শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

বাংলাদেশে ঋতুভেদে রোগের প্রার্দুভাব ও করণীয়

পরিবেশ, জলবায়ু এবং ভৌগলিক অবস্থান যেমন রোগর বিস্তার ও বৈচিত্রে ভূমিকা রাখে তেমনি ঋতু পরিবর্তনও রোগের বিস্তার ও বৈচিত্রে ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ ছয় ঋতুর একটি দেশ। জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে এখনশুধু তিনটি ঋতু দৃশ্যমান হয় যেমন, গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মাঝে নানা রোগব্যাধির প্রবণতা দেখা যায়। এমনকি দিনে অথবা রাতে; সকালে কিংবা দুপুরে; বিকেলে অথবা সন্ধ্যায় কোন কোন রোগের প্রবণতা দেখা যায়। ঋতুর এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিশুসহ সব বয়সের মানুষের মধ্যে রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। তার মধ্য শিশু ও প্রবীণরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে রোগাক্রান্ত হওয়ার। ঋতুর বৈশিষ্টগত পরিবর্তন রোগের নানা উপলক্ষকে ত্বরান্বিত করে, যার ফলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ বেড়ে যায়।

ঋতুর এই পরিবর্তনের সঙ্গে রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির সম্পর্কে জনস্বাস্থ্য বিশেজ্ঞরা বলেন ঋতুর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশে তাপমাত্রার তারতম্য আসে। আর এই তারমাত্রার তারতম্য নানা ধরণের রোগ জীবাণুর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলে। তাই দেখা যায় ফ্লু ও অন্যান্য ভাইরাসজনিত নানা রোগে খুব সহজেই মানুষ আক্রান্ত হয়।

গ্রীষ্মকালে (মার্চ-জুন) প্রচন্ড তাপ ও আর্দ্রতা পরিবর্তনের ফলে শরীরে প্রচুর ঘাম হয়  ও পানি শূন্যতা দেখা দেয়। অতিরিক্ত এই ঘামের ফলে মানুষের শরীরে নানা জীবাণুর সংক্রমণ হয়, যা বিভিন্ন অসুস্থতা ও জ্বরের খুব স্বাভাবিক কারণ। গরমকালে কারো কারো অ্যালার্জির সমস্যা বেড়ে যায়। ধুলাবালুর ফলে চোখ জ্বালাপোড়া দেখা দেয়, চোখে ভাইরাসজনিত রোগের সংক্রমণ হয়। এছাড়া পেটের নানা সমস্যাও অতিরিক্ত গরমে বেড়ে যায়। গরমে সাধারণত মানুষ বাইরের খাবার বা পানীয় বেশি খাওয়া হয়, ফলে পেটের সমস্যা বিশেষ করে নানা পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায় যেমন ডাইরিয়া, জন্ডিস ইত্যাদি। মার্চ-জুন পর্যন্ত এইসব রোগের প্রার্দুভাব বেশি থাকে।

বর্ষাকাল (জুলাই-অক্টোবর), আর্দ্রতার জন্য চর্মরোগ, খোঁজ-পাচড়া, একজিমা ইত্যাদিতে আক্রান্ত হবার প্রবণতা বেশি থাকে। বর্ষার আর্দ্র আবহাওয়ায় কনজাংটিভাইটিসের (চোখ উঠা) মতো কিছু চোখের সমস্যার ঝুঁকি রয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেজ্ঞরা বলেন বৃষ্টি আর গরমের সমন্বয়ে কনজাংটিভাইটিসের ঝুঁকি বাড়ে। এই সময়ে লক্ষ্য করা যায় বাংলাদেশে প্রতি দশজনে একজন এই রোগে আক্রান্ত। চোখ উঠা একটি ভাইরাসজনিত ইনফেকশন। চোখে প্রদাহ হলে চোখের পানিতে ভাইরাস ভেসে বেড়ায়। যখন এই অশ্রু মুছতে যাই, তখনই এটি আমাদের হাতে এসে যায়। এরপর থেকেই সেই হাত দিয়েই আমরা যা কিছুই ছুঁই না কেন, সেখানে ভাইরাস চলে আসে। তাই এই সময় খুবই সতর্ক থাকতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলে এই রোগ থেকে অনেকটা নিস্তার দিতে পারে। এই সময় শিশুদের মধ্যে আরেকটি রোগ দেখা দেয় তা হল হ্যান্ড–ফুট–মাউথ। এটি একটি ভাইরাসবাহিত রোগ  ও খু্ব সংক্রামক। এই সময় মশাবাহিত কারণে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার প্রার্দুভাব বেড়ে যেতে পারে। এই সমস্ত রোগের প্রার্দুভাব দেখা দিলে ভীতির কোন কারণ নেই। সচেতন হতে হবে,  পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে ও চিকিৎসকের পরামর্শ মানতে হবে।

শীতকালে (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারী) শুষ্কতার জন্য অ্যালার্জির প্রবণতা অনেক বেড়ে যায়। শুষ্কতায় ত্বক ফাটা, অ্যাকজিমা, সোরিয়াসিস ছাড়াও ঠান্ডা, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যাও বেড়ে যায়। এই সময় শিশুরা ও বয়স্করা বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে আসে ফ্লু জাতীয় বিভিন্ন ছোঁয়াচে রোগ যা খুব দ্রুত একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে। ঠান্ডা বা সর্দির জন্য দায়ী রাইনো ভাইরাস বা করোনা ভাইরাসও একটু ঠান্ডা আবহাওয়া থাকলেই দ্রুত ছড়ায়। আবার শীতের শুষ্ক বাতাসে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বিস্তার ঘটে দ্রুত এবং সংক্রমণ হওয়ার প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করে। ব্যাক্টেরিয়াজনিত ইনফেকশন এবং সাইনাস এর সমস্যাও এই সময় বেড়ে যায়। শুকনো বাতাসে ধুলাবালি বেড়ে গিয়ে নানা ধরণের অ্যালার্জির সমস্যাও সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে বাতাসের সাথে সংশ্লিষ্ট যেসব রোগ-ব্যাধি তার প্রকোপ ঐসময় বেড়ে যায়। নভেম্বর-ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত এইসব রোগের প্রার্দুভাব বেশি থাকে।

আমাদের যাঁদের ঋতুর পরিবর্তনের সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্যা রোগ-ব্যাধির প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার সমস্যা আছে তাঁরা প্রাথমিকভাবে নিজেরাই অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারেন। যে ঋতু বা যেসব জিনিস সহ্য হয় না ঐ ঋতু বা ঐসব জিনিস খুঁজে বের করা এবং সে সময় সতর্ক থাকা এবং ঐ জিনিসগুলো এড়িয়ে চলা উত্তম। যেমন যদি কারো গরম কিছু সহ্য না হয়, তাহলে সব সময়ই গরম কিছু থেকে সতর্ক থাকা। যদি কারো শীত বা ঠান্ডা সহ্য না হয় তাহলে ঠান্ডা যা কিছু থেকে সতর্ক থাকা এমন আর কি। আর যাঁদের যে খাবারে এলার্জি আছে তা পরিহার করে চলা। এমন সব ক্ষেত্রে পরিবারের লোকজন এবং নিজে অনেক সমস্যাই মিটিয়ে ফেলা যায়। প্রতিবছর একই সময়ে একই ধরনের রোগ যাঁদের হানা দেয় তাঁরা আসলে চিররোগের পর্যায়ভুক্ত। সে কারণে এমন ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী চিকিৎসা নেয়া দরকার, সাময়িক চিকিৎসা তাঁদের জন্য তত ফলপ্রসূ হবে না। কারণ, চিররোগগুলো শরীরের মধ্যে ধীরে ধীরে বাসা বাঁধে। যে রোগগুলি হঠাৎ দেখা দেয় সেসব ক্ষেত্রে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠা এবং মৃত্যুবরণ করা দুটোই কিন্তু আছে। কিন্তু চিররোগের ক্ষেত্রে চিররোগের ধারাক্রম অনুসরণ করেই চিকিৎসা নিতে হবে। প্রারম্ভেই যদি রোগ শনাক্ত করা যায় তাহলে তার প্রতিকার পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু রোগ যদি আরোগ্যের পর্যায়সীমা অতিক্রম করে তাহলে কোন চিকিৎসক কিংবা ওষুধের পক্ষেই তা আরোগ্য করা সম্ভব নয়। শত চেষ্টায় হয়তো কিছুটা সাময়িক উপশম দেয়া যাবে। তাই যে কোন ধরনের শারীরিক পরিবর্তন ও লক্ষণ সম্বন্ধে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। কারণ, প্রতিটি রোগেরই নির্দিষ্ট লক্ষণ থাকে। রোগ লক্ষণ মানুষের ভোগান্তি নয় উপকার করে, লক্ষণ কোন মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে না, ডাক্তার দেখানোর ইঙ্গিত দেয়। তবে যদি কেউ একটি বা দু’টি লক্ষণ ধরে তার গোড়ায় না গিয়ে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে তাহলে কিন্তু প্রকৃত রোগ আরোগ্য দুরূহ হয়ে পড়ে। তাই সেদিকেও লক্ষ্য রাখা জরুরি।

তাই ঋতু পরিবর্তনের সময় সুস্থ থাকার জন্য চাই সচেতনতা, পর্যাপ্ত ঘুম, শরীরচর্চা ও পরিচ্ছন্ন থাকা। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে যা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলবে।

রেফারেন্সঃ

https://www.ntvbd.com/health/ ঋতু-পরিবর্তনের-সময়-যেসব-রোগ-হয়

https://www.risingbd.com/feature/news/284036

https://www.womennews24.com/ ঋতু-পরিবর্তনের-রোগ-ব্যাধি/

https://www.jaijaidinbd.com/feature/health/85362/ ঋতুর-পরিবর্তনে-রোগব্যাধি-কেন-বাড়ে

https://bn.wikipedia.org/wiki/ চোখ_উঠা




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন