রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০২৪

স্বাস্থ্য সেবা, আমার অধিকারঃ পলিসি, চর্চা ও করনীয়

অধিকার একটি বৈধ দাবী, যা দেশের শাসনসতন্ত্র, নীতিমালা, আর্ন্তজাতিক চুক্তি ও সংবিধান দ্বারা সংরক্ষিত। স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক মানবাধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম। স্বাস্থ্য সর্বজনীনভাবে মানব উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসাবে ও স্বীকৃত। 

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব এবং অনুচ্ছেদ ১৮ (১) অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যের উন্নতি করা, রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্তব্য বলা হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলমা-আতা ঘোষণা, জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ২৫ (১), শিশু অধিকার সনদ, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণের কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী দেশ।  এই সমস্ত আন্তর্জাতিক সনদে স্বাস্থ্যকে একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বর্তমান সরকার নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০০০ মূল্যায়ন করেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পরিমার্জন ও সম্প্রসারণ করে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১ চূড়ান্ত করেছে।  স্বাস্থ্য যখন মানুষেরর মৌলিক মানবাধিকার, তখন রাষ্ট্রকে অবশ্যই চারটি মূল উপাদান বিবেচনা করে স্বাস্থ্য নীতি ও সেবা নিশ্চিত করতে হয় যেমন;

পর্যাপ্ততাঃ স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলির প্রাপ্যতার জন্য  একটি দেশ তার অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে তার জনগোষ্ঠির জন্য প্রয়োজনীয়  স্বাস্থ্যসেবার সুবিধাগুলি নিশ্চিত করবে। 

প্রবেশগম্যতাঃ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সবার কাছে সহজলভ্য ও প্রবেশগম্য করা। স্বাস্থ্য সেবায় প্রবেশগম্যতার ক্ষেত্রে চারটি বিষয় বিবেচনা করতে হয় যেমন; বৈষম্যহীনতা, শারীরিক প্রবেশগম্যতা, অর্থনৈতিক প্রবেশগম্যতা (সাধ্যের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা), স্বাস্থ্য তথ্যের  প্রবেশগম্যতা। 

গ্রহণযোগ্যতাঃ স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলি নৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে উপযুক্ত হতে হয়। 

গুণগতমানঃ স্বাস্থ্য পরিষেবা অবশ্যই বৈজ্ঞানিক এবং চিকিৎসাগতভাবে অনুমোদিত হতে হয়। গুণগতমান হল ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজের একটি মূল উপাদান । মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলোকে মানতে হয় যেমন; নিরাপদ, কার্যকরী, জন-কেন্দ্রিক, সময়মত, ন্যায়সঙ্গত, ইন্টিগ্রেটেড , দক্ষ।

উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করে, বাংলাদেশের জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি নির্ণয় করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১ এর লক্ষ্য হলোঃ  সকলের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং জরুরি স্বাস্থ্য সেবার প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা; সাম্যতার ভিত্তিতে সকলের জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য-সেবা নিশ্চিত করা ও সেবার পরিধি প্রসারিত করা;  অধিকার এবং মর্যাদা বিবেচনা করে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা বাড়ান। জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি-২০১১ এর প্রাধান্য বিষয়গুলো হলো; সমাজের সকল স্তরে স্বাস্থ্যসেবাকে একটি অধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা, জনস্বাস্থ্যের ও পুষ্টির উন্নতির উপাদানগুলি নিশ্চিত করা, শহর ও গ্রাম  নির্বিশেষে সবার জন্য মানসম্পন্ন এবং সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, প্রতি ৬০০০ জনসংখ্যার জন্য একটি করে কমিউনিটি  ক্লিনিক স্থাপন করা, জরুরী স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি করা; মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা; মা ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিশ্চিত করা এবং প্রতিটি গ্রামে নিরাপদ প্রসবের পরিষেবা নিশ্চিত করা; পরিবার পরিকল্পনা পরিষেবাগুলির সহজলভ্যতা এবং প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা, বিশেষ করে দরিদ্র এবং নিম্ন আয়ের মানুষদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া; স্বাস্থ্য সেবায় লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করা; স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় তথ্য প্রযুক্তির কার্যকর ও দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা; মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য সরকারি স্বাস্থ্যসেবার সুবিধাগুলিতে পর্যাপ্ত রসদ ও জনবলের সরবরাহ নিশ্চিত করা; বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি এবং চিকিৎসা খরচ নিয়ন্ত্রণ; দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা শিক্ষা ও প্রযুক্তির আধুনিকায়ন ও অভিযোজন নিশ্চিত করা; সরকার এবং এনজিওগুলির মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করা; প্রতিরোধমূলক পরিষেবাগুলিকে শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে টিকাদান কর্মসূচি উন্নতি করা; স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত তথ্যের অবাধ প্রবেশগম্যতা; ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করে প্রয়োজনীয় ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা; স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলির ট্র্যাকিং করা; এবং সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যসেবা (ইউনানি, আয়ুর্বেদ এবং হোমিওপ্যাথিক) শিক্ষা এবং ব্যবস্থার উন্নতি নিশ্চিত করা।

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে, ৯০টি আইন স্বাস্থ্য বা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। এই আইনগুলোকে রিভিউ করলে দেখা যায় সমস্ত বিষয়াদি সাতটি বিস্তৃত বিষয়ের অধীনে পড়ে যেমন; গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধন এবং কল্যাণ আইন, জনস্বাস্থ্য, সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য অনুশীলন, পরিবেশগত স্বাস্থ্য, এবং শিশু ও মহিলাদের সুরক্ষা।

তাছাড়াও বৈশ্বিক উন্নয় লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) বিভিন্ন লক্ষ্য ও সূচকে স্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্যের কথা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে, যেমন লক্ষ্য-০৩ (সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ) সরাসরি স্বাস্থ্যসেবা ও অধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এসডিজি লক্ষ্য-০৩ এর টার্গেট ৩.১ ও ৩.২ বলা হয়েছে,  ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে মাতৃমৃত্যুর হারের অনুপাত প্রতি লাখে ৭০ এর নিচে নামিয়ে আনা ও জীবিত ৫ বছরের শিশুর মৃত্যুর  হারের অনুপাত প্রতি লাখে ২৫ এর নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। অন্যান্য এসডিজি লক্ষ্য ও সূচকেও স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্যকর জীবন নিশ্চিত করার ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়েছে যেমন; দারিদ্র্য বিলোপ (এসডিজি ১); ক্ষুধা মুক্তি (এসডিজি ২), নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন (এসডিজি ৬)  নারী এবং মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা দূর কর(এসডিজি  ৫.২.১) ও অসমতার হ্রাস (এসডিজি ১০)।

WHO কাউন্সিল অন দ্য ইকোনমিক্স অফ হেলথ ফর অল মতে, বিশ্বে অন্তত ১৪০ টি দেশ তাদের সংবিধানে স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবুও সে দেশগুলি তাদের জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিত করতে পারেনি এবং নিশ্চিত করার জন্য সহায়ক আইনগুলি অনুশীলন করছে না।  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০২১ সালে বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি জনগোষ্ঠি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলির কভার করা হয়নি, যদি সে সমস্ত দেশে স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে এবার ২০২৪ সালের ০৭ এপ্রিল উদযাপিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব স্থাস্থ্য দিবস, এই বছর দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো আমার স্বাস্থ্য, আমার অধিকার'। বাংলাদেশ এবছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘স্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিতে কাজ করি একসাথে’। এই বছরের থিমটি প্রত্যেকের অধিকার, সর্বত্র মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা এবং তথ্য, সেইসাথে নিরাপদ পানীয় জল, বিশুদ্ধ বায়ু, পুষ্টি, মানসম্পন্ন আবাসন, শালীন কাজ এবং পরিবেশগত অবস্থা এবং স্বাধীনতা পাওয়ার অধিকারকে বেছে নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা  সরকার বা পাবলিক সেক্টরের উপর অনেক বেশি নির্ভর করে, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি অনেক উদ্যেক্তা এই খাতে এগিয়ে এসেছে ও ভালো করছে। বিগত এক দশকে এই খাতের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, তবে করোনাকালীন সময়ে দেখা গেছে এই খাতের ব্যাপক উন্নয়নের চাহিদা ও বাস্তবতা। নিম্নের আলোচনায়, এই খাতের চলমান অবস্থা ও প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করা হলো, আলোচিত বিষয়গুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিক সমাধান হতে পারে, স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন ও অধিকারের বাস্তবায়ন।

সীমিত পাবলিক ফ্যাসিলিটি
স্বাস্থ্য সেবাখাতে বাংলাদেশে পাবলিক ফ্যাসিলিপির উন্নয়নের বেশ সুযোগ রয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অধীনে সারা দেশে মোট ১৮,০০০ কমিউনিটি ক্লিনিক আছে, যেখানে প্রতি ৬০০০ জনের একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক থাকার কথা রয়েছে (জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি-২০১১ )। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য সারাদেশে উপজেলা পযায়ে ৪৭২টি সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা কেন্দ্র বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে,যেখানে বাংলাদেশে মোট উপজেলার সংখ্যা  ৪৯৫ টি। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পরিচর্যা কেন্দ্রগুলোতে  মোট শয্যার সংখ্যা প্রায় ১৮,৮৮০ টি।সারা বাংলাদেশে ১২৬ টি সেকেন্ডারি এবং টারশিয়ারি কেয়ার সুবিধা রয়েছে। সেকেন্ডারি এবং টারশিয়ারি পাবলিক কেয়ার সুবিধাগুলিতে মোট শয্যা রয়েছে ২৭,০৫৩টি। বেসরকারি খাতে ২৯৮৩ টি নিবন্ধিত হাসপাতাল রয়েছে। এই হাসপাতালে মোট ৪৫,৪৮৫টি শয্যা রয়েছে। এই সীমিত ফ্যাসিলিটি মনে করিয়ে দেয় করোনা’র প্রারম্ভীক সময়ের ভয়াবহতা, যেমন রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত শয্যার অভাব, আইসিইউ অভাব ইত্যাদি।

সারাংশে, দেখা যায়, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতোলে প্রতি ১০০০ জনসংখ্যার জন্য ০.৩২ শয্যা বরাদ্দ রয়েছে; যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশে বলা হয়েছে, সরকারী হাসপাতালে প্রতি ১০০০ জনসংখ্যার জন্য ৩.৫ শয্যার ব্যবস্থা রাখা।

ভারসাম্যহীন স্বাস্থ্য সেবা ও অধিক চিকিৎসা খরছ
সরকারি হাসপাতালে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি অন্যান্য সুবিধাগুলি বিনামূল্যে হওয়ার কথা থাকলেও, রোগীদের ওষুধ এবং ল্যাবরেটরি পরীক্ষার খরচ নিজে বহন করতে হয়, সেইসাথে কিছু অতিরিক্ত অপ্রদর্শিত খরচও বহন করতে হয়। এই খরচগুলি গরীব এবং সুবিধাবঞ্চিতদের গুনগত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে গুরুতরভাবে বাধা সৃষ্টি করছে। অনেক ক্ষেত্রে গুরুতর রোগীরা অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রাপ্ত থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। গবেষণায় দেখা যায়, স্বাস্থ্যসেবার খরচের প্রায় ৬৬% ব্যক্তি এবং পরিবারের দ্বারা বহন করা হয়, যা আউট অব পকেট এক্সপেন্স ,যেটি রোগীকে দারিদ্রতার দুষ্ট চক্রে ফেলে দিচ্ছে। 

সংক্ষেপে বলা যায়, স্বাস্থ্য সেবায় জনস্বাস্থ্য নীতি অনুশীলনের মধ্যে একটি গ্যাপ রয়েছে যা গরীব এবং সুবিধাবঞ্চিতদের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি করছে, যার ফেলে, দেশর জনগণ সাংবিধানিক অধিকার ও ন্যায্যতার আদায় হতে বঞ্চিত হচ্ছেন । 

স্বাস্থ্যসবা কেন্দ্রগুলিতে প্রয়োজনীয় উপকরনের অভাব
বেশিরভাগ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, বিশেষ করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং জেলা হাসপাতালে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য উপকরণ সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সগুলির রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বা জ্বালানির অর্থের কারণে প্রায়শই  অকার্যকর হয়ে থাকা। এক্স-রে মেশিন, ইনকিউবেটর ও বিভিন্ন ল্যাবের যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকার্যকর হয়ে থাকা। বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং পরিবার পরিকল্পনার পণ্যগুলি চুরি করে বেসরকারী খাতের বিক্রি হওয়া। স্থানীয় পর্যায়ে চিকিৎসা সেবায় দক্ষ জনবলের ঘাটতি রয়েছে। যার ফলে, রোগির প্রয়োজনের সময় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা অনেকক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়াও স্থানীয় সেবা প্রদানকারীরা গুণগত সেবা প্রদানে ব্যার্থ হওয়ায়, লোকজন সামান্য চিকিৎসার প্রয়োজেনে জেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রেরমুখী হতে হয়। যার ফলে, চিকিৎসা খরছ বেড়ে যায় ও জেলা পর্যায়ের সেবা কেন্দ্রগুলোতে রোগীর ভীড় দেখা যায়। এর ফলে জেলা পর্যায়ের প্রয়োজনীয় রোগীরা চিকিৎসা সেবা পেতে বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে।

সারাংশে বলা যায়, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য উপকরণগুলো ব্যবহারের কার্যকারীতা বাড়াতে হবে, প্রয়োজনীয় বরাদ্দ ও তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। এই ক্ষেত্রে ইউনিয়ন ও উপজেলা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সেবার মান বাড়াতে হবে ও লোকজনকে ছোটখাট স্বাস্থ্য সেবার জন্য শহরমুখির প্রবণতা থামাতে হবে।


জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের অপ্রতুলতা
প্রয়োজনীয় আর্থিক সম্পদের অভাব বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। বর্তমান স্বাস্থ্যসেবা বাজেট বরাদ্দ ২০২৩-২০২৪ সালে ৩৮০৫২ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের  ২.৬৩%। ২০১৬ সালে শ্রীলঙ্কায় স্বাস্থ্যসেবা বাজেটের বরাদ্দ ছিল জিডিপির ৩.৮৯%। এমনকি দ্বীপপুঞ্জের দেশ মালদ্বীপও বাংলাদেশের তুলনায় ১০ গুণ বেশি বরাদ্দ করে। ২০২০ সালে, বাংলাদেশে মাথাপিছু মোট স্বাস্থ্য ব্যয় মাত্র ৫১ মার্কিন ডলার। এটি চ্যাথাম হাউসের প্রস্তাবিত US$86 এর অর্ধেকেরও কম।

সারাংশে বলা যায়, স্বল্প বরাদ্দ দিয়ে ১৬ কোটি জনগোষ্ঠিকে গুনগত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান খুব কঠিন, এই খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।

পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীর ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের অভাব
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত দক্ষ মানব সম্পদের অভাব একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। বর্তমান স্বাস্থ্যকর্মীরা শুধু  চিকিত্সকদের দিকে ঝুঁকছে অন্যান্য পেশায় আসতে চাচ্ছেন না। বর্তমানে ডাক্তার, নার্স এবং টেকনোলজিস্ট এর অনুপাত হল ১:০.৪:০.২৪ যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশে বলা হয়েছে, ডাক্তার-নার্স-টেকনোলজিস্ট অনুপাত হবে ১:৩:৫। উল্লেখ্য বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি ১৮৪৭ জনের জন্য মাত্র একজন চিকিৎসক রয়েছেন।  তাছাড়াও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে গবেষণার ঘাটতি ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অভাব রয়েছে।

সারাংশে বলা যায়,  স্বাস্থ্য সেবায় পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল নিয়োগ করতে হবে, এবং শুধুমাত্র ডাক্তার পেশায় মনোনিবেশ বা ঝুঁকলে হবে না, ডাক্তারের পাশাপাশি দক্ষ নার্স ও টেকনোলজিস্ট তৈরী করতে হবে। তবেই জনগণের সাংবিধানিক অধিকার আদায় হবে। এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বেশি করে গবেষণা করতে হবে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও প্রমোশনে মনোযোগী হতে হবে।

উচ্চ ঔষধ খরচ
বাংলাদেশের মানুষের উচ্চ মূল্যে ওষুধ ক্রয় করতে গিয়ে  দারিদ্রতার দুষ্ট চক্রের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে আউট অব পকেট এক্সপেন্স প্রায় ৬৩ শতাংশ। ওষুধের এই উচ্চ ক্রয়মূল্য নিয়মিতভাবে বেড়ে যাচ্ছে। সারাংশে বলা যায়, প্রয়োজনীয় ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

প্রবীণ লোকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের জন্য বিশেষ কোন নীতিমালা নেই ও বরাদ্দের স্বল্পতা
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাচ্ছে, পাশাপাশি প্রবীণ জনগোষ্ঠির সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবীণ জনগোষ্ঠির স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য ও বিষয়টিকে বিবেচনায় নেবার জন্য  তেমন কোন নীতিমালা  নেই ও প্রয়োজনীয় বরাদ্দের স্বল্পতা রয়েছে।

চিকিৎসায় সুসংহত রেফারেল ব্যবস্থার অনুপস্থিতি
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য কোনো বাংলাদেশে তেমন কোনো রেফারেল নেটওয়ার্ক এর বিধান নেই। সরকার ও বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি ও পরিলক্ষিত। সারাংশে বলা যায়, স্বাস্থ্যসেবার মত সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের জন্য রেফারেল ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সরকারী, বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান  ও এনজিওদের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করতে হবে।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে ক্রমবর্ধমান এবং অব্যাহত বৈষম্য
দরিদ্র এবং সুবিধাবঞ্চিতগোষ্ঠী এখনও ধনী মানুষের তুলনায় স্বাস্থ্যসেবায় কম অ্যাক্সেস রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, ধনী আয়ের গর্ভবতী মহিলারা প্রসবপূর্ব, প্রসব এবং প্রসবোত্তর সেবার জন্য ৫৩% স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা ক্লিনিকে আসেন ও বাচ্চা প্রসব করেন, অপরদিকে মাত্র 8% দরিদ্র গর্ভবতী মহিলা প্রসবপূর্ব, প্রসব এবং প্রসবোত্তর সেবার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা ক্লিনিকে আসেন। এইক্ষেত্রে প্রসবপূর্ব এবং প্রসবোত্তর যত্নের ক্ষেত্রে গুরুতর বৈষম্যরে অভিযোগ রয়েছে।

সারাংশে বলা যায়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে এই বৈষম্য কমিয়ে আনতে হলে দরিদ্র এবং সুবিধাবঞ্চিতগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা ক্লিনিকে অবাধ প্রবেশগম্যতার ক্ষেত্র তৈরী করতে হবে।

রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অঙ্গীকারের অভাব
একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অস্থিরতা প্রায়ই সহিংসতায় পরিণত হয়। এই ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা স্বাস্থ্যসেবায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। হরতালের সময় (সরকারি ও বেসরকারী পরিবহন এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রায়ই বন্ধ থাকে) ডাক্তার এবং নার্স (পাশাপাশি অন্যরা) নিরাপত্তার অভাবে কাজে যেতে ভয় পান। রোগীরাও একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হন। এই ধরনের জাতীয় রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় খুব কম সংখ্যক ব্যক্তি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবা পেতে পারেন। সারাংশে বলা যায়, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে রাজনৈতিক কার্যক্রমের উর্ধ্বে রাখতে হবে, যাতে কোন অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা বিঘ্নিত না হয়।

দুর্বল স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা
একটি দক্ষ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার অন্যতম শর্ত হলে আপ-টু-ডেট স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত তথ্য ব্যবস্থ।  WHO স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিল্ডিং ব্লক সিস্টেম এর উপর জোর দিয়েছে । শুধুমাত্র মাঠ পর্যায়ের ডাটা  যথেষ্ট নয়; সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুবিধার্থে এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সেন্ট্রালী অর্গানাইজ স্বাস্থ্য ডাটা জন্য খুবই জরুরী। বছরের পর বছর ধরে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে ছোট পরিসরে জরিপ, নজরদারি এবং গবেষণা পরিচালিত হয়েছে; তবে এখনও কেন্দ্রিয়ভাবে ডাটা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাই সারাংশে বলা যায়, জনস্বাস্থ্যের প্রবণতা নির্ণয়, আগাম ধারনা লাভ ও কার্যক্রর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা দাড় করাতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি নির্ণয়
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে নানারকম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের মানুষ, যা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন চিন্তার খোরাক। শ্বাসকষ্ট, হীটস্ট্রোক বা গরমজনিত মৃত্যু কিংবা তীব্র ঠান্ডাজনিত মৃত্যু ইত্যাদি এখন খুব সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বখ্যাত স্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য-প্রভাব নিয়ে করা তাদের গবেষণা রিপোর্টে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে যেসব রোগের প্রকোপ দেখা দিতে পারে, সে সম্বন্ধে উল্লেখ করেছে: সংক্রমণ ও কীটপতঙ্গবাহিত রোগের ধরনে পরিবর্তন আসবে; তাপপ্রবাহে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে; জলোচ্ছাস, ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়ে সরাসরি জখমের সংখ্যাও বাড়বে। তা ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে শারীরিকভাবে আহত হোন শিশু, মহিলা ও বৃদ্ধগণ। এছাড়া বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে শিশুরা মানসিকভাবেও হয়ে পড়ে পর্যুদস্ত। বিপুল মানুষ নিজস্ব আবাস ছেড়ে উদ্বাস্তুর জীবনে পদার্পণ করায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে গর্ভবতি মায়েদের জীবনে। তারা পাননা ন্যূনতম স্বাস্থ্য-সুবিধা, ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সন্তান জন্ম দেওয়া, লালন-পালনের কারণে অনায়াসেই সন্তানের শরীরে জায়গা করে নেয় নানা রোগব্যাধী। এছাড়া উদ্বাস্তু জীবনে বয়ঃসন্ধিকালে, কিশোর-কিশোরীরা পায়না উপযুক্ত ন্যূনতম পরিবেশ। কম বৃষ্টিপাতের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার সমস্যা দিনে দিনে আরো প্রকট হয়ে দাড়িয়েছে। বরিশাল ও পটুয়াখালীতে লবণাক্ততার পরিমাণ ২ পিপিটি (লবণাক্ততা পরিমাপক মাত্রা) থেকে বেড়ে ৭ পিপিটি হয়ে গেছে (প্রেক্ষিত ২০০৯)। চট্টগ্রাম শহর সন্নিকটের হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে ৮ পিপিটি হয়ে গেছে (২০০৯)। ক্রমাগত লবণাক্ত পানি পান ও ব্যবহারের ফলে মহিলাদের গর্ভধারনে দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন জটিলতা। তাই সারাংশে বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকিগুলা নির্ণয় করে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

স্বাস্থ্য এবং মানবাধিকারের মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে যেটি দেশের সংবিধান ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংবিধানেও এনটাইটেল করা হয়েছে।  স্বাস্থ্য হল সম্পূর্ণ শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতার একটি অবস্থা এবং শুধুমাত্র রোগ বা দুর্বলতার অনুপস্থিতি নয়। জাতি, ধর্ম, রাজনৈতিক বিশ্বাস, অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রতিটি মানুষ কোন পার্থক্য ছাড়াই রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বাস্থ্য সেবা উপভোগ করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংবিধানের পাশাপাশি, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি (ICESCR) স্বাস্থ্যের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই আমাদের উচিত, স্বাস্থ্য এবং মানবাধিকারের মধ্যে লিঙ্কগুলো খুঁজে বের করে তা সমন্বয় করা ও মানবাধিকারকে সমুন্নত রাখা। স্বাস্থ্যসেবা ও মানবাধিকারের উন্নয়নের জন্য সরকার, এনজিও এবং সুশীল সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।


শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৪

প্লাস্টিক দূষণ সমাধানে সার্কুলার ইকোনমি

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জিডিপি বৃদ্ধির সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক উৎপাদন হয়েছিল ৩৯০.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন এবং ২০২০ সালের তুলনায় এই সংখ্যা চার শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে । বিশ্ব ব্যাংকের  প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে প্রায়ই ৩ গুণ। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি পেলেও টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা সর্বনিম্নে আনতে সচেষ্ট হয়েছে। কিন্ত বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য না হলেও, প্লাস্টিক দূষণের শিকার হওয়া দেশগুলোর তালিকার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম । বিশেজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে দ্রুত প্রবৃদ্ধি ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে, যেমন প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি, প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার কারণে দূষণ ও বেড়ে গেছে। তাছাড়া, মহামারি করোনাভাইরাস প্লাস্টিক দূষণকে আরও ত্বরানিত করেছে। ওইসিডি’র গ্লোবাল প্লাস্টিক আউটলোক’ ২০২২ প্রতিবেদনে বলা হয় বৈশ্বিকভাবে উৎপাদিত প্লাস্টিকের মাত্র ০৯ শতাংশ পুনঃচক্রায়ন সম্ভব হয়েছে, ২২ শতাংশ ব্যবস্থাপনা বাইরে বা পরিবেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, ৪৯ শতাংশ ল্যান্ডফিলে পরিত্যজন বা ডাম্পিং করা হয়েছে এবং ১৯ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলা (ইনসিনারেশন) হয়েছে। 

অর্থাৎ ৭৯ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্যই দীর্ঘদিন মাটি ও পানিতে তথা পরিবেশে থেকে গেছে। এই প্লাস্টিক এখন সমগ্র পৃথিবীকে দূষিত করছে । এই অব্যবস্থনাকৃত প্লাস্টিক বর্জ্য মাটি ও পানির সাথে মিশে মাটির গুনাগুন নষ্টের সঙ্গে সঙ্গে পানিতে থাকা জীববৈচিত্রের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলছে ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। গবেষণায় জানা যায় সাধারণ মানুষ খাদ্য এবং জলের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করে, এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরে প্রবেশের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি করছে। শুধু তাই নয়, এইসব প্লাস্টিক বর্জ্য নালা বা ড্রেনের মাধ্যমে নদী বা খালে গিয়ে জমা হয়ে নদীর ও খালের তলদেশে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে ও সামান্য বৃষ্টিতে নগরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।  

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায়ই ৮, ২১,২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর। বর্তমানে এই শহরের জনসংখ্যা ৬০ লক্ষের বেশি। জীবন জীবিকার তাগিদে প্রতিনিয়ত মানুষ চট্টগ্রাম শহরে পাড়ি জম্মাচ্ছে। ভাবনার বিষয় হলো, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে শহরাঞ্চলে মানবসৃষ্ট বর্জ্যের পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে । চট্টগ্রাম নগরীতে প্রতিদিন গড়ে ২৫০০ টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয় (জাইকা প্রতিবেদন- ২০২২)। চট্টগ্রাম শহরের উৎপাদিত বর্জ্যের একটি বড় অংশ প্লাস্টিক ও পলিথিন,  এটি প্রায় মোট উৎপদিত বর্জ্যের ৮.৮%। চুয়েটের এক গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রাম শহরে প্রতিবছর গড়ে ৭৫০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিটি কর্পোরেশনের অন্যতম নিয়মিত কাজ। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ৭৫% বর্জ্য সংগ্রহ করতে পারে, বাকী ২৫% বর্জ্য অসংগৃহীত থেকে যায় (বর্জ্য প্রতিবেদন, ২০১৯-২০২০)। পরিবেশে পড়ে থাকা এইসব প্লাস্টিক বর্জ্যর বড় একটি অংশ হলো পলিথিন ব্যাগ, পণ্যের মোড়ক, মিনারেল ওয়াটার, জুস ও কোমল পানীয় বোতল ইত্যাদি । এই ধরনের অসংগৃহীত বর্জ্য নগরের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের উপর বিশাল প্রভাব ফেলে। অপরপদিকে প্লাস্টিক সহজলভ্য, অপচঁনশীল, পুনঃচক্রায়ন ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য। অব্যবস্থপনা ও টেকসই ব্যবস্থাপনার অভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য ল্যান্ডেফিলে পরিত্যজন হচ্ছে বা পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে। যার ফলে বর্জ্য থেকে সম্পদ তৈরীর সুযোগ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। আমার এই প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে সার্কুলার ইকোনমি বা বৃত্তাকার অর্থনীতির মাধ্যমে কিভাবে আমরা  প্লাস্টিক দূষণ কমিয়ে আনতে পারি ও টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারি।

উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সার্কুলার ইকোনমি বা বৃত্তাকার অর্থনীতির বিকাশ অত্যন্ত জরুরি। সার্কুলার ইকোনোমি এমন একটি অর্থনৈতিক মডেল যেখানে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। এতে তুলনামূলক কম প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্পদের অপচয় কমিয়ে আনা হয় এবং বর্জ্য উৎপাদন হ্রাস করার উপর গুরত্বারোপ করা হয়।

সার্কুলার ইকোনমি মডেলে উৎপাদন ও ভোগের মধ্য সমন্বয় সাধন করে। এটি পণ্যের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে এবং পণ্যের জীবনচক্রকে প্রসারিত করে। এটি রৈখিক অর্থনীতি বা লিনিয়ার ইকোনমি মডেলের বিপরীত অবস্থা (উৎপাদন-ভোগ-বর্জ্য)। ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন, ২০৩১ সাল নাগাদ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হতে হলে সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আর সেজন্য সার্কুলার ইকোনমির বিকাশ অত্যন্ত জরুরী।

প্লাস্টিক বর্জ্যে’র ভ্যালু চেইনের অংশীদারদের ক্ষমতায়ন ও সংযোগের মাধ্যমে পরিত্যক্ত, অব্যবহৃত পলিথিন, প্লাস্টিক সংগ্রহ করে রিসাইক্লারদের নিকট পৌছানো বিষয়ে কাজ করছে চট্টগ্রামের বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ইপসা। এই চর্চার মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বৃত্তাকার অর্থনীতির চর্চা শুরু হয়েছে। এই এপ্রোচের মাধ্যমে প্লাস্টিক সংগ্রহের সাথে সম্পৃত্ত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে ও পরিবেশের উন্নতি হচ্ছে। ইপসা, গত ১.৫ বছরে প্রায় ১০০০০  টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে রিসাইকেলারদের কাছে প্রেরণ করছে পুনঃচক্রায়নের জন্য। ইপসা মনে করছে এই সার্কুলার ইকোনমি মডেল প্রয়োগের মাধ্যমে বাজারে ভার্জিন প্লাস্টিকের অনুপ্রবেশ কমে আসছে এবং বর্জ্যের উপকরণগুলি নিরাপদে প্রকৃতিতে ফিরে যাচ্ছে। এই বৃত্তাকার অর্থনীতির ফলে সরকারের এ্যাকশান প্লান ফর প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট (২০২১-২০৩০) বাস্তবায়ন সম্ভব হবে এবং  ২০৩০ সালের মধ্যে বাজারে ৫০% শতাংশ ভার্জিন প্লাস্টিকের অনুপ্রবেশ কমিয়ে আনা সম্ভবপর হবে।

সার্কুলার ইকোনমি প্রয়োগের সুবিধাসমূহঃ

সার্কুলার ইকোনমি প্রয়োগের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব তথা পৃথিবীর তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব। গ্রীনহাউস গ্যাস  বায়ুমন্ডলে নির্গত হওয়ার মাধ্যমে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন তথা পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলছে। সার্কুলার ইকোনমি প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা সম্ভব। সাধারণত, সার্কুলার ইকোনমি লিনিয়ার ইকোনমি’র তুলনায় কম কার্বন নিঃসরণ করে। সার্কুলার ইকোনমিতে প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার সর্বাধিক নিশ্চিত করে যার ফলে নতুন প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দেয়। সার্কুলারিটি গ্যাপ রিপোর্ট-২০২১ এ দাবি করা হয় সার্কুলার ইকোনমি’র মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ৩৯ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা সম্ভব।

সার্কুলার ইকোনমি’র মাধ্যমে পণ্যের উৎপাদান খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব। প্লাস্টিক বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদান খরচ ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। বৃত্তাকার অর্থনীতির মাধ্যমে পুনর্ব্যবহার ও পুনঃচক্রায়ন করে কাঁচামালের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা সম্ভব।

প্লাস্টিক বর্জের সার্কুলার ইকোনমি’র মাধ্যমে আমরা এনার্জি (শক্তি) উৎপাদন ও যোগান দেওয়া সম্ভব। পাইরোলাইসিস প্রক্রিয়ায় প্লাস্টিক বর্জ্যকে শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর অন্যতম দেশ যারা প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে বিদুৎ উৎপাদন করছে ও বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনে এই শক্তিকে ব্যবহার করছে। পরিত্যক্ত প্লাস্টিক ব্যাগ থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদন করা সম্ভব। এই তেল পরিশোধনের মাধ্যমে সব ধরনের যানবাহন ও সেচপাম্পে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।

বৃত্তাকার অর্থনীতি 3R (হ্রাস, পুনর্ব্যবহার ও পুনঃচক্রায়ন) 7R পর্যন্ত প্রসারিত করে যেমন; নতুন করে ডিজাইন (redesign); কমাতে (reduce); মেরামত (repair); পুনর্নবীকরণ (renewal); পুনরুদ্ধার (recover); পুনঃচক্রায়ন (recycle); এভাবে, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহস্থাপনায় সার্কুলার ইকোনমি প্রবর্তন করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় 3R  থেকে 7R পর্যন্ত প্রসারিত করা সম্ভব।

বৃত্তাকার অর্থনীতি মাধ্যমে স্থানীয় বাজারে বিপুল পরিমাণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। দেশে অনানুষ্ঠানিক খাতে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত হয় এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতা বাড়ছে। চট্টগ্রাম রিসাইাক্লং প্লাস্টিক ব্যবসায়ী সমিতির এর মতে চট্টগ্রামে ৫০০ এর অধিক রিসাইকালার রয়েছে, যেখানে প্রায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অর্ধ-লক্ষাধিক লোক জীবিকা নির্বাহ করছে। রিসাইকেল খাতকে শিল্প হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলে দেশের বৃত্তাকার অর্থনীতির বিকাশ আরো গতিশীল হবে। বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত বাংলাদেশ তৈরিতে সাহায্য করবে সার্কুলার ইকোনমি ।

সর্বোপরি, বাংলাদেশের জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় গৃহীত টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনার আওতায় ২০২৬ সালের মধ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার ৯০ শতাংশ কমানো, ২০৩০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহার ৮০ শতাংশে উন্নীত করা এবং একই সময়ে প্লাস্টিক বর্জ্য সৃষ্টি ৩০ শতাংশে কমিয়ে আনতে সার্কুলার ইকোনমি’র বিকল্প নেই। সার্কুলার ইকোনমি’র সঠিক বাস্তবায়ন ও সমন্বয়ের জন্য চাই টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, উৎসে বর্জ্য হ্রাস ও পৃথকীকরণ, ভোক্তা ও বর্জ্য সৃজনকারীদের (সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা) দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে সংবেদনশীলতা তৈরি, প্লাস্টিক পণ্য প্রস্ততকারক বা আমদানিকারকেদের প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ, স্থানীয় সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের ক্ষমতায়ন ও দায়িত্বপালন, শিল্প ও পরিবেশবান্ধব নীতিমালা, কঠিন বর্জ্য বিধিমালা ২০২১ এর প্রয়োগ, গবেষণা এবং বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন। এভাবে সবার সম্মনিত প্রচেষ্টায় সার্কুলার ইকোনমি’র মাধ্যমে প্লাস্টিক দূষণ কমানো সম্ভব।


বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট, ২০২৩

লাইফ ইজ বিউটিফুল

তুমি হারবে, তারপরেও তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। 

আমরা প্রায়ই আমাদের সন্তানদের বলি " জিততে তোমাকে হবে, তোমাকে প্রথম হতে হবে, জিপিএ গোল্ডেন ফাইভ পেতে হবে, মেডিকেল চান্স পেতে হবে, বুয়েটে চান্স পেতে হবে, নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে হবে, ভালো চাকরি করতে হবে "। তাকে কখনও বলিনা, তুমি হারতেও পারো। জিতে যাওয়া মানেই জীবন না, হেরে যাওয়ার মধ্যেও থাকে বেঁচে থাকার আনন্দ। তুমিও তো রক্ত মাংসেরই মানুষ, তোমারও ক্লান্ত লাগবে। একটু বসো। সবসময়ই উঠে দাঁড়ানোর দরকার নাই। সবসময়ই দৌড়ানোর দরকার নাই। একটু বিশ্রাম করো। কথাটি কেউ বলি না। বলি না বলেই, অনেক ছেলেমেয়ে ঝুলে পড়ে। কেউ রিলেশনশিপের জন্য, কেউ টাকার জন্য, কেউ ক্যারিয়ারের জন্য, কেউ রেজাল্ট বা সিজিপি'র জন্য, কেউ বা একটুখানি ভালোবাসার জন্য।


হেলাল হাফিজ এক বুক কষ্ট নিয়ে লিখেছিলেন,

কেউ বলেনি,

ক্লান্ত পথিক,

দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে জিরিয়ে নিও...


মা বাবা, শিক্ষক, গার্জিয়ান, বন্ধু, সমাজ, পৃথিবী, আপনাদের সবার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, সন্তানদের জিতে যাওয়ার মোটিভেশন দেন, সমস্যা নাই। কিন্তু হেরে যাওয়াদের কথাও একটু বলবেন, স্মরণ করিয়ে দিবেন, পৃথিবীতে সবাই জিততে আসে নাই। সবার জেতার দরকারও নাই। হেরে যাওয়াটা খুব  স্বাভাবিক। কিন্তু এই পৃথিবীতে সবাই বাঁচতে আসছে। সবার বাচাঁর অধিকার আছে,  জীবনটা একবার সেটাকে উপভোগ করতে হবে। Life is beautiful. এই পৃথিবীর আলো বাতাস, জল বা জোছনায় হেরে যাওয়া মানুষের যেমন অধিকার জিতে যাওয়া মানুষেরও অধিকার  আছে। সবার সমান অধিকার

সফলতার পরিমাপক কি ও এর নিয়ন্ত্রক কে!

সফলতা বা সাফল্য আসলে কি? ভাল রেজাল্ট, ভাল চাকুরী, অনেক ডিগ্রী, অনেক নামযশ, অনেক প্রতিপত্তি, ভাল পার্টনার, সুখের সংসার, কোনটা সাফল্যের পরিমাপক!

যিনি সফল হতে পারেনি তাহলে তার সফলতার নিয়ন্ত্রক কে! ব্যার্থ মানুষরা যেহেতেু তাদের ব্যার্থতা নিয়ে লেখেন না, তাই তাদের কথা কেউ জানতে পারি না। সবখানে কেবল সফলদের জয়জয়কার। কিন্ত আমার কাছে মনে হয় সফলতার সংজ্ঞাটি আপেক্ষিক, নিয়ন্ত্রিত ও পূর্ব-নির্ধারিত। কারণ, আমি দেখছি,  সর্বোচ্চ সফল পেশায় থাকা মানুষটিকে দুঃখ করতে, অতি সুখী দম্পতিকে দেখেছি নিঃসন্তানের যন্ত্রণায় কাদঁতে, সফল যুগলকে দেখেছি ডিভোর্স হতে, উচ্চশিক্ষিত স্মার্ট তরুন ও সুন্দরী তরুনীকে দেখেছি পার্টনার না খুঁজে পেয়ে চিরকুমার বা চিরকুমারী থেকে যেতে, আবার ব্যাক বেঞ্চার মানুষটিকেও সাফল্যের চুড়ায় উঠতে দেখেছি, সাধারণ ছেলেটি বা মেয়েটির  অত্যন্ত ভালো পার্টনার ও সুখের জীবন পার করতে।

আসলে মানুষের জীবনে সুখ, সফলতা, ভাল পার্টনার, এসব কিছু  কিন্তু সৌন্দর্য্য, মেধা, ভাল ক্যারিয়ার এসবের উপর নির্ভর করেনা। একসময় সবচেয়ে পিছিয়ে যাওয়া মানুষটিও এগিয়ে যেতে পারে। আবার সবচেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষটিও দিন শেষে ব্যর্থ হতে পারে।

ভালো বেতনের চাকুরী বা বিদেশে সেটেল হওয়া মানেই এইনা সে সবচেয়ে সফল ব্যাক্তি, সবচেয়ে সুন্দরী  বা সুদর্শন হওয়া মানেই এইনা যে সে ভাল পার্টনার পাবে। ফার্স্ট স্টুডেন্ট হওয়া মানে এইনা সে সবচেয়ে ভাল চাকরী পাবে।

জীবনের এই প্যারামিটারগুলোর উপর ভিত্তি করে আমরা সফলতা পরিমাপ করতে যাই। অথচ জানি না এই প্যারামিটারগুলো ফিক্সড হওয়া মানেই যে সে সফল হবে তার নিশ্চয়তা নেই। কারণ এর নিয়ন্ত্রন আমাদের হাতে নেই। কারণ তার সাথে জড়িত রয়েছে তাকদীর বা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ভাগ্য। ইসলামে তাকদীরের ওপর বিশ্বাস করা আল্লাহ তা'আলার রবুবিয়াত বা প্রভুত্বের ওপর বিশ্বাস করার অন্তর্ভুক্ত এবং তা ঈমানের ছয়টি রুকনের অন্যতম একটি রুকন।

মানুষের ভালো মন্দ যা কিছু হোক তা সবই আল্লাহর হুকুমে হবে। দুনিয়ায় ভালো কিছু পাওয়া গেলে আত্মহারা বা অহংকারী হয়ে যাওয়া যাবে না আবার কোন বিপদ আপদে পড়লে হতাশ হওয়া যাবে না। বিশ্বাস করতে হবে আল্লাহর ইচ্ছা ও জ্ঞান অনুযায়ী সে ফল পেয়েছে, নিশ্চয় এর মধ্যে কোনো কল্যাণ নিহিত রয়েছে। কাজেই ব্যার্থ হলে হতাশ না হয়ে নিজের কর্মের ভুলগুলো সারিয়ে নতুন করে তৈরি হতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে, ফলাফলের দায়িত্ব আল্লাহর উপর ছেড়ে দিতে হবে। কারন আল্লাহপাকই সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী।

শুক্রবার, ১২ মে, ২০২৩

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ইপসা’র ৩৮ বছর

দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বেসরকারি সমাজউন্নয়নমূলক সংস্থার কার্যক্রমকে উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণণা করা হয়। বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়ন, সীমিত সম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণে বেসরকারি সমাজউন্নয়নমূলক সংস্থার ভূমিকা অপরিসীম। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীতে যুদ্ধবিধস্ত রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্র যেমন এগিয়ে আসে তেমনি ত্রাণ ও পুনবার্সন কার্যক্রমে বেসরকারিভাবে কর্মকান্ড চলতে থাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। ত্রাণ ও পুনবার্সন কার্যক্রম শক্তিশালী করার জন্য ১৯৭২ সালে গঠিত হয় ব্রাক। এরপর ১৯৭৬ সালে প্রশিকা ও গ্রামীণ ব্যাংক গঠিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠান ত্রাণ পুনবার্সনের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়ননে গুরুত্বারোপ করে। আশির দশকে বেসরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রম ইস্যুতে পরিবর্তন আসে। তার প্রেক্ষাপটের কারণ ছিল সামরিক শাসন ও সকল স্তরে সামরিকায়নের ফলে ঐ সময় দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে দুর্দশা তৈরি হয়। এই অবস্থার থেকে উত্তরণের জন্য তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশে বেশ কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও ‍সিভিল সোসাইটির জন্ম নেয়, তাদের মধ্যে ইপসা (ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল এ্যাকশান) অন্যতম।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯০ সালকে “যুব দশক” ও ১৯৮৫ সালকে “আন্তর্জাতিক যুব বর্ষ” ঘোষনা করে। উন্নয়ন ও মানবিক কর্মসূচীতে যুবকদের সম্পৃক্ত করতে ব্যাপক প্রচারনার ব্যবস্থা নেয়া হয়। এমনি প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার কয়েকজন সমাজ সচেতন যুবক ইপসা’র প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নির্বাহী মোঃ আরিফুর রহমানের নেতৃত্বে একটি উন্নয়ন সংগঠন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এলাকার যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করে। আর এভাবেই “১৯৮৫ সালের ২০ মে” সচেতন যুবকদের সক্রিয় উদ্যোগে সমাজ উন্নয়ন সংগঠন “ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল এ্যাকশন (ইপসা)’র পদযাত্রা শুরু হয়। কালের পরিক্রমায় ও সময়ের সাথে পালা দিয়ে ইপসা (ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল এ্যাকশন) বিশ্বস্ততা অর্জন করে লক্ষিত জনগোষ্ঠির ও নিবন্ধন লাভ করেন বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের, আস্থা অর্জন করে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার। ইপসা’র ভিশন হলো “এমন একটি দারিদ্রমুক্ত সমাজ যেখানে সকলের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে।” তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে সংগঠিত করে বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নে কাজ করে যাচ্ছে ইপসা। দেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাড়া প্রদান ও পুনবার্সন, পরিবেশ সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা, স্বাক্ষরতা হার বৃদ্ধি, শিক্ষার মান উন্নয়ন, স্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা, কোভিড-১৯ সাড়া, শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা, যুবদের ক্ষমতায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শোভন কর্মপরিবেশ সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, মূলধন গঠন, জাতীয় আয় বৃদ্ধি, বলপূর্বক স্থানচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের মানবিক সাড়া প্রদান ও শিশু, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে ইপসা। ১৯৮৫ সালে ইপসা তার যাত্রা শুরু করে বর্তমানে প্রায় ০৩ হাজার কর্মী সারাদেশে ১৪ মিলিয়ন মানুষের জীবন সংগ্রামে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

ইপসা’র মূল্যবোধ

  • দেশপ্রেম এবং জাতীয় স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় গৌরবের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা
  • ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা
  • পারষ্পরিক শ্রদ্ধা এবং জেন্ডার বান্ধব মনোভাব সম্পন্নতা
  • মান সম্পন্নতা এবং উৎকর্ষতা
  • বিনম্রতা এবং আত্মবিশ্বাস
  • বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ
  • পরিবেশ এবং প্রতিবেশের প্রতি সহমর্মিতা

সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্য
  • পারিবারিক পরিবেশ
  • দায়িত্ব সচেতনতা
  • ব্যয়সাশ্রয় নীতি
  • গঠনমূলক সমালোচনা ও সংস্থার পরিচিতি প্রসার
  • বিভিন্ন জাতি ধর্ম ও বর্ণ’র সাম্য ও সমপ্রীতি
  • সুস্থ বিনোদন
ইপসা’র কার্যক্রমঃ
ইপসা’র কার্যক্রমকে ছয়টি থিমে ভাগ করা হয়, যথা;
  • শিক্ষা
  • স্বাস্থ্য
  • পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন
  • অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন
  • মানবাধিকার ও সুশাসন
  • দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও মানবিক সাড়া প্রদান
উক্ত উন্নয়ন থিমের আওতায় বর্তমানে ইপসা’র সকল উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

লিংক অরগানাইজেশন সমূহঃ
  • আইসিটি এন্ড রিসোর্স সেন্টার অন ডিসএ্যাবিলিটিস (আইআরসিডি)
  • ইপসা- সেন্টার ফর ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট (ইপসা-সিওয়াইডি)
  • ইপসা- ডেভেলপমেন্ট রিসোর্স সেন্টার (ইপসা-ডিআরসি)
  • ইপসা- পরিচালিত স্কুল সমূহ (এভারগ্রীন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, কাজী পাড়া শিশু নিকেতন ও আলেকদিয়া শিশু নিকেতন)
  • ইপসা মানব সম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্র (ইপসা এইচআরডিসি)
  • রেডিও সাগর গিরি এফ এম ৯৯.২
  • ইন্টারনেট রেডিও দ্বীপ
  • কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
সম্মাননা ও স্বীকৃতিঃ
সুদীর্ঘ ৩৮ বছরের পথচলায়, ইপসা জয় করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির বিশ্বস্ততা, সরকার ও দাতা জনগোষ্ঠির আস্থা। ইপসা তার কার্যক্রমের মাধ্যমে অবদান রাখছে স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা থেকে বৈশ্বিক লক্ষমাত্রা অর্জনে। তার স্বীকৃতিস্বরুপ স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অর্জন করে বেশ সম্মাননা ও স্বীকৃতি। নিম্নে বিশেষ কিছু সম্মাননা ও স্বীকৃতির নাম উল্লেখ করা হল;
  • তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিবন্ধী নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য ২০২১ সালে WSIS Prize অর্জন করে।  
  • দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পাঠ উপযোগী বই তৈরীর জন্য, ইপসা ২০২০ সালে  জিরো প্রজেক্ট এওয়ার্ড অর্জন করে। জাতিসংঘ সদর দপ্তর অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় এই এওয়ার্ড প্রদান করা হয়।
  • ২০২০ সালে ইপসা নয়া দিল্লি, ভারত থেকে  ই-এনজিও চ্যালেঞ্জ এওয়ার্ড অর্জন করে।
  • নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতকরনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়, চট্টগ্রাম ইপসাকে চট্টগ্রাম জেলায় শ্রেষ্ঠ বেসরকারি সংগঠন ২০২০ সম্মাননা প্রদান করে।
  • তামাক নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অবদান রাখার জন্য, তামাক বিরোধী জাতীয় প্লাটফর্ম ও পিকেএসএফ, ইপসাকে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ পদক ২০১৯ প্রদান করে।
  • ইপসা ২০১৮ সালে বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদক অর্জন করে।
  • সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তর কর্তৃক ইপসা ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে সেরা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা স্বীকৃতি সম্মাননা লাভ করে।
  • প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ডিজিটাল ক্ষমতায়নে ইপসা, ২০১৮ সালে ইউনেস্কো-আমির আল আহমেদ আল জাবের সম্মাননা লাভ করে (প্যারিস, ফ্রান্স)।
  • ইপসা ইনোভেটিব সার্ভিস ডেলিভারির জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিল বিকন এওয়ার্ড ২০১৭ অর্জন করে। 
  • ইপসা, দৃষ্টি ও পঠন প্রতিবন্ধী শিক্ষাথীদের রিডিং মেটেরিয়ালস তৈরীর স্বীকৃতিস্বরূপ ডব্লিউএসআইএস এওয়ার্ড অর্জন করে ২০১৭ সালে।
  • ইপসা ২০১০ সালে নয়া দিল্লি, ভারত হতে আর্ন্তজাতিক মন্থন এওয়ার্ড অর্জন করে ।
  • জাতিসংঘ এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (UN-ECOSOC) কর্তৃক কনসালটেটিভ স্ট্যাাটাস অর্জন করে ২০১৩ সালে ।
  • যুব ও উন্নয়ন কর্মসুচিতে অনবদ্য ভূমিকা রাখায়  ইপসা  ১৯৯৯ সালে আর্ন্তজাতিক যুব শান্তি পুরস্কার  অর্জন করে।
আমাদের বিশ্বাস ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ ‍ও অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণে ইপসা’র এই ধারা অব্যাহত থাকবে। সমাজের অসঙ্গতিগুলো নিরসনে ইপসা স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের কার্যক্রমগুলো চলমান রাখবে। একটি সাম্য, মর্যাদা ও ন্যায্যতার পৃথিবী বিনির্মাণে ইপসা’র এই ধারা অব্যাহত থাকুক, ইপসা’র ৩৮ বছর পূর্তিতে এটি আমাদের কামনা।


সোমবার, ১ মে, ২০২৩

শ্রমিকের কর্মপরিবেশটি যেন হয় পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকিমুক্ত, নিরাপদ ও মর্যাদাকর!

 শ্রম ছাড়া উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণ সম্ভব নয়, শ্রমিকের মর্যাদা ছাড়া অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, শ্রমিকের ঝুঁকিমুক্ত পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ছাড়া উৎপাদনশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কর্মচারীরা একটি কোম্পানির বা প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও প্রাণশক্তি। যখন প্রতিষ্ঠানের একজন সদস্য অসুস্থ বা আহত হন, তখন তাকে সুস্থ করা প্রতিষ্ঠানের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়টি জনস্বাস্থ্য বিভাগের এমন একটি বিষয় যেখানে চাকুরীর বা পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মীর আঘাত বা অসুস্থতার প্রতিরোধ ও চিকিৎসার বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা করা হয়। পেশাগত স্বাস্থ্যের সাথে বেশ কিছু বিভাগ জড়িত, যেমন পেশাগত ওষুধ, নার্সিং, এরগনোমিক্স, মনোবিজ্ঞান, স্বাস্থ্যবিধি, নিরাপত্তা এবং অন্যান্য।

উল্লেখ্য যে, এখানে স্বাস্থ্য বলতে শুধু রোগবালাইকে বোঝানো হয় না, বরং স্বাস্থ্য বলতে সামগ্রিক স্বাস্থ্য, অর্থাৎ দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক, আর্থিক স্বাস্থ্যকে বোঝানো হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়টির প্রধান কাজ হলো কর্মক্ষেত্রে যেকোনও ধরনের ঝুঁকি বা সম্ভাব্য বিপদ প্রতিরোধ করা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর মতে পেশাগত স্বাস্থ্য হল সমস্ত পেশায় নিয়োজিত কর্মীদের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতার সর্বোচ্চ স্তরের প্রচার এবং রক্ষণাবেক্ষণ। এবং পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ ও মানুষের সাথে কাজের পরিবেশের অভিযোজন। সর্বোপরি, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরপত্তা বিষয়টি কর্মীদের স্বাস্থ্য এবং তাদের কাজের পরিবেশ সম্পর্কিত নির্দেশিকা এবং নিয়মগুলির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এটি নিয়োগকর্তাদের সকল কর্মচারীদের জন্য একটি নিরাপদ কাজের পরিবেশ প্রদান করতে সচেষ্ট করে।

কর্মীর পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা লক্ষে বাংলাদেশ সরকার শ্রম আইন ২০০৬ প্রণয়ন করছেন ও তা বাস্তবায়ন করছেন। এই আইনের ৫১ হতে ৯৯ ধারাসমূহে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। তাছাড়াও বৈশ্বিকভাবে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে প্রতি বছর ২৮ এপ্রিল আন্তর্জাতিক পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবস ও ১মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালন করা হয়ে থাকে।  তাছাড়াও অন্যান্য আইন ও আন্তর্জাতিক সনদে এই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করা হয়েছে। এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি’।

কর্মপরিবেশে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার মূল উদ্দেশ্যঃপেশাগত স্বাস্থ্যে ও নিরাপত্তার মূল উদ্দেশ্য হল কর্মীদের জন্য একটি নিরাপদ এবং আস্থার পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং কাজের সাথে সম্পর্কিত অসুস্থতা বা আঘাতের ঝুঁকি হ্রাস করা। প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ প্রদানের আইনত বাধ্যতামূলক রয়েছে, এবং এটি শুধুমাত্র সঠিক পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক পলিসির প্রতিষ্ঠা, বাস্তাবায়ন, অরিয়েন্টশন এবং নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমেই সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার মূল উদ্দেশ্য হলঃ

• শ্রমিকের স্বাস্থ্য এবং কাজের ক্ষমতা রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রচার;

• কাজের অবস্থার উন্নতি এবং কর্মপরিবেশ স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী;

• নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত;

• কর্মক্ষেত্রে কাজের সামগ্রিক অবস্থা নিরীক্ষণ এবং উন্নতির সুযোগ সন্ধান;

• অসুস্থ বা অসুস্থতার কারণে দীর্ঘ সময়ে কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত কর্মীকে সহায়তা;

• কর্মীর শারীরীক সুস্থতার পাশাপাশি সামাজিক, আর্থিক ও মানবিক মর্যাদা প্রসিষ্ঠা;

• যে সমস্ত কর্মীরা কর্মক্ষেত্রে বা বাড়িতে মানসিক চাপে রয়েছেন তাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান;

• শ্রমিকদের কল্যাণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের স্থায়ীত্বশলতা আনয়ন;

• আন্তর্জাতিক মানদন্ড, প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকা ও গ্রাহকের সন্তুষ্টি অর্জনে।

পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বজায় রাখার সুবিধাঃ কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিধিবদ্ধ এবং নৈতিক বাধ্যবাধকতা ছাড়াও আরো অনেকগুলো কারণে এটি গুরুত্বপূর্ণ। কোন কারণে এটি করতে ব্যর্থ হলে সংস্থা এবং কর্মচারী/কর্মকর্তা ভয়ের জন্যই ক্ষতির কারণ হবে।

কর্মক্ষেত্রে কর্মীর মনোবল বৃদ্ধির জন্যঃ কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের মনোবল বজায় রাখা পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিধান খুব গুরুত্বপূর্ণ। পেশাগত স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে, কর্মীরা সংস্থার ভিতরে নিজেকে নিরাপদ ও মূল্যবান/গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। যার ফলে কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে একই প্রতিষ্ঠানে তৃপ্তির সাথে কাজ করে ও সংস্থার উৎপাদনশীলতা বাড়ায়।

সংস্থার সুনাম ও খ্যাতির জন্যঃ কর্মীর পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বজায় রাখলে কোম্পানির সুনাম ও খ্যাতি বৃদ্ধি পায়। আজ, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ইউজারে মুখের কথা কোম্পানির সুনাম ও খ্যাতির ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একজন গ্রাহক থেকে একজন কর্মচারী যে কেউ, সোশ্যাল মিডিয়ায় পর্যালোচনা/রিভিউ লিখতে বা তাদের মন্তব্য সামাজিক মিডিয়া প্রোফাইল আপডেট করতে পারে। আপনার কোম্পানি যদি পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত পরিমাণে বিনিয়োগ করে, তাহলে এর খ্যাতি বাড়বে।

নতুন সুযোগের সন্ধান লাভ করার জন্যঃ কর্মীর পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রতিষ্ঠান অনেক নতুন সুযোগ আনলক করে। যা সাফল্যের জন্য সংগঠনকে সেট আপ করে।

বিশ্বস্ততা অর্জন ও প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্যঃ কর্মীর পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রতিষ্ঠান গ্রাহক, কর্মচারী ও স্টেকহোল্ডারদের (সরকারি, বেসরকারি, দাতা সংস্থা) কাছে বিশ্বস্ততা অর্জন করে। যার ফলে নতুন কোন সুযোগ আসলে ঐ প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সুযোগটি সহজে লাভ করে।

পেশাগত দুর্ঘটনা পেশাগত ব্যাধির পরিচয়ঃ কর্মরত অবস্থায় অথবা ব্যবসার প্রয়োজনে কর্মস্থলের বাইরে অবস্থানকালে সংঘটিত কোন দুর্ঘটনায় শ্রমিক জখম প্রাপ্ত হওয়ার ঘটনায় পেশাগত দুর্ঘটনা। মানুষের আচরণগত প্রদান ও পরিবেশগত উপাদান দুর্ঘটনার নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। কর্মক্ষেত্রে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক বস্তু, ধুলি, ধোঁয়া, বা ক্ষতিকর কোন জৈব উপাদানের সংস্পর্শে দীর্ঘদিন যাবত কাজ করার ফলে শরীরে যে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তাই পেশাগত রোগ বা ব্যাধি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের শ্রম আইনে এমন ৩৩ প্রকার স্বাস্থ্য সমস্যাকে পেশাগত ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পেশাগত ব্যাধির বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে যা নির্ণয় হয় কাজের ধরন ও কাজের পরিবেশের উপর। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) পেশাগত ব্যাধির একটি তালিকা প্রকাশ করেছে এই তালিকাটিতে তিনটি ক্যাটাগরিতে পেশাগত ব্যাধির ধরন নির্ণয় করা হয়েছে;

১. কর্মীর কর্ম পরিবেশের উপর ভিত্তি করে (এজেন্ট ভিত্তিক); 
শারীরিক এজেন্ট (ফিজিক্যাল)  দ্বারা সৃষ্ট রোগঃ শব্দের কারণে শ্রবণ প্রতিবন্ধকতা; আয়নাইজিং বিকিরণ দ্বারা সৃষ্ট রোগ; লেজার সহ অপটিক্যাল (আল্ট্রাভায়োলেট, দৃশ্যমান আলো, ইনফ্রারেড) বিকিরণ দ্বারা সৃষ্ট রোগ; অত্যধিক তাপমাত্রার সংস্পর্শে আসার ফলে সৃষ্ট রোগ ইত্যাদি।

জৈবিক এজেন্ট (বায়োলজিক্যাল) এবং সংক্রামক বা পরজীবী দ্বারা সংঘটিত রোগঃ ব্রুসেলোসিস, হেপাটাইটিস ভাইরাস, হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি), টিটেনাস, যক্ষ্মা, অ্যানথ্রাক্স, কোভিড-১৯, লেপ্টোস্পাইরোসিস ইত্যাদি।

রাসায়নিক এজেন্ট (কেমিক্যাল) দ্বারা সৃষ্ট রোগ: ক্যাডমিয়াম, বেরিলিয়াম, ফসফরাস, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, পারদ, সীসা, ফ্লু ইউরিন বা এর যৌগ দ্বারা সৃষ্ট রোগ। কীটনাশক, অ্যামোনিয়া ও অন্যান্য কেমিক্যাল এজেন্ট দ্বারা সৃষ্ট রোগসমূহ।

২. টার্গেট অরগান সিস্টেম এর উপর ভিত্তি করে;
শ্বাসযন্ত্রের রোগ (নিউমোকোনিওসিস, ব্রংকাইটিস, অ্যাজমা/হাঁপানি ইত্যাদি); 
ত্বকের রোগসমূহ (এলার্জি, বিরক্তিকর যোগাযোগ ডার্মাটাইটিস, ভিটিলিগো ইত্যাদি); 
Musculoskeletal ডিসঅর্ডারস (রেডিয়াল স্টাইলয়েড টেনোসাইনোভাইটিস, ক্রনিক টেনোসাইনোভাইটিস, এপিকন্ডাইলাইটিস ইত্যাদি); 

৩. মানসিক এবং আচরণগত ব্যাধি (দুর্ঘটনা পরবর্তী মানসিক বৈকল্য, অন্যান্য মানসিক বা আচরণগত ব্যাধি);

৪. পেশাগত ক্যান্সার; নিম্নলিখিত এজেন্ট দ্বারা ক্যান্সার (অ্যাসবেস্টস, ক্রোমিয়াম, ভিনাইল ক্লোরাইড, আয়নাইজিং বিকিরণ, কোক ওভেন নির্গমন, কাঠের ধুলো, ক্যাডমিয়াম) সংঘটিত হয়।

উল্লেখযোগ্য পেশাগত ব্যাধির নাম ও কারণঃ উল্লেখযোগ্য পেশাগত ব্যাধির নাম ও কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হলে; এই তালিকাটি সিডিসি, সিসিওএইচএস, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর অকুপেশনাল হেলথ অ্যান্ড সেফটি (এনআইওএসএইচ), আইএলও এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের জন্য ইউরোপীয় সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে তৈরী করা হয়েছে।

ডার্মাটাইটিসঃ পেশাগত ব্যাধির মধ্যে চর্ম জনিত রোগ (অ্যালার্জিক এবং বিরক্তিকর ডার্মাটাইটিস) অন্যতম। এক রিপোর্টে দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেশাগত ব্যাধির ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হল চর্ম জনিত রোগ যা বিস্তৃত ঘটে শারীরিক, জৈবিক বা রাসায়নিক এজেন্টের মাধ্যমে। এই রোগ রোগীর দেহে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।

শ্বাসযন্ত্রের রোগঃ শ্বাসযন্ত্রের রোগ এর মধ্যে অ্যাজমা, ফুসফুসের রোগ এবং ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD) অন্যতম। OHCOW-এর মতে, হাঁপানি কানাডায় সবচেয়ে বেশি পেশাগত ফুসফুসের রোগ হিসেবে বিবেচিত । OHCOW বলে যে কর্মক্ষেত্রে ৩০০ টিরও বেশি রাসায়নিক বস্ত/দ্রব্য রয়েছে যা হাঁপানির কারণ হিসাবে পরিচিত। এই রোগটি গাড়ির যন্ত্রাংশ, ফোম এবং প্লাস্টিক উত্পাদন শিল্পে শ্রমিকদের বেশি সংক্রমিত করে। 

Musculoskeletal Disoders (MSDs)ঃ পেশাগত ব্যাধিরক্ষেত্রে এমএসডি (কারপাল টানেল সিন্ড্রোম বা টেন্ডোনাইটিসের মতো পুনরাবৃত্তিমূলক স্ট্রেন ইনজুরির (RSI)) অন্যতম। সাধারণত যারা অফিসিয়াল এনভায়রনমেন্টে (ডেস্কে) কাজ করেন তারা এই ব্যাধির শিকার হউন। এমএসডি বিকাশ লাভ করে অতিরিক্ত কাজের চাপ, একটানা কাজ করলে, সঠিকভাবে বিশ্রাম না নিলে, ক্রটিপূর্ণভাবে বসার ফলে।
শ্রবণ ক্ষমতার হ্রাসঃ একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে খনি, নির্মাণ এবং উত্পাদন শিল্পে শ্রমিকরা এই সমস্যার সম্মুখীন হন। শ্রবণশক্তি হ্রাস এবং শ্রবণশক্তির সমস্যাগুলি আতিথেয়তা এবং স্বাস্থ্যসেবা সেটিংসেও একটি বড় সমস্যা।

ক্যান্সারঃ  বিশ্বব্যাপী কর্ম সংক্রান্ত মৃত্যুর ২৪ শতাংশের জন্য দায়ী করা হয় ক্যান্সারকে। পেশাগত ক্যান্সার হয় যখন কর্মীরা তাদের কর্মক্ষেত্রে কার্সিনোজেনিক পদার্থের সংস্পর্শে থাকে। কার্সিনোজেন প্রাকৃতিকভাবে পরিবেশে ঘটতে পারে (যেমন সূর্যালোকে অতিবেগুনী রশ্মি এবং নির্দিষ্ট কিছু ভাইরাস) অথবা মানুষের দ্বারা উৎপন্ন হতে পারে (যেমন অটোমোবাইল এক্সস্ট ধোঁয়া এবং সিগারেটের ধোঁয়া)। অ্যাসবেস্টস-সম্পর্কিত রোগগুলি এখন পেশাগত ব্যাধির সবচেয়ে সুপরিচিত। এর মধ্যে রয়েছে ফুসফুসের ক্যান্সার, গ্যাস্ট্রো-অন্ত্রের ক্যান্সার, স্বরযন্ত্রের ক্যান্সার এবং মেসোথেলিওমা (একটি ক্যান্সার যা বেশিরভাগ অভ্যন্তরীণ অঙ্গকে আবৃত করে টিস্যুর পাতলা স্তরে ঘটে)।

স্ট্রেস এবং মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধিঃ মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাধিগুলিকে পেশাগত রোগ হিসাবেও বিবেচনা করা হয়। স্ট্রেস এবং মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধির মধ্যে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য। সাধারণত, সামরিক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও উচ্চ পদে আসন্ন লোকেরা এই ব্যাধির শিকার হন।

সংক্রামক রোগঃ সাধারণত স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা হেপাটাইটিস বি এবং সি, যক্ষ্মা (টিবি) এবং এমনকি হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি) এর মতো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। আরও উল্লেখযোগ্য যে সামাজিক পরিষেবা কর্মীরা টিবি সংক্রমনের ঝুঁকিতে থাকে কারণ তারা উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ জনসংখ্যার সাথে ক্রমাগত যোগাযোগ করে। এবং ল্যাব কর্মীরা সংক্রামক রোগ আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে থাকেন।


পেশাগত স্বাস্থ্যের বিপদ ও ঝুঁকির সাথে পরিচয়ঃ কর্মক্ষেত্রে কর্মীর নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে হলে বিপদ এবং ঝুঁকি সম্পর্কে ধারনা থাকা আবশ্যক। বিপদ হলো কর্মপরিবেশের এমন একটি ত্রুটিপূর্ণ উপাদান বা অস্বাভাবিক অবস্থা বা পদ্ধতি যা দুর্ঘটনা ঘটানো, ক্ষতি করা বা পেশাগত ব্যাধির সৃষ্টির কারণ হতে পারে।  ঝুঁকি হলো কর্মপরিবেশের বিদ্যমান পরিমাপযোগ্য এমন কোন বিপদজনক অবস্থা বা উপকরণ যা ব্যবহারিক পক্রিয়ায় বা আপনা থেকেই দুর্ঘটনা বা ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেমন ভবনে ফাটল সৃষ্টি হওয়া একটি বিপদ, এরুপ ফাটলযুক্ত ভবনে কাজ করা উচ্চমাত্রার ঝুঁকি রয়েছে, যেসব মার্কেটে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নেই সেসব মার্কেটে অগ্নিদুর্ঘটনার উচ্চমাত্রার ঝুঁকি রয়েছে, আবার যেসব কর্মীরা নিরাপত্তা/সেফগার্ডিং নির্দেশিকা সম্পর্কে অবগত নয় তারা তাদের কর্মস্থলে ঝুঁকিতে রয়েছেন। করোনাভাইরাস বর্তমানে বিশ্বে একটি বিপদ হিসেবে কাজ করছে ভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে যিনি বা যারা সেবা দিচ্ছেন তুলনামূলক বেশি মাত্রায় তিনি বা তারা সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। তাই কর্মপরিবেশের বিপদ ও ঝুঁকি পরিমাপ/নির্ণয় করার মাধ্যমে কর্মীর নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব। এবং এই ঝুঁকি কমিয়ে আনা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা কর্মী, নিয়োগকর্তা, গ্রাহক, অংশীজনসহ সবার দায়িত্ব।

কর্মীর পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক আইনি কাঠামোঃ কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের সামগ্রী কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে অনেকগুলো আইন প্রবিধান নীতিমালা রয়েছে। এসব আইনে অন্যান্য বিষয়ের সাথে পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক বিধান সন্নিবেশিত হয়েছে। এ সকল আইন ও বিধি বিধানে তালিকা নিচে দেওয়া হল;
বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ 
বাংলাদেশ শ্রম ও বিধিমালা-২০১৫ 
বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০২০ 
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ 
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭ 
অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন আইন-২০০৩ 
অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন বিধিমালা-২০১৪
শিপব্রেকিং এন্ড রিসাইক্লিং অ্যাক্ট- ২০১৮ 
শিপব্রেকিং এন্ড রিসাইক্লিং রুলস-২০১১ 
জাতীয় শিল্পনীতি-২০১০ 
জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০
জাতীয় শ্রমনীতি-২০১২ 
জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি নীতিমালা-২০১৩ 

নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং শ্রমিকের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৭ অনুচ্ছেদ-১৪, অনুচ্ছেদ-২০ সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কনভেনশন ১৫৫, ১৮৭, ১৬১, প্রটোকল ১৫৫ এবং সুপারিশমালা ১৬৪ ও ১৯৭ কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে । এছাড়াও জাতিসংঘ ঘোষিত অভিবাসী শ্রমিক কনভেনশন ১৯০, সম্প্রতি ঘোষিত কনভেনশন ১৮৯ এবং সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা অন্যতম দলিল। তাছাড়া ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৬০ তম সম্মেলন Global Plan of Action of Workers Health 2008-2007 বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ৫টি উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল।

সর্বোপরি জাতিসঙ্ঘ ২০১৬ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের রোড ম্যাপ ঘোষণা করেছে। ইতোমধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য নির্ধারিত সময় সীমার দুই-তৃতীয়াংশ সময় অতিবাহিত হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টি লক্ষ্যের ৮ নম্বর লক্ষ্য হচ্ছে শোভন কাজ বাস্তবায়ন। শোভন কাজের অন্যতম শর্ত হচ্ছে কর্মক্ষত্রে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটঃ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ বলছে (২০১৬-১৭), দেশে মোট শ্রমশক্তি রয়েছে পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে কাজ করছে পাঁচ কোটি ৫১ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে বস্ত্র ও পোশাক খাতে কাজ করে ৪০ লাখ শ্রমিক। এই পরিসংখ্যানেও দেখা যায়, বিপুলসংখ্যক শ্রমিক পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশের শ্রম আইনে বলা হয়েছে, ৫০ অথবা এর বেশি কর্মী কাজ করে এমন সব প্রতিষ্ঠানে সমান সংখ্যক মালিক ও কর্মী প্রতিনিধিদের নিয়ে সেফটি কমিটি গঠনের কথা। পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি নীতিমালা প্রণয়ন, সেফগার্ডিং নীতিমালা প্রণয়ন, নীতিমালার অরিয়েন্টশন, প্রচার ও বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ। এই কমিটি, নীতিমালা কর্মক্ষেত্রের ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিবে, দুর্ঘটনা ঘটলে সাড়া দিবে, যাতে করে নিরাপদ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করা যায় ও ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায্যতা আদায় হয়। কিন্তু বাস্তবিকক্ষেত্রে অনেক প্রতিষ্ঠানে এই কমিটি ও নীতিমালা অনুপস্থিত যার ফলে কর্মীর পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত। দেখা যায় দুর্ঘটনার পর সবকিছু নেড়েছড়ে বসে, কিছুদিন পর আবার সবকিছু তলিয়ে যায় বা আপোষ হয়ে যায়। গত দশকে বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলিতে এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে,২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরিন ফ্যাশনসে আগুন,২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধস, ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াল অগ্নিদুর্ঘটনা,২০১৯ সালের ২৮ মার্চ দুপুরে ঢাকা, বনানির এফআর টাওয়ারে আগুন, ২০২৩ সালে ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটে আগুন ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। এসব কাঠামোগত দুর্ঘটনার পাশাপাশি অনেক মানবিক দুর্ঘটনাও ঘটে প্রতিষ্ঠানে যেমন, যৌন হয়রানি, শারিরীক অত্যাচার, মানসিক নির্যাতন, বোলিং, অবহেলা, নিপীড়ন, বৈষম্য ও শোষণ ইত্যাদি। এরকম অসংখ্য ঘটনা নিত্যনৈর্মিত্তিক ঘটে চলেছে যেগুলোর কারণগুলো খুব কাছাকাছি।  এমন দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি ও প্রানহাণির জন্য প্রধানত আমাদের অজ্ঞতা ও অসচেতনতাই দায়ী। আমরা একটু সচেতন হলেই অধিকাংশ সংঘটিত দুর্ঘটনা এড়াতে সক্ষম হতাম।  তাই আমি বলব, যথাযথভাবে কর্মক্ষেত্রের কাঠামো উন্নয়নের/নির্মাণ (ভবন নির্মাণ, এবং কারখানা ও রাসায়নিক গুদামের ঝুঁকিমুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ঝুঁকি নির্ণয়) ও কর্মস্থলে কর্মীর অধিকার ও মর্যাদা সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ ও নিরাপত্তা/সেফগার্ডিং পলিসি প্রণয়ন (জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সমন্বয় করে) ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সচেতন করে তুলতে পারলে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। নিশ্চিত করা সম্ভব কর্মীবান্ধব কর্মপরিবেশ, যেখানে সকলে অধিকার মর্যাদা নিয়ে কাজ করবে, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সুনাম, খ্যাতি ও স্থায়ীত্বশীলতা আনয়নে সচেষ্ট হবে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে আমার এই আহবান ও প্রত্যাশা। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়টি আজ অপরিহার্য।

রেফারেন্সঃ
https://www.dailynayadiganta.com/news/printarticle/744061
https://bn.approby.com
https://www.prothomalo.com/bangladesh/
https://mywage.org.bd/labour-laws/health-and-safety-at-work
https://bangla.bdnews24.com/opinion/comment/56004
https://www.who.int/health-topics/occupational-health#
https://www.ecoonline.com/glossary/occupational-health






বৃহস্পতিবার, ৯ মার্চ, ২০২৩

শক্তিশালী ভূমিকম্প আসন্ন; আমাদের প্রস্ততি ও করণীয়

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ ছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে, ভূমিকম্পের ঝুঁকির দিক থেকে বাংলাদেশ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশ ইউরেশিয়ান এবং ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেটের মধ্যে অবস্থিত। তাছাড়া বাংলাদেশে কিছু সক্রিয় সিসমিক ফল্ট রয়েছে যেমন সীতাকুণ্ড-টেকনাফ ফল্ট, রাঙ্গামাটি-বরকল ফল্ট, মধুপুর ফল্ট, সিলেট- আসাম ফল্ট ইত্যাদি। অতীতে এইসব ফল্ট বরাবর বহু ভূমিকম্প হয়েছে। সে জন্য ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা এই সব অঞ্চলকে ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে সতর্ক করেছেন। ১৮৯৭ সালে এই অঞ্চলে ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল যা, গ্রেট ইন্ডিয়া ভূমিকম্প নামে পরিচিত। এই ভূমিকম্পে সিলেট শহরের মারাত্মক ক্ষতি হয়, যেখানে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৪৫ এবং ধসে পড়ে বহু ভবন। সম্প্রতী তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমান্তে আঘাত হানা ভয়াবহ  ভূমিকম্পের ফলে জনে মনে আতংক দেখা দিয়েছে  ভূমিকম্প নিয়ে। তুরস্কের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭.৮। সেই ক্ষেত্রে তুরস্কের ভূমিকম্পকে আমাদের দেশে সংঘটিত ভূমিকম্পের তুলনায় ছোটই বলা চলে। ভূমিকম্পের রিটার্ন পিরিয়ড ধরা হয় ১৫০-২০০ বছর। সে হিসেবে সাইকেলটি এখনো ফিরে আসেনি। সেটি কখন হবে কেউ জানে না। আসলে ভূমিকম্পের পূর্বানুমান করা সম্ভব না। পরিসংখ্যানগত রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে যে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ফ্রিকোয়েন্সি বেড়েছে। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে ঘন ঘন হালকা কম্পন একটি সংকেত দেয় যে একটি শক্তিশালী কম্পন আসছে, যা সবার জন্য উদ্বেগের বিষয়। তার জন্য আমাদের আতংকিত না হয়ে প্রস্ততি নিতে হবে, ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকি বিষয়গুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা্ নিতে হবে। আমরা যদি পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারি তাহলে এসব দুর্যোগ মোকাবিলা করে টিকে থাকা ও ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা আমাদের জন্য অনেক সহজ হবে। তাই জাতীয় দুর্যোগ প্রস্ততি দিবসে এই হউক আমাদের প্রত্যয়, ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের এখনি প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। সেই প্রেক্ষাপটে এবারের জাতীয় দুর্যোগ প্রস্ততি দিবস ২০২৩ এর প্রতিপাদ্য বিষয় “স্মার্ট বাংলাদেশের প্রত্যয় দুর্যোগ প্রস্ততি সবসময়”। 

বিল্ডিং হল ভূমিকম্পের সময় বিপর্যয় সৃষ্টি করে অন্যতম প্রধান উপাদান । নগরায়নের ফলে শহরের জনসংখ্যা দিনদিন বেড়ে চলছে। এই ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠির চাগিদা মিটাতে শহরগুলোতে গড়ে ওঠছে অপরিকল্পিত আবাসন, মানা হচ্ছে না বিল্ডিং কোড। যার ফলে এই ভবনগুলো ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাড়িয়েছে। সম্প্রতী ঘটে যাওয়া তুরস্কের ভূমিকম্পে প্রায় ১ লক্ষ ভবন ধসে পরে, তার কারণ হিসেবে দেখা যায় ঐ শহরের বিদ্যমান পুরাতন বিল্ডিংগুলির খুব কম রেট্রোফিটিং (মজবুতিকরণ) হয়েছে এবং নতুন বিল্ডগুলিতে বিল্ডিং স্ট্যান্ডার্ডগুলির খুব কম প্রয়োগ করা হয়েছে বলে মতামত দিয়েছেন অক্সফোডের গবেষক প্রফেসর এলেক্সজেন্ডার। চুয়েটের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বন্দর নগরী চট্টগ্রামের ৭৮ শতাংশ ভবন বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) লঙ্ঘন করে নির্মিত হয়েছে। এবং ধারনা করা হচ্ছে চট্টগ্রাম শহরের প্রায় ৭০শতাংশ উচ্চ ভবন ধসে পড়বে যদি রিখটার স্কেলে ৭-৮ মাত্রার ভূমিকম্প চট্টগ্রাম শহরে আঘাত হানে। সেই তুলনায় রাজধানীর ঢাকায় আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমাদের দেশের পুরনো ২-৩ বা ৫ তলার যেসব ভবন আছে, যেগুলো ভূমিকম্প সহনীয় নয়, সেক্ষেত্রে এখনই সে ভবনগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল ভূমিকম্প অপ্রত্যাশিত, অনিয়ন্ত্রিত এবং ভূমিকম্প মোকাবেলায় আমাদের দেশের জনগণের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিল্ডিং কোড না মেনে চলা এবং বাসিন্দাদের ভূমিকম্পে সাড়াঁ দেবার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, শহর এলাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়াও, আমাদের শহরগুলোর রাস্তা তুরস্ক ও সিরিয়ার রাস্তার মতো এত চওড়া না, খুবই সরু। আমাদের পুরাতন ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে যদি ভূমিকম্প হয়, দেখা যাবে সেখানে উদ্ধারকর্ম পরিচালনা করার জন্য কোনো গাড়িই বা যন্ত্রপাতি ঢুকতে পারবে না। ফলে উদ্ধার অভিযান বিলম্বিত হবে, ভূমিকম্পে তাৎক্ষণিকভাবে যে পরিমাণ প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হবে তার চেয়ে বেশি প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে, উদ্ধার অভিযানের দীর্ঘতা ও সরঞ্জমাদির অভাবে। তাই আমাদের এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।

ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় আমাদেরকে প্রথমে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলির ম্যাপিং করতে হবে। সেক্ষেত্রে জিআইএস প্রযুক্তির ব্যবহার করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলির অবস্থান নির্ণয় করতে হবে। চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ বিল্ডিংগুলিকে রেট্রোফিটিং (মজবুতিকরণ) নিশ্চিতকরণ করতে হবে এবং নতুন বিল্ডগুলিতে বিল্ডিং স্ট্যান্ডার্ড  বা বিল্ডিং কোড সঠিকভাবে মানা হচ্ছে কি না সেটা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন তৈরি করতে হবে। এইক্ষেত্রে জাপানের ভূমিকম্প প্রমাণ পরিকল্পনা পদ্ধতি অনুসরন করা যেতে পারে। কর্তৃপক্ষকে মাঝে মধ্যে মোবাইল কোট চলমান করে দেখতে হবে, বিল্ডিংগুলো অনুমোদিত প্লানে যেমন ছিল বাস্তবে সেরকম আছে কিনা। ফায়ার সার্ভিসের ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতা বাড়াতে হবে, প্রয়োজনীয় ও আধুনিক সরঞ্জাম কিনে দিতে হবে। স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারের ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং ওয়ার্ড অফিসে কিছু সরঞ্জাম রেখে দিতে হবে। 

ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) মত আমাদের মহল্লায় মহল্লায়ও এরকম ভূমিকম্প প্রস্তুতি কর্মসূচি চালু করতে হবে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে ক্যাম্পেইন আয়োজন করতে হবে। ভূমিকম্প নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা করতে হবে এবং গবেষণার ফলাফল অভিষ্ট জনগোষ্ঠিকে জানাতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভূমিকম্প বিষয়ে জ্ঞানের চর্চা ও বিদ্যমান সম্পদ ব্যবহারে সমন্বয় করতে হবে। ভূমিকম্প নিয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সমূহ কর্মসূচি তৈরী ও বাস্তবায়ন করতে হবে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় ফান্ডিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। বেসরকারি  উন্নয়ন সংস্থাগুলো সরকারের সাথে সমন্বয় করে ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন মহড়া (মকড্রিল) আয়োজন করতে হবে। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের এই মহড়া (মকড্রিল) অংশ নিতে হবে। স্থানীয় কমিউনিটিকে ভূমিকম্পে সাড়াদানে ক্ষমতায়িত করতে হবে, কিছু সরঞ্জাম তাদের কাছে রেখে দিতে হবে এবং নিয়মিতভাবে তা ব্যবহারের চর্চা করতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরকে এই সমস্ত বিষয়গুলোকে সমন্বয় করতে হবে। প্রয়োজনে ভূমিকম্প নিয়েই সরকারের আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান দাড় করাতে হবে, যে প্রতিষ্ঠান শুধু ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলার কাজ করবে। সবার সামগ্রিক প্রচেষ্টায় পূর্ব প্রস্ততির মাধ্যমে ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলায় টিকে থাকা ও ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সহজ হবে।