

দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বেসরকারি সমাজউন্নয়নমূলক সংস্থার কার্যক্রমকে উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণণা করা হয়। বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়ন, সীমিত সম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণে বেসরকারি সমাজউন্নয়নমূলক সংস্থার ভূমিকা অপরিসীম। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীতে যুদ্ধবিধস্ত রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্র যেমন এগিয়ে আসে তেমনি ত্রাণ ও পুনবার্সন কার্যক্রমে বেসরকারিভাবে কর্মকান্ড চলতে থাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। ত্রাণ ও পুনবার্সন কার্যক্রম শক্তিশালী করার জন্য ১৯৭২ সালে গঠিত হয় ব্রাক। এরপর ১৯৭৬ সালে প্রশিকা ও গ্রামীণ ব্যাংক গঠিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠান ত্রাণ পুনবার্সনের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়ননে গুরুত্বারোপ করে। আশির দশকে বেসরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রম ইস্যুতে পরিবর্তন আসে। তার প্রেক্ষাপটের কারণ ছিল সামরিক শাসন ও সকল স্তরে সামরিকায়নের ফলে ঐ সময় দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে দুর্দশা তৈরি হয়। এই অবস্থার থেকে উত্তরণের জন্য তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশে বেশ কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও ‍সিভিল সোসাইটির জন্ম নেয়, তাদের মধ্যে ইপসা (ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল এ্যাকশান) অন্যতম।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯০ সালকে “যুব দশক” ও ১৯৮৫ সালকে “আন্তর্জাতিক যুব বর্ষ” ঘোষনা করে। উন্নয়ন ও মানবিক কর্মসূচীতে যুবকদের সম্পৃক্ত করতে ব্যাপক প্রচারনার ব্যবস্থা নেয়া হয়। এমনি প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার কয়েকজন সমাজ সচেতন যুবক ইপসা’র প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নির্বাহী মোঃ আরিফুর রহমানের নেতৃত্বে একটি উন্নয়ন সংগঠন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এলাকার যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করে। আর এভাবেই “১৯৮৫ সালের ২০ মে” সচেতন যুবকদের সক্রিয় উদ্যোগে সমাজ উন্নয়ন সংগঠন “ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল এ্যাকশন (ইপসা)’র পদযাত্রা শুরু হয়। কালের পরিক্রমায় ও সময়ের সাথে পালা দিয়ে ইপসা (ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল এ্যাকশন) বিশ্বস্ততা অর্জন করে লক্ষিত জনগোষ্ঠির ও নিবন্ধন লাভ করেন বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের, আস্থা অর্জন করে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার। ইপসা’র ভিশন হলো “এমন একটি দারিদ্রমুক্ত সমাজ যেখানে সকলের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে।” তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে সংগঠিত করে বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নে কাজ করে যাচ্ছে ইপসা। দেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাড়া প্রদান ও পুনবার্সন, পরিবেশ সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা, স্বাক্ষরতা হার বৃদ্ধি, শিক্ষার মান উন্নয়ন, স্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা, কোভিড-১৯ সাড়া, শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা, যুবদের ক্ষমতায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শোভন কর্মপরিবেশ সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, মূলধন গঠন, জাতীয় আয় বৃদ্ধি, বলপূর্বক স্থানচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের মানবিক সাড়া প্রদান ও শিশু, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে ইপসা। ১৯৮৫ সালে ইপসা তার যাত্রা শুরু করে বর্তমানে প্রায় ০৩ হাজার কর্মী সারাদেশে ১৪ মিলিয়ন মানুষের জীবন সংগ্রামে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

ইপসা’র মূল্যবোধ

  • দেশপ্রেম এবং জাতীয় স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় গৌরবের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা
  • ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা
  • পারষ্পরিক শ্রদ্ধা এবং জেন্ডার বান্ধব মনোভাব সম্পন্নতা
  • মান সম্পন্নতা এবং উৎকর্ষতা
  • বিনম্রতা এবং আত্মবিশ্বাস
  • বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ
  • পরিবেশ এবং প্রতিবেশের প্রতি সহমর্মিতা

সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্য
  • পারিবারিক পরিবেশ
  • দায়িত্ব সচেতনতা
  • ব্যয়সাশ্রয় নীতি
  • গঠনমূলক সমালোচনা ও সংস্থার পরিচিতি প্রসার
  • বিভিন্ন জাতি ধর্ম ও বর্ণ’র সাম্য ও সমপ্রীতি
  • সুস্থ বিনোদন
ইপসা’র কার্যক্রমঃ
ইপসা’র কার্যক্রমকে ছয়টি থিমে ভাগ করা হয়, যথা;
  • শিক্ষা
  • স্বাস্থ্য
  • পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন
  • অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন
  • মানবাধিকার ও সুশাসন
  • দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও মানবিক সাড়া প্রদান
উক্ত উন্নয়ন থিমের আওতায় বর্তমানে ইপসা’র সকল উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

লিংক অরগানাইজেশন সমূহঃ
  • আইসিটি এন্ড রিসোর্স সেন্টার অন ডিসএ্যাবিলিটিস (আইআরসিডি)
  • ইপসা- সেন্টার ফর ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট (ইপসা-সিওয়াইডি)
  • ইপসা- ডেভেলপমেন্ট রিসোর্স সেন্টার (ইপসা-ডিআরসি)
  • ইপসা- পরিচালিত স্কুল সমূহ (এভারগ্রীন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, কাজী পাড়া শিশু নিকেতন ও আলেকদিয়া শিশু নিকেতন)
  • ইপসা মানব সম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্র (ইপসা এইচআরডিসি)
  • রেডিও সাগর গিরি এফ এম ৯৯.২
  • ইন্টারনেট রেডিও দ্বীপ
  • কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
সম্মাননা ও স্বীকৃতিঃ
সুদীর্ঘ ৩৮ বছরের পথচলায়, ইপসা জয় করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির বিশ্বস্ততা, সরকার ও দাতা জনগোষ্ঠির আস্থা। ইপসা তার কার্যক্রমের মাধ্যমে অবদান রাখছে স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা থেকে বৈশ্বিক লক্ষমাত্রা অর্জনে। তার স্বীকৃতিস্বরুপ স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অর্জন করে বেশ সম্মাননা ও স্বীকৃতি। নিম্নে বিশেষ কিছু সম্মাননা ও স্বীকৃতির নাম উল্লেখ করা হল;
  • তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিবন্ধী নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য ২০২১ সালে WSIS Prize অর্জন করে।  
  • দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পাঠ উপযোগী বই তৈরীর জন্য, ইপসা ২০২০ সালে  জিরো প্রজেক্ট এওয়ার্ড অর্জন করে। জাতিসংঘ সদর দপ্তর অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় এই এওয়ার্ড প্রদান করা হয়।
  • ২০২০ সালে ইপসা নয়া দিল্লি, ভারত থেকে  ই-এনজিও চ্যালেঞ্জ এওয়ার্ড অর্জন করে।
  • নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতকরনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়, চট্টগ্রাম ইপসাকে চট্টগ্রাম জেলায় শ্রেষ্ঠ বেসরকারি সংগঠন ২০২০ সম্মাননা প্রদান করে।
  • তামাক নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অবদান রাখার জন্য, তামাক বিরোধী জাতীয় প্লাটফর্ম ও পিকেএসএফ, ইপসাকে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ পদক ২০১৯ প্রদান করে।
  • ইপসা ২০১৮ সালে বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদক অর্জন করে।
  • সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তর কর্তৃক ইপসা ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে সেরা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা স্বীকৃতি সম্মাননা লাভ করে।
  • প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ডিজিটাল ক্ষমতায়নে ইপসা, ২০১৮ সালে ইউনেস্কো-আমির আল আহমেদ আল জাবের সম্মাননা লাভ করে (প্যারিস, ফ্রান্স)।
  • ইপসা ইনোভেটিব সার্ভিস ডেলিভারির জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিল বিকন এওয়ার্ড ২০১৭ অর্জন করে। 
  • ইপসা, দৃষ্টি ও পঠন প্রতিবন্ধী শিক্ষাথীদের রিডিং মেটেরিয়ালস তৈরীর স্বীকৃতিস্বরূপ ডব্লিউএসআইএস এওয়ার্ড অর্জন করে ২০১৭ সালে।
  • ইপসা ২০১০ সালে নয়া দিল্লি, ভারত হতে আর্ন্তজাতিক মন্থন এওয়ার্ড অর্জন করে ।
  • জাতিসংঘ এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (UN-ECOSOC) কর্তৃক কনসালটেটিভ স্ট্যাাটাস অর্জন করে ২০১৩ সালে ।
  • যুব ও উন্নয়ন কর্মসুচিতে অনবদ্য ভূমিকা রাখায়  ইপসা  ১৯৯৯ সালে আর্ন্তজাতিক যুব শান্তি পুরস্কার  অর্জন করে।
আমাদের বিশ্বাস ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ ‍ও অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণে ইপসা’র এই ধারা অব্যাহত থাকবে। সমাজের অসঙ্গতিগুলো নিরসনে ইপসা স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের কার্যক্রমগুলো চলমান রাখবে। একটি সাম্য, মর্যাদা ও ন্যায্যতার পৃথিবী বিনির্মাণে ইপসা’র এই ধারা অব্যাহত থাকুক, ইপসা’র ৩৮ বছর পূর্তিতে এটি আমাদের কামনা।


সোমবার, ১ মে, ২০২৩

শ্রমিকের কর্মপরিবেশটি যেন হয় পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকিমুক্ত, নিরাপদ ও মর্যাদাকর!

শ্রম ছাড়া উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণ সম্ভব নয়, শ্রমিকের মর্যাদা ছাড়া অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, শ্রমিকের ঝুঁকিমুক্ত পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ছাড়া উৎপাদনশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কর্মচারীরা একটি কোম্পানির বা প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও প্রাণশক্তি। যখন প্রতিষ্ঠানের একজন সদস্য অসুস্থ বা আহত হন, তখন তাকে সুস্থ করা প্রতিষ্ঠানের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়টি জনস্বাস্থ্য বিভাগের এমন একটি বিষয় যেখানে চাকুরীর বা পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মীর আঘাত বা অসুস্থতার প্রতিরোধ ও চিকিৎসার বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা করা হয়। পেশাগত স্বাস্থ্যের সাথে বেশ কিছু বিভাগ জড়িত, যেমন পেশাগত ওষুধ, নার্সিং, এরগনোমিক্স, মনোবিজ্ঞান, স্বাস্থ্যবিধি, নিরাপত্তা এবং অন্যান্য।

উল্লেখ্য যে, এখানে স্বাস্থ্য বলতে শুধু রোগবালাই না হওয়াকে বোঝানো হয় না, বরং স্বাস্থ্য বলতে সামগ্রিক স্বাস্থ্য, অর্থাৎ দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক, আর্থিক স্বাস্থ্যকে বোঝানো হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়টির প্রধান কাজ হলো কর্মক্ষেত্রে যেকোনও ধরনের ঝুঁকি বা সম্ভাব্য বিপদ প্রতিরোধ করা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর মতে পেশাগত স্বাস্থ্য হল সমস্ত পেশায় নিয়োজিত কর্মীদের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতার সর্বোচ্চ স্তরের প্রচার এবং রক্ষণাবেক্ষণ। এবং পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ ও মানুষের সাথে কাজের পরিবেশের অভিযোজন। সর্বোপরি, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরপত্তা বিষয়টি কর্মীদের স্বাস্থ্য এবং তাদের কাজের পরিবেশ সম্পর্কিত নির্দেশিকা এবং নিয়মগুলির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এটি নিয়োগকর্তাদের সকল কর্মচারীদের জন্য একটি নিরাপদ কাজের পরিবেশ প্রদান করতে সচেষ্ট করে।

কর্মীর পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা লক্ষে বাংলাদেশ সরকার শ্রম আইন ২০০৬ প্রণয়ন করছেন ও তা বাস্তবায়ন করছেন। এই আইনের ৫১ হতে ৯৯ ধারাসমূহে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। তাছাড়াও বৈশ্বিকভাবে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে প্রতি বছর ২৮ এপ্রিল আন্তর্জাতিক পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবস ও ১মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালন করা হয়ে থাকে।  তাছাড়াও অন্যান্য আইন ও আন্তর্জাতিক সনদে এই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করা হয়েছে। এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি’।

কর্মপরিবেশে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার মূল উদ্দেশ্যঃপেশাগত স্বাস্থ্যে ও নিরাপত্তার মূল উদ্দেশ্য হল কর্মীদের জন্য একটি নিরাপদ এবং আস্থার পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং কাজের সাথে সম্পর্কিত অসুস্থতা বা আঘাতের ঝুঁকি হ্রাস করা। প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ প্রদানের আইনত বাধ্যতামূলক রয়েছে, এবং এটি শুধুমাত্র সঠিক পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক পলিসির প্রতিষ্ঠা, বাস্তাবায়ন, অরিয়েন্টশন এবং নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমেই সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার মূল উদ্দেশ্য হলঃ

• শ্রমিকের স্বাস্থ্য এবং কাজের ক্ষমতা রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রচার;

• কাজের অবস্থার উন্নতি এবং কর্মপরিবেশ স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী;

• নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত;

• কর্মক্ষেত্রে কাজের সামগ্রিক অবস্থা নিরীক্ষণ এবং উন্নতির সুযোগ সন্ধান;

• অসুস্থ বা অসুস্থতার কারণে দীর্ঘ সময়ে কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত কর্মীকে সহায়তা;

• কর্মীর শারীরীক সুস্থতার পাশাপাশি সামাজিক, আর্থিক ও মানবিক মর্যাদা প্রসিষ্ঠা;

• যে সমস্ত কর্মীরা কর্মক্ষেত্রে বা বাড়িতে মানসিক চাপে রয়েছেন তাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান;

• শ্রমিকদের কল্যাণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের স্থায়ীত্বশলতা আনয়ন;

• আন্তর্জাতিক মানদন্ড, প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকা ও গ্রাহকের সন্তুষ্টি অর্জনে।

পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বজায় রাখার সুবিধাঃ কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিধিবদ্ধ এবং নৈতিক বাধ্যবাধকতা ছাড়াও আরো অনেকগুলো কারণে এটি গুরুত্বপূর্ণ। কোন কারণে এটি করতে ব্যর্থ হলে সংস্থা এবং কর্মচারী/কর্মকর্তা ভয়ের জন্যই ক্ষতির কারণ হবে।

কর্মক্ষেত্রে কর্মীর মনোবল বৃদ্ধির জন্যঃ কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের মনোবল বজায় রাখা পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিধান খুব গুরুত্বপূর্ণ। পেশাগত স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে, কর্মীরা সংস্থার ভিতরে নিজেকে নিরাপদ ও মূল্যবান/গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। যার ফলে কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে একই প্রতিষ্ঠানে তৃপ্তির সাথে কাজ করে ও সংস্থার উৎপাদনশীলতা বাড়ায়।

সংস্থার সুনাম ও খ্যাতির জন্যঃ কর্মীর পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বজায় রাখলে কোম্পানির সুনাম ও খ্যাতি বৃদ্ধি পায়। আজ, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ইউজারে মুখের কথা কোম্পানির সুনাম ও খ্যাতির ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একজন গ্রাহক থেকে একজন কর্মচারী যে কেউ, সোশ্যাল মিডিয়ায় পর্যালোচনা/রিভিউ লিখতে বা তাদের মন্তব্য সামাজিক মিডিয়া প্রোফাইল আপডেট করতে পারে। আপনার কোম্পানি যদি পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত পরিমাণে বিনিয়োগ করে, তাহলে এর খ্যাতি বাড়বে।

নতুন সুযোগের সন্ধান লাভ করার জন্যঃ কর্মীর পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রতিষ্ঠান অনেক নতুন সুযোগ আনলক করে। যা সাফল্যের জন্য সংগঠনকে সেট আপ করে।

বিশ্বস্ততা অর্জন ও প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্যঃ কর্মীর পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রতিষ্ঠান গ্রাহক, কর্মচারী ও স্টেকহোল্ডারদের (সরকারি, বেসরকারি, দাতা সংস্থা) কাছে বিশ্বস্ততা অর্জন করে। যার ফলে নতুন কোন সুযোগ আসলে ঐ প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সুযোগটি সহজে লাভ করে।

পেশাগত দুর্ঘটনা পেশাগত ব্যাধির পরিচয়ঃ কর্মরত অবস্থায় অথবা ব্যবসার প্রয়োজনে কর্মস্থলের বাইরে অবস্থানকালে সংঘটিত কোন দুর্ঘটনায় শ্রমিক জখম প্রাপ্ত হওয়ার ঘটনায় পেশাগত দুর্ঘটনা। মানুষের আচরণগত প্রদান ও পরিবেশগত উপাদান দুর্ঘটনার নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। কর্মক্ষেত্রে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক বস্তু, ধুলি, ধোঁয়া, বা ক্ষতিকর কোন জৈব উপাদানের সংস্পর্শে দীর্ঘদিন যাবত কাজ করার ফলে শরীরে যে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তাই পেশাগত রোগ বা ব্যাধি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের শ্রম আইনে এমন ৩৩ প্রকার স্বাস্থ্য সমস্যাকে পেশাগত ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পেশাগত ব্যাধির বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে যা নির্ণয় হয় কাজের ধরন ও কাজের পরিবেশের উপর। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) পেশাগত ব্যাধির একটি তালিকা প্রকাশ করেছে এই তালিকাটিতে তিনটি ক্যাটাগরিতে পেশাগত ব্যাধির ধরন নির্ণয় করা হয়েছে;

১. কর্মীর কর্ম পরিবেশের উপর ভিত্তি করে (এজেন্ট ভিত্তিক); 
শারীরিক এজেন্ট (ফিজিক্যাল)  দ্বারা সৃষ্ট রোগঃ শব্দের কারণে শ্রবণ প্রতিবন্ধকতা; আয়নাইজিং বিকিরণ দ্বারা সৃষ্ট রোগ; লেজার সহ অপটিক্যাল (আল্ট্রাভায়োলেট, দৃশ্যমান আলো, ইনফ্রারেড) বিকিরণ দ্বারা সৃষ্ট রোগ; অত্যধিক তাপমাত্রার সংস্পর্শে আসার ফলে সৃষ্ট রোগ ইত্যাদি।

জৈবিক এজেন্ট (বায়োলজিক্যাল) এবং সংক্রামক বা পরজীবী দ্বারা সংঘটিত রোগঃ ব্রুসেলোসিস, হেপাটাইটিস ভাইরাস, হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি), টিটেনাস, যক্ষ্মা, অ্যানথ্রাক্স, কোভিড-১৯, লেপ্টোস্পাইরোসিস ইত্যাদি।

রাসায়নিক এজেন্ট (কেমিক্যাল) দ্বারা সৃষ্ট রোগ: ক্যাডমিয়াম, বেরিলিয়াম, ফসফরাস, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, পারদ, সীসা, ফ্লু ইউরিন বা এর যৌগ দ্বারা সৃষ্ট রোগ। কীটনাশক, অ্যামোনিয়া ও অন্যান্য কেমিক্যাল এজেন্ট দ্বারা সৃষ্ট রোগসমূহ।

২. টার্গেট অরগান সিস্টেম এর উপর ভিত্তি করে;
শ্বাসযন্ত্রের রোগ (নিউমোকোনিওসিস, ব্রংকাইটিস, অ্যাজমা/হাঁপানি ইত্যাদি); 
ত্বকের রোগসমূহ (এলার্জি, বিরক্তিকর যোগাযোগ ডার্মাটাইটিস, ভিটিলিগো ইত্যাদি); 
Musculoskeletal ডিসঅর্ডারস (রেডিয়াল স্টাইলয়েড টেনোসাইনোভাইটিস, ক্রনিক টেনোসাইনোভাইটিস, এপিকন্ডাইলাইটিস ইত্যাদি); 

৩. মানসিক এবং আচরণগত ব্যাধি (দুর্ঘটনা পরবর্তী মানসিক বৈকল্য, অন্যান্য মানসিক বা আচরণগত ব্যাধি);

৪. পেশাগত ক্যান্সার; নিম্নলিখিত এজেন্ট দ্বারা ক্যান্সার (অ্যাসবেস্টস, ক্রোমিয়াম, ভিনাইল ক্লোরাইড, আয়নাইজিং বিকিরণ, কোক ওভেন নির্গমন, কাঠের ধুলো, ক্যাডমিয়াম) সংঘটিত হয়।

উল্লেখযোগ্য পেশাগত ব্যাধির নাম ও কারণঃ উল্লেখযোগ্য পেশাগত ব্যাধির নাম ও কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হলে; এই তালিকাটি সিডিসি, সিসিওএইচএস, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর অকুপেশনাল হেলথ অ্যান্ড সেফটি (এনআইওএসএইচ), আইএলও এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের জন্য ইউরোপীয় সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে তৈরী করা হয়েছে।

ডার্মাটাইটিসঃ পেশাগত ব্যাধির মধ্যে চর্ম জনিত রোগ (অ্যালার্জিক এবং বিরক্তিকর ডার্মাটাইটিস) অন্যতম। এক রিপোর্টে দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেশাগত ব্যাধির ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হল চর্ম জনিত রোগ যা বিস্তৃত ঘটে শারীরিক, জৈবিক বা রাসায়নিক এজেন্টের মাধ্যমে। এই রোগ রোগীর দেহে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।

শ্বাসযন্ত্রের রোগঃ শ্বাসযন্ত্রের রোগ এর মধ্যে অ্যাজমা, ফুসফুসের রোগ এবং ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD) অন্যতম। OHCOW-এর মতে, হাঁপানি কানাডায় সবচেয়ে বেশি পেশাগত ফুসফুসের রোগ হিসেবে বিবেচিত । OHCOW বলে যে কর্মক্ষেত্রে ৩০০ টিরও বেশি রাসায়নিক বস্ত/দ্রব্য রয়েছে যা হাঁপানির কারণ হিসাবে পরিচিত। এই রোগটি গাড়ির যন্ত্রাংশ, ফোম এবং প্লাস্টিক উত্পাদন শিল্পে শ্রমিকদের বেশি সংক্রমিত করে। 

Musculoskeletal Disoders (MSDs)ঃ পেশাগত ব্যাধিরক্ষেত্রে এমএসডি (কারপাল টানেল সিন্ড্রোম বা টেন্ডোনাইটিসের মতো পুনরাবৃত্তিমূলক স্ট্রেন ইনজুরির (RSI)) অন্যতম। সাধারণত যারা অফিসিয়াল এনভায়রনমেন্টে (ডেস্কে) কাজ করেন তারা এই ব্যাধির শিকার হউন। এমএসডি বিকাশ লাভ করে অতিরিক্ত কাজের চাপ, একটানা কাজ করলে, সঠিকভাবে বিশ্রাম না নিলে, ক্রটিপূর্ণভাবে বসার ফলে।
শ্রবণ ক্ষমতার হ্রাসঃ একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে খনি, নির্মাণ এবং উত্পাদন শিল্পে শ্রমিকরা এই সমস্যার সম্মুখীন হন। শ্রবণশক্তি হ্রাস এবং শ্রবণশক্তির সমস্যাগুলি আতিথেয়তা এবং স্বাস্থ্যসেবা সেটিংসেও একটি বড় সমস্যা।

ক্যান্সারঃ  বিশ্বব্যাপী কর্ম সংক্রান্ত মৃত্যুর ২৪ শতাংশের জন্য দায়ী করা হয় ক্যান্সারকে। পেশাগত ক্যান্সার হয় যখন কর্মীরা তাদের কর্মক্ষেত্রে কার্সিনোজেনিক পদার্থের সংস্পর্শে থাকে। কার্সিনোজেন প্রাকৃতিকভাবে পরিবেশে ঘটতে পারে (যেমন সূর্যালোকে অতিবেগুনী রশ্মি এবং নির্দিষ্ট কিছু ভাইরাস) অথবা মানুষের দ্বারা উৎপন্ন হতে পারে (যেমন অটোমোবাইল এক্সস্ট ধোঁয়া এবং সিগারেটের ধোঁয়া)। অ্যাসবেস্টস-সম্পর্কিত রোগগুলি এখন পেশাগত ব্যাধির সবচেয়ে সুপরিচিত। এর মধ্যে রয়েছে ফুসফুসের ক্যান্সার, গ্যাস্ট্রো-অন্ত্রের ক্যান্সার, স্বরযন্ত্রের ক্যান্সার এবং মেসোথেলিওমা (একটি ক্যান্সার যা বেশিরভাগ অভ্যন্তরীণ অঙ্গকে আবৃত করে টিস্যুর পাতলা স্তরে ঘটে)।

স্ট্রেস এবং মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধিঃ মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাধিগুলিকে পেশাগত রোগ হিসাবেও বিবেচনা করা হয়। স্ট্রেস এবং মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধির মধ্যে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য। সাধারণত, সামরিক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও উচ্চ পদে আসন্ন লোকেরা এই ব্যাধির শিকার হন।

সংক্রামক রোগঃ সাধারণত স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা হেপাটাইটিস বি এবং সি, যক্ষ্মা (টিবি) এবং এমনকি হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি) এর মতো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। আরও উল্লেখযোগ্য যে সামাজিক পরিষেবা কর্মীরা টিবি সংক্রমনের ঝুঁকিতে থাকে কারণ তারা উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ জনসংখ্যার সাথে ক্রমাগত যোগাযোগ করে। এবং ল্যাব কর্মীরা সংক্রামক রোগ আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে থাকেন।


পেশাগত স্বাস্থ্যের বিপদ ও ঝুঁকির সাথে পরিচয়ঃ কর্মক্ষেত্রে কর্মীর নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে হলে বিপদ এবং ঝুঁকি সম্পর্কে ধারনা থাকা আবশ্যক। বিপদ হলো কর্মপরিবেশের এমন একটি ত্রুটিপূর্ণ উপাদান বা অস্বাভাবিক অবস্থা বা পদ্ধতি যা দুর্ঘটনা ঘটানো, ক্ষতি করা বা পেশাগত ব্যাধির সৃষ্টির কারণ হতে পারে।  ঝুঁকি হলো কর্মপরিবেশের বিদ্যমান পরিমাপযোগ্য এমন কোন বিপদজনক অবস্থা বা উপকরণ যা ব্যবহারিক পক্রিয়ায় বা আপনা থেকেই দুর্ঘটনা বা ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেমন ভবনে ফাটল সৃষ্টি হওয়া একটি বিপদ, এরুপ ফাটলযুক্ত ভবনে কাজ করা উচ্চমাত্রার ঝুঁকি রয়েছে, যেসব মার্কেটে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নেই সেসব মার্কেটে অগ্নিদুর্ঘটনার উচ্চমাত্রার ঝুঁকি রয়েছে, আবার যেসব কর্মীরা নিরাপত্তা/সেফগার্ডিং নির্দেশিকা সম্পর্কে অবগত নয় তারা তাদের কর্মস্থলে ঝুঁকিতে রয়েছেন। করোনাভাইরাস বর্তমানে বিশ্বে একটি বিপদ হিসেবে কাজ করছে ভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে যিনি বা যারা সেবা দিচ্ছেন তুলনামূলক বেশি মাত্রায় তিনি বা তারা সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। তাই কর্মপরিবেশের বিপদ ও ঝুঁকি পরিমাপ/নির্ণয় করার মাধ্যমে কর্মীর নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব। এবং এই ঝুঁকি কমিয়ে আনা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা কর্মী, নিয়োগকর্তা, গ্রাহক, অংশীজনসহ সবার দায়িত্ব।

কর্মীর পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক আইনি কাঠামোঃ কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের সামগ্রী কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে অনেকগুলো আইন প্রবিধান নীতিমালা রয়েছে। এসব আইনে অন্যান্য বিষয়ের সাথে পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক বিধান সন্নিবেশিত হয়েছে। এ সকল আইন ও বিধি বিধানে তালিকা নিচে দেওয়া হল;
বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ 
বাংলাদেশ শ্রম ও বিধিমালা-২০১৫ 
বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০২০ 
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ 
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭ 
অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন আইন-২০০৩ 
অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন বিধিমালা-২০১৪
শিপব্রেকিং এন্ড রিসাইক্লিং অ্যাক্ট- ২০১৮ 
শিপব্রেকিং এন্ড রিসাইক্লিং রুলস-২০১১ 
জাতীয় শিল্পনীতি-২০১০ 
জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০
জাতীয় শ্রমনীতি-২০১২ 
জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি নীতিমালা-২০১৩ 

নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং শ্রমিকের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৭ অনুচ্ছেদ-১৪, অনুচ্ছেদ-২০ সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কনভেনশন ১৫৫, ১৮৭, ১৬১, প্রটোকল ১৫৫ এবং সুপারিশমালা ১৬৪ ও ১৯৭ কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে । এছাড়াও জাতিসংঘ ঘোষিত অভিবাসী শ্রমিক কনভেনশন ১৯০, সম্প্রতি ঘোষিত কনভেনশন ১৮৯ এবং সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা অন্যতম দলিল। তাছাড়া ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৬০ তম সম্মেলন Global Plan of Action of Workers Health 2008-2007 বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ৫টি উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল।

সর্বোপরি জাতিসঙ্ঘ ২০১৬ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের রোড ম্যাপ ঘোষণা করেছে। ইতোমধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য নির্ধারিত সময় সীমার দুই-তৃতীয়াংশ সময় অতিবাহিত হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টি লক্ষ্যের ৮ নম্বর লক্ষ্য হচ্ছে শোভন কাজ বাস্তবায়ন। শোভন কাজের অন্যতম শর্ত হচ্ছে কর্মক্ষত্রে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটঃ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ বলছে (২০১৬-১৭), দেশে মোট শ্রমশক্তি রয়েছে পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে কাজ করছে পাঁচ কোটি ৫১ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে বস্ত্র ও পোশাক খাতে কাজ করে ৪০ লাখ শ্রমিক। এই পরিসংখ্যানেও দেখা যায়, বিপুলসংখ্যক শ্রমিক পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশের শ্রম আইনে বলা হয়েছে, ৫০ অথবা এর বেশি কর্মী কাজ করে এমন সব প্রতিষ্ঠানে সমান সংখ্যক মালিক ও কর্মী প্রতিনিধিদের নিয়ে সেফটি কমিটি গঠনের কথা। পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি নীতিমালা প্রণয়ন, সেফগার্ডিং নীতিমালা প্রণয়ন, নীতিমালার অরিয়েন্টশন, প্রচার ও বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ। এই কমিটি, নীতিমালা কর্মক্ষেত্রের ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিবে, দুর্ঘটনা ঘটলে সাড়া দিবে, যাতে করে নিরাপদ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করা যায় ও ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায্যতা আদায় হয়। কিন্তু বাস্তবিকক্ষেত্রে অনেক প্রতিষ্ঠানে এই কমিটি ও নীতিমালা অনুপস্থিত যার ফলে কর্মীর পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত। দেখা যায় দুর্ঘটনার পর সবকিছু নেড়েছড়ে বসে, কিছুদিন পর আবার সবকিছু তলিয়ে যায় বা আপোষ হয়ে যায়। গত দশকে বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলিতে এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে,২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরিন ফ্যাশনসে আগুন,২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধস, ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াল অগ্নিদুর্ঘটনা,২০১৯ সালের ২৮ মার্চ দুপুরে ঢাকা, বনানির এফআর টাওয়ারে আগুন, ২০২৩ সালে ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটে আগুন ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। এসব কাঠামোগত দুর্ঘটনার পাশাপাশি অনেক মানবিক দুর্ঘটনাও ঘটে প্রতিষ্ঠানে যেমন, যৌন হয়রানি, শারিরীক অত্যাচার, মানসিক নির্যাতন, বোলিং, অবহেলা, নিপীড়ন, বৈষম্য ও শোষণ ইত্যাদি। এরকম অসংখ্য ঘটনা নিত্যনৈর্মিত্তিক ঘটে চলেছে যেগুলোর কারণগুলো খুব কাছাকাছি।  এমন দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি ও প্রানহাণির জন্য প্রধানত আমাদের অজ্ঞতা ও অসচেতনতাই দায়ী। আমরা একটু সচেতন হলেই অধিকাংশ সংঘটিত দুর্ঘটনা এড়াতে সক্ষম হতাম।  তাই আমি বলব, যথাযথভাবে কর্মক্ষেত্রের কাঠামো উন্নয়নের/নির্মাণ (ভবন নির্মাণ, এবং কারখানা ও রাসায়নিক গুদামের ঝুঁকিমুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ঝুঁকি নির্ণয়) ও কর্মস্থলে কর্মীর অধিকার ও মর্যাদা সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ ও নিরাপত্তা/সেফগার্ডিং পলিসি প্রণয়ন (জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সমন্বয় করে) ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সচেতন করে তুলতে পারলে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। নিশ্চিত করা সম্ভব কর্মীবান্ধব কর্মপরিবেশ, যেখানে সকলে অধিকার মর্যাদা নিয়ে কাজ করবে, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সুনাম, খ্যাতি ও স্থায়ীত্বশীলতা আনয়নে সচেষ্ট হবে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে আমার এই আহবান ও প্রত্যাশা। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়টি আজ অপরিহার্য।

রেফারেন্সঃ
https://www.dailynayadiganta.com/news/printarticle/744061
https://bn.approby.com
https://www.prothomalo.com/bangladesh/
https://mywage.org.bd/labour-laws/health-and-safety-at-work
https://bangla.bdnews24.com/opinion/comment/56004
https://www.who.int/health-topics/occupational-health#
https://www.ecoonline.com/glossary/occupational-health