শুক্রবার, ১২ মে, ২০২৩

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ইপসা’র ৩৮ বছর

দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বেসরকারি সমাজউন্নয়নমূলক সংস্থার কার্যক্রমকে উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণণা করা হয়। বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়ন, সীমিত সম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণে বেসরকারি সমাজউন্নয়নমূলক সংস্থার ভূমিকা অপরিসীম। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীতে যুদ্ধবিধস্ত রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্র যেমন এগিয়ে আসে তেমনি ত্রাণ ও পুনবার্সন কার্যক্রমে বেসরকারিভাবে কর্মকান্ড চলতে থাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। ত্রাণ ও পুনবার্সন কার্যক্রম শক্তিশালী করার জন্য ১৯৭২ সালে গঠিত হয় ব্রাক। এরপর ১৯৭৬ সালে প্রশিকা ও গ্রামীণ ব্যাংক গঠিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠান ত্রাণ পুনবার্সনের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়ননে গুরুত্বারোপ করে। আশির দশকে বেসরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রম ইস্যুতে পরিবর্তন আসে। তার প্রেক্ষাপটের কারণ ছিল সামরিক শাসন ও সকল স্তরে সামরিকায়নের ফলে ঐ সময় দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে দুর্দশা তৈরি হয়। এই অবস্থার থেকে উত্তরণের জন্য তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশে বেশ কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও ‍সিভিল সোসাইটির জন্ম নেয়, তাদের মধ্যে ইপসা (ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল এ্যাকশান) অন্যতম।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯০ সালকে “যুব দশক” ও ১৯৮৫ সালকে “আন্তর্জাতিক যুব বর্ষ” ঘোষনা করে। উন্নয়ন ও মানবিক কর্মসূচীতে যুবকদের সম্পৃক্ত করতে ব্যাপক প্রচারনার ব্যবস্থা নেয়া হয়। এমনি প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার কয়েকজন সমাজ সচেতন যুবক ইপসা’র প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নির্বাহী মোঃ আরিফুর রহমানের নেতৃত্বে একটি উন্নয়ন সংগঠন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এলাকার যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করে। আর এভাবেই “১৯৮৫ সালের ২০ মে” সচেতন যুবকদের সক্রিয় উদ্যোগে সমাজ উন্নয়ন সংগঠন “ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল এ্যাকশন (ইপসা)’র পদযাত্রা শুরু হয়। কালের পরিক্রমায় ও সময়ের সাথে পালা দিয়ে ইপসা (ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল এ্যাকশন) বিশ্বস্ততা অর্জন করে লক্ষিত জনগোষ্ঠির ও নিবন্ধন লাভ করেন বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের, আস্থা অর্জন করে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার। ইপসা’র ভিশন হলো “এমন একটি দারিদ্রমুক্ত সমাজ যেখানে সকলের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে।” তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে সংগঠিত করে বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নে কাজ করে যাচ্ছে ইপসা। দেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাড়া প্রদান ও পুনবার্সন, পরিবেশ সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা, স্বাক্ষরতা হার বৃদ্ধি, শিক্ষার মান উন্নয়ন, স্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা, কোভিড-১৯ সাড়া, শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা, যুবদের ক্ষমতায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শোভন কর্মপরিবেশ সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, মূলধন গঠন, জাতীয় আয় বৃদ্ধি, বলপূর্বক স্থানচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের মানবিক সাড়া প্রদান ও শিশু, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে ইপসা। ১৯৮৫ সালে ইপসা তার যাত্রা শুরু করে বর্তমানে প্রায় ০৩ হাজার কর্মী সারাদেশে ১৪ মিলিয়ন মানুষের জীবন সংগ্রামে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

ইপসা’র মূল্যবোধ

  • দেশপ্রেম এবং জাতীয় স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় গৌরবের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা
  • ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা
  • পারষ্পরিক শ্রদ্ধা এবং জেন্ডার বান্ধব মনোভাব সম্পন্নতা
  • মান সম্পন্নতা এবং উৎকর্ষতা
  • বিনম্রতা এবং আত্মবিশ্বাস
  • বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ
  • পরিবেশ এবং প্রতিবেশের প্রতি সহমর্মিতা

সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্য
  • পারিবারিক পরিবেশ
  • দায়িত্ব সচেতনতা
  • ব্যয়সাশ্রয় নীতি
  • গঠনমূলক সমালোচনা ও সংস্থার পরিচিতি প্রসার
  • বিভিন্ন জাতি ধর্ম ও বর্ণ’র সাম্য ও সমপ্রীতি
  • সুস্থ বিনোদন
ইপসা’র কার্যক্রমঃ
ইপসা’র কার্যক্রমকে ছয়টি থিমে ভাগ করা হয়, যথা;
  • শিক্ষা
  • স্বাস্থ্য
  • পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন
  • অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন
  • মানবাধিকার ও সুশাসন
  • দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও মানবিক সাড়া প্রদান
উক্ত উন্নয়ন থিমের আওতায় বর্তমানে ইপসা’র সকল উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

লিংক অরগানাইজেশন সমূহঃ
  • আইসিটি এন্ড রিসোর্স সেন্টার অন ডিসএ্যাবিলিটিস (আইআরসিডি)
  • ইপসা- সেন্টার ফর ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট (ইপসা-সিওয়াইডি)
  • ইপসা- ডেভেলপমেন্ট রিসোর্স সেন্টার (ইপসা-ডিআরসি)
  • ইপসা- পরিচালিত স্কুল সমূহ (এভারগ্রীন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, কাজী পাড়া শিশু নিকেতন ও আলেকদিয়া শিশু নিকেতন)
  • ইপসা মানব সম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্র (ইপসা এইচআরডিসি)
  • রেডিও সাগর গিরি এফ এম ৯৯.২
  • ইন্টারনেট রেডিও দ্বীপ
  • কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
সম্মাননা ও স্বীকৃতিঃ
সুদীর্ঘ ৩৮ বছরের পথচলায়, ইপসা জয় করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির বিশ্বস্ততা, সরকার ও দাতা জনগোষ্ঠির আস্থা। ইপসা তার কার্যক্রমের মাধ্যমে অবদান রাখছে স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা থেকে বৈশ্বিক লক্ষমাত্রা অর্জনে। তার স্বীকৃতিস্বরুপ স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অর্জন করে বেশ সম্মাননা ও স্বীকৃতি। নিম্নে বিশেষ কিছু সম্মাননা ও স্বীকৃতির নাম উল্লেখ করা হল;
  • তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিবন্ধী নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য ২০২১ সালে WSIS Prize অর্জন করে।  
  • দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পাঠ উপযোগী বই তৈরীর জন্য, ইপসা ২০২০ সালে  জিরো প্রজেক্ট এওয়ার্ড অর্জন করে। জাতিসংঘ সদর দপ্তর অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় এই এওয়ার্ড প্রদান করা হয়।
  • ২০২০ সালে ইপসা নয়া দিল্লি, ভারত থেকে  ই-এনজিও চ্যালেঞ্জ এওয়ার্ড অর্জন করে।
  • নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতকরনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়, চট্টগ্রাম ইপসাকে চট্টগ্রাম জেলায় শ্রেষ্ঠ বেসরকারি সংগঠন ২০২০ সম্মাননা প্রদান করে।
  • তামাক নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অবদান রাখার জন্য, তামাক বিরোধী জাতীয় প্লাটফর্ম ও পিকেএসএফ, ইপসাকে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ পদক ২০১৯ প্রদান করে।
  • ইপসা ২০১৮ সালে বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদক অর্জন করে।
  • সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তর কর্তৃক ইপসা ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে সেরা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা স্বীকৃতি সম্মাননা লাভ করে।
  • প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ডিজিটাল ক্ষমতায়নে ইপসা, ২০১৮ সালে ইউনেস্কো-আমির আল আহমেদ আল জাবের সম্মাননা লাভ করে (প্যারিস, ফ্রান্স)।
  • ইপসা ইনোভেটিব সার্ভিস ডেলিভারির জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিল বিকন এওয়ার্ড ২০১৭ অর্জন করে। 
  • ইপসা, দৃষ্টি ও পঠন প্রতিবন্ধী শিক্ষাথীদের রিডিং মেটেরিয়ালস তৈরীর স্বীকৃতিস্বরূপ ডব্লিউএসআইএস এওয়ার্ড অর্জন করে ২০১৭ সালে।
  • ইপসা ২০১০ সালে নয়া দিল্লি, ভারত হতে আর্ন্তজাতিক মন্থন এওয়ার্ড অর্জন করে ।
  • জাতিসংঘ এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (UN-ECOSOC) কর্তৃক কনসালটেটিভ স্ট্যাাটাস অর্জন করে ২০১৩ সালে ।
  • যুব ও উন্নয়ন কর্মসুচিতে অনবদ্য ভূমিকা রাখায়  ইপসা  ১৯৯৯ সালে আর্ন্তজাতিক যুব শান্তি পুরস্কার  অর্জন করে।
আমাদের বিশ্বাস ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ ‍ও অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণে ইপসা’র এই ধারা অব্যাহত থাকবে। সমাজের অসঙ্গতিগুলো নিরসনে ইপসা স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের কার্যক্রমগুলো চলমান রাখবে। একটি সাম্য, মর্যাদা ও ন্যায্যতার পৃথিবী বিনির্মাণে ইপসা’র এই ধারা অব্যাহত থাকুক, ইপসা’র ৩৮ বছর পূর্তিতে এটি আমাদের কামনা।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন