শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনঃ প্রবালের জীবন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের গঠন, গুরুত্ব ও সংরক্ষণে করণীয়

পৃথিবীর তিনভাগ জল আর একভাগ স্থল। পৃথিবী সৃষ্টির রহস্য লুকিয়ে আছে সমুদ্রে। সমুদ্রে কত প্রজাতির প্রাণি আছে তার সঠিক তথ্য বিজ্ঞানীরা এখনো সঠিকভাবে বলতে পারেনি। ভবিষ্যতে হয়তো জানা যাবে। মনে করা হয়, সমুদ্রের মাত্র এক-দুই শতাংশ প্রাণীকুল সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। সমুদ্রে যত প্রাণী রয়েছে তার মধ্যে প্রবাল (Coral) এক বিষ্ময়কর প্রাণী। প্রাথমিক দৃষ্টিতে প্রবালকে জড়বস্ত মনে হলেও আসলে এরা জীবন্ত সামুদ্রিক প্রাণী। অন্যান্য স্বাভাবিক প্রাণীর ন্যায় এরা খাবার গ্রহণ করে, বংশবিস্তার করে কিন্ত চলাফেরা করতে পারে না। সাগরতলে এক জায়গায় ঘাঁটি গেড়ে সরাটা জীবন কাটিয়ে দেয়। প্রাণীজগতে এদের স্থান অ্যান্থোজোয়া শ্রেণীতে, এরা অমেরুদন্ডী এবং অনেকগুলো প্রজাতি আছে।

এক একটা প্রবাল-প্রাণীকে বলা হয় পলিপ। এই পলিপগুলো সাধারণত আকারে খুবই ছোটো (মাত্র ১/২ মিলিমিটার লম্বা)। এরকম হাজার হাজার প্রবাল-পলিপ সমুদ্রের নিচে কলোনি বানিয়ে একসাথে বাস করে। এই কলোনি থেকেই গড়ে ওঠে প্রবাল প্রাচীর ও প্রবাল দ্বীপ। ধারনা করা হয়, বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বিপ সেন্ট মার্টিন এভাবে গড়ে ওঠেছে। প্রবালের পলিপ নিজের দেহের ওপর ক্যালসিয়াম কার্বোনেট দিয়ে এক বিশেষ খোলস তৈরি করে। একই কলোনির হাজার হাজার পলিপের খোলস পরস্পর জুড়ে গিয়ে ক্রমশ একটা বড়ো কাঠামো গড়ে ওঠে। সেই কাঠামোর ওপরে প্রবাল-পলিপরা মারা যাওয়ার পর সেখানে বেড়ে ওঠে নতুন পলিপদের কলোনি। এই ভাবে শত শত বছর ধরে একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে সমুদ্রের নিচে রূপ নেয় প্রবাল প্রাচীর (Coral Reef)। প্রবাল প্রাচীরগুলো দেখতে অপূর্ব সুন্দর। এগুলো বাদামি, লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, সোনালি, ইত্যাদি নানান রঙে রঙানো থাকে। প্রবালে বসবাসকারী অ্যালজি, স্পঞ্জ ও অন্যান্য জীবরা এতে নানান উপাদান যোগ করে এর বর্ণবৈচিত্রকে আরো বাড়িয়ে তোলে।

প্রবালের খাওয়াদাওয়া, বংশবিস্তার সব কিছুই অদ্ভুত। প্রবাল প্রাণী, তাই তারা উদ্ভিদের মতো নিজেদের খাবার নিজেরা তৈরি করতে পারে না। প্রবালের পলিপগুলো তাদের ছোট ছোট হাত টেন্টাকেলের মাধ্যমে সাগরের জলে ভেসে আসা অতিক্ষুদ্র প্রাণী-প্ল্যাঙ্কটন শিকার করে খায়। সাধারণত রাতের বেলায় এরা এইভাবে শিকার করে খাবর খায়। তবে এইভাবে পলিপগুলো তাদের পুষ্টি চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ পূরণ করে। এদের পুষ্টির বেশিরভাগটা আসে এদের দেহকলায় আশ্রয় নেওয়া অতিসূক্ষ্ম অ্যালজিদের (Zooxanthellae) কাছ থেকে। অ্যালজিদের সাথে প্রবালের বন্ধুত্ব অতি ঘনিষ্ঠ। অ্যালজিরা প্রবাল থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিয়ে সূর্যের আলো ব্যবহার করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার খাবার তৈরি করে। এই তৈরি খাবারের ভাগ পায় প্রবাল। অ্যালজিরা খাবার তৈরির সময় অক্সিজেন ও জৈব উপাদান উৎপাদন করে যা প্রবাল খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। এই প্রক্রিয়াকে সিমবায়োটিক পদ্ধতি বলে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে এই ক্ষুদ্র প্রাণী প্রবাল কোটি কোটি বছর টিকে আছে।  এছাড়াও প্রবাল সাগরের জল থেকে অজৈব ক্যালসিয়াম, নাইট্রোজন, ফসফরাস, ইত্যাদি শোষণ করে কাজে লাগাতে পারে। অ্যালজিরা প্রবালের রং নির্ণয়েও  ভূমিকা রাখে।

প্রবালের প্রজনন বা বংশবিস্তারঃ

প্রবাল সাধারণত দুইভাবে প্রজনন ও বংশবিস্তার করে যেমন; অযৌন এবং যৌনভাবে। অযৌন প্রজননে, নতুন ক্লোনাল পলিপগুলি পিতামাতার পলিপ থেকে অঙ্কুরিত হয় এবং নতুন উপনিবেশ তৈরি করে। এটি ঘটে যখন পিতামাতার পলিপ একটি নির্দিষ্ট আকারে পৌঁছায় এবং বিভক্ত হয়। এই প্রক্রিয়াটি প্রবালের জীবন জুড়ে চলতে থাকে। যৌন জননের ক্ষেত্রে অন্তঃনিষেক ও বহিঃনিষেক, দুই-ই হয়ে থাকে। বহিঃনিষেকের জন্য প্রবালের পছন্দ বসন্তকাল। এই সময় পূর্ণিমা থেকে পরপর ক’দিন, জোছনা রাতে সাগরজলের মায়াবী পরিবেশে প্রবাল প্রাচীরের পলিপরা ডিম্বাণু ও শুক্রাণু ছড়িয়ে যৌন জননে মেতে ওঠে। ডিম্বাণু ও শুক্রাণুগুলোর মিলনে জন্ম নেয় নতুন নতুন পলিপ।

কিভাবে প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন গড়ে ওঠেছেঃ

সমুদ্রের বুকে প্রবাল প্রাচীরগুলো খুব ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। প্রবাল বংশ বিস্তারের জন্য সমুদ্রজলের উষ্ণতা ২০ সেঃ- ২১ সেঃ আদর্শ িএবং সে অংশে সূর্যালোক পৌঁছা আবশ্যক। তাই গ্রীষ্মমন্ডলীয় অংশে প্রবাল দ্বীপ গড়ে ওঠেছে।  প্রবাল প্রাচীর লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বাড়তে বাড়তে একসময় ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের ফলে দ্বীপে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর বৃহত্তম প্রবাল প্রাচীর হলো অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড উপকূলের কাছে অবস্থিত গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ। সেন্টমার্টিন দ্বীপটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ মূলত জীবন্ত প্রবাল দ্বারা গঠিত। প্রবাল পলিপ নামক সামুদ্রিক প্রাণী চুনযুক্ত কঙ্কাল তৈরি করে। এই কঙ্কাল একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে প্রবাল প্রাচীর গঠন করেছে। ধারনা করা হয়, প্রাচীনকালে বঙ্গোপসাগরের পানির তলদেশে প্রবাল বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ধীরে ধীরে স্তূপ আকারে উঁচু হতে শুরু করে। ভূগোলবিদদের মতে, বঙ্গোপসাগরের তলদেশে টেকটোনিক প্লেটের ধাক্কা ও আন্দোলনের ফলে এক ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের কিছু অংশ উঁচু হয়ে দ্বীপ হিসেবে উত্থিত হয়। এবং পরবর্তিতে প্রবাল গঠনের আর্দমিক পরিবশে পেয়ে বঙ্গোপসাগরের পানির তলদেশে প্রবাল বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ধীরে ধীরে স্তূপ আকারে উঁচু সেন্টমার্টিন দ্বীপ গড়ে ওঠে। প্রবাল প্রাচীরের সাথে পলি ও বালি জমা হয়ে দ্বীপের মাটি শক্ত হয়। সময়ের সাথে সাথে ঢেউ, বায়ুপ্রবাহ এবং সমুদ্রের স্রোত দ্বীপটির প্রান্তে পরিবর্তন ঘটায়। এই প্রক্রিয়া সেন্ট মার্টিনের আকৃতি ও গঠনকে আরও উন্নত করে।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সুনির্দিষ্ট বয়স নির্ধারণ করা কঠিন, কারণ এটি প্রাকৃতিকভাবে গঠিত এবং এর গঠন প্রক্রিয়া কয়েক হাজার বছর ধরে চলেছে। তবে ভূতাত্ত্বিক গবেষণার ভিত্তিতে ধারণা করা হয় যে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের গঠন শুরু হয়েছিল প্রায় ৬,০০০ থেকে ৭,০০০ বছর আগে। প্রবাল গঠনের হার খুবই ধীর, প্রতি বছরে মাত্র কয়েক মিলিমিটার। এর ভিত্তিতে বোঝা যায় যে দ্বীপটি কয়েক হাজার বছর ধরে ধীরে ধীরে গঠিত হয়েছে।

প্রবাল প্রাচীর গড়ে ওঠার কারণ ও সহায়ক নিয়ামকঃ

১. সমুদ্রজলের উষ্ণতা ও গভীরতা : প্রবাল কীটের পলিপের বংশ বিস্তারের জন্য সমুদ্রজলের উষ্ণতা অবশ্যই ২০ সে.-২১ সে. হওয়া দরকার এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬০-৭৫ মিটার গভীরতায় প্রবালকীট পলিপ বৃদ্ধির সহায়ক, কারণ এই গভীরতা পর্যন্ত অংশে সূর্যালোক পৌঁছায়।

২. জলের আলোড়ন ও সমুদ্র স্রোত : জলের আলোড়ন ও সমুদ্রস্রোত প্রবাল কীট পলিপের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অক্সিজেনের জোগান অব্যাহত রাখে। এজন্য জীবন্ত প্রবাল কীট উপহ্রদের পরিবর্তে উন্মুক্ত সমুদ্রে বেশি লক্ষ্য করা যায়।

৩. পলিমুক্ত স্বচ্ছ জল : প্রবাল কীটের মুখে পলিকণা জমতে থাকলে তারা অক্সিজেন নিতে পারে না। ফলে এরা পরিপাক করতে পারে না ও মারা যায়। সেই জন্য পলিমুক্ত স্বচ্ছ জল দরকার।

৪. মিষ্টি জলের প্রভাব মুক্ততা : পরিষ্কার মিষ্টি জল প্রবাল কীটের পক্ষে ক্ষতিকর বলে মোহানা থেকে দূরে এরা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।

৫. লবণতার পরিমাণ : প্রচুর পরিমাণে চুনের কার্বোনেট প্রবাল কীটের প্রধান খাদ্য। জলের গড় লবণতা ২৭% থেকে ৪০%-এর বেশি হয়ে গেলে ওই কার্বোনেটের পরিমাণ কমে যায় এবং প্রবালকীট বংশবিস্তার করতে ব‍্যহত হয়।

৬. অন্তঃসাগরীর মঞ্চের অবস্থান : তটভূমি বরাবর  ১০০ মিটার গভীরতায় মহাদেশীয় শক্ত শিলার উপস্থিতি প্রবাল কীটের সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপনের সহায়ক।

সেন্ট মার্টিন প্রবাল দ্বীপের গুরুত্বঃ

সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। পাথুরে এ দ্বীপটি তার অনন্য জীববৈচিত্র্য এবং প্রবালসমৃদ্ধ পরিবেশের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এটি কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য নয়, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশগত সুরক্ষা, এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯৭ সালের পর থেকে এ দ্বীপের প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ সরকারি জরিপ হয়নি। ১৯৯৭ সালে কানাডিয়ান সমুদ্রবিজ্ঞানী থমাস তমাসিকের নেতৃত্বে একটি গবেষণায় সেন্টমার্টিনের সমৃদ্ধ প্রাণ-প্রকৃতির তথ্য পাওয়া যায়। সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য রক্ষায়  প্রবাল দ্বীপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থলঃ প্রবাল দ্বীপকে "সামুদ্রিক বন" বলা হয়। এটি বিশ্বের ২৫% সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য বাসস্থান সরবরাহ করে। সমুদ্রতলের মাত্র ১ শতাংশ জায়গা দখল করে থাকা প্রবাল প্রাচীরগুলো সমস্ত সামুদ্রিক প্রজাতির প্রায় ২৫ শতাংশকে আশ্রয় দেয়।  সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রবালের পাশাপাশি মাছ, কাঁকড়া, শামুক, ডলফিন, সামুদ্রিক কচ্ছপসহ অসংখ্য সামুদ্রিক জীবের বাসস্থান রয়েছে। এখানে বেশ কয়েকটি বিরল এবং হুমকির মুখে থাকা প্রাণী যেমন অলিভ রিডলে কচ্ছপ দেখা যায়। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, দ্বীপটিতে রয়েছে ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল এবং কচ্ছপ, কাঁকড়াসহ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী। তবে এসব তথ্য দীর্ঘদিন ধরে হালনাগাদ হয়নি। বিচ্ছিন্ন কিছু গবেষণায় প্রবালের সংখ্যা কমার প্রমাণ মিললেও নতুন স্থানে প্রবালের জন্মও লক্ষ্য করা গেছে।

পর্যটন শিল্পে ভূমিকাঃ সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। এর স্বচ্ছ নীল পানি, প্রবাল পাথর, এবং মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। প্রতিবছর ৪-৫ লক্ষ পর্যটক এই দ্বীপে ভ্রমন করে থাকেন। পর্যটন থেকে স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হয় এবং অনেক মানুষের জীবিকা নির্বাহের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

উপকূলীয় সুরক্ষাঃ দ্বীপটি বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকাকে জলোচ্ছ্বাস ও ঝড়ের প্রভাব থেকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে। প্রবাল প্রাচীর প্রাকৃতিক বাঁধের মতো কাজ করে, যা সাগরের ঢেউ ও জোয়ারের তীব্রতা কমায়।

পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষাঃ প্রবাল প্রাচীর সমুদ্রের জলের গুণগত মান উন্নত করে এবং সামুদ্রিক খাদ্যজাল বজায় রাখে। এটি কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে ভূমিকা রাখে।

গবেষণা ও শিক্ষাঃ সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পরিবেশ ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি উন্মুক্ত ল্যাবরেটরি, যেখানে তারা সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে শিক্ষা নিতে পারে।

স্থানীয় সংস্কৃতি ও জীবিকাঃ  স্থানীয় মানুষের জীবিকার একটি বড় অংশ মাছ ধরা এবং পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত। দ্বীপটির পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সরেজমিনে দেখা গেছে, গত দু'দশক ধরে পর্যটনে নির্ভর দ্বীপবাসী পূর্ব পুরুষদের পেশা মাছ ধরা ধীরে ছেড়ে দিয়েছে। ছেড়ে দিয়েছে পুরো দমে চাষাবাদও।

ঔষধি ও প্রাকৃতিক সম্পদঃ সেন্ট মার্টিনের প্রবাল প্রাচীর থেকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান পাওয়া যায়, যা ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার হতে পারে। প্রবাল প্রাচীর থেকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক যৌগ সংগ্রহ করা হয়, যা ক্যান্সার, এইচআইভি, আর্থ্রাইটিস, এবং অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার হয়।

সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ সুরক্ষায় আইনি কাঠামো ও সরকারের পদক্ষেপসমূহঃ
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সর্বশেষ ২০২০ সালের আগস্টে সেখানে পর্যটক নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০২১ সালের ২ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। এতে সেন্ট মার্টিনের সৈকতে আলো জ্বালিয়ে বারবিকিউ, দোকানপাটে বেচাকেনা, সৈকতের পাথরে সংগ্রহ, মোটরসাইকেলসহ যেকোনো ধরনের যানবাহনে চলাচল নিষিদ্ধসহ ১৪টি বিধিনিষেধ আরোপ করে।  ২০২৩ সালে জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পর্যটক নিয়ন্ত্রণ, টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল সীমিত করাসহ ১৩টি বিষয়ে নীতিমালা তৈরি করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। সেন্ট মার্টিন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালে, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সভায় সেন্ট মার্টিনে চার মাস পর্যটকদের যাতায়াত ও অবস্থান সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নভেম্বরে পর্যটকেরা যেতে পারলেও রাতে থাকতে পারবেন না। আর ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে গিয়ে রাতেও থাকতে পারবেন। তবে ওই সময় দিনে দুই হাজারের বেশি পর্যটক যেতে পারবেন না। আর ফেব্রুয়ারিতে পর্যটকেরা সেখানে যেতে পারবেন না। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পর্যটন নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগের বিষয়টি নিয়ে উল্টো প্রচার শুরু হয়। সেখানে মার্কিন ঘাঁটি তৈরিসহ নানা ধরনের অপপ্রচার চলতে থাকে। সরকারের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মাঠে নেমেছে ‘কক্সবাজারে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পরিবেশ ও পর্যটন উন্নয়ন জোট’ নামের একটি সংগঠন। সংশ্লিষ্টদের মতে, পর্যটন সীমিত করার ফলে এই খাতের সঙ্গে জড়িত ও স্থানীয় মানুষদের জীবন ও জীবিকাতেও আঘাত এসেছে। সেখানকার কুকুরগুলো খাদ্য অভাবে মারা যাচ্ছে। 

গত দুই যুগে ধরে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের কারণে, হাজার বছরের পুরোনো দ্বীপটির  মাটি, পানি ও বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, পর্যটনের কারণে উচ্চ তাপমাত্রার পাশাপাশি লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন উজাড়, দূষণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, কচ্ছপের আবাস ধ্বংস, প্লাস্টিকের ব্যবহার, মিঠাপানির সংকট, জোয়ারে সমুদ্রভাঙনসহ নানা বিপদ দেখা দিয়েছে। দ্বীপটির পরিবেশ রক্ষার জন্য টেকসই ব্যবস্থাপনা, সচেতন পর্যটন এবং সরকারের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।

সেন্ট মার্টিন সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা ও অস্বচ্ছতা দূর করতে সরকার সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ সুরক্ষায় ফেব্রুয়ারী মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ সাসটেইনেবল এলায়েন্স (বিএসএ)উদ্যোগে নেওয়া হয়েছে সমুদ্র সৈকত পরিছন্নতা কার্যক্রম। এই আয়োজনে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। স্থানীয় জনগণের পরিবেশ স্বাক্ষরতা ও সমুদ্র সৈকত পরিছন্নতা কার্যক্রমে কারিগরী জ্ঞান প্রদান করে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ইপসা। এই কার্যক্রমে উপস্থিত ছিলেন টেকনাফ উপজেলার নির্বাহী অফিসার, পরিবেশ অধিদপ্তর, কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রবৃন্দ, ছাত্র প্রতিনিধি, পরিবেশ কর্মী, শিক্ষক এবং সেন্টমার্টিনে অবস্থানরত বিভিন্ন সংগঠন ও পেশাজীবি’র প্রতিনিধি।


শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনের পূর্ব শর্ত সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

চট্টগ্রাম বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী ও অন্যতম বন্দর নগরী । আকার ও জনসংখ্যার দিক থেকে রাজধানী ঢাকা’র পরেই চট্টগ্রামের স্থান। পাহাড় আর সমুদ্র দিয়ে ঘেরা চট্টগ্রাম শহর। ১৯৯০ সালে এই শহরের জনসংখ্যা ছিল ২০ লক্ষ, বর্তমানে এই শহরের লোকসংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ। কিন্ত ৩৫ বছরে শহরের আয়তন বাড়েনি। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে উন্নত যোগযোগ ব্যবস্থা, কর্মসংস্থানের সুযোগ, এই শহরের জনসংখ্যা জ্যামিতিক আকারে বাড়ছে। বর্ধিত জনসংখ্যা ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে হারিঁয়ে যাচ্ছে  প্রকৃতির আশীর্বাদখ্যাত চট্টগ্রাম শহরের সৌন্দর্য। এছাড়া বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিগত প্রায় কয়েক দশক ধরেই এই নগর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি,  জোয়ার-ভাটা, পাহাড় ধসসহ বিভিন্ন দুর্যোগে আক্রান্ত হচ্ছে নিয়মিত। চট্টগ্রামে গত দুই দশকে যে সমস্যাটি নগরবাসীকে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে ফেলেছে সেটি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। প্রতি বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির সময় নগরের অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। নগরের জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ শহরের বর্জ্যগুলো খাল-নালায় গিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি। জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরে  প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার চারটি প্রকল্প চলমান। নগরবাসীর মতে, উপরোক্ত প্রকল্পের মধ্যে আন্ত:সমন্বয়ের অভাব রয়েছে, বিশেষ করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নতিকরণের কোন সম্পূরক প্রকল্প না থাকা। ফলে নগরবাসী আশংকা করছে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নতি না করলে জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প ভেস্তে যেতে পারে। সামনের বর্ষা মৌসুমের আগেই এই বিষয়ে নিয়ে ভাবতে হবে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মতে, একজন নাগরিক প্রতিদিন গড়ে ৬০০ গ্রাম (বিশ্বব্যাংকের মতে, ৭৪০ গ্রাম) বর্জ্য উৎপাদন করে। সে হিসেবে, ৭০ লাখ লোক চট্টগ্রাম নগরে প্রতিদিন ৪২০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন করে। বছরে উৎপন্ন হয় ১৫ লক্ষ ৩৩ হাজার টন বর্জ্য। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৯ লাখ ১৩ হাজার টন বর্জ্য সংগ্রহ করেছে। তাহলে বাকি, ৬ লক্ষ ২০ হাজার টন বর্জ্য খাল-নালা, নদীতে ও পরিবেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই অসংগ্রহীত বা ব্যবস্থাপনার বাহিরের বর্জ্য নগরের জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ। এই অব্যবস্থাপনাকৃত বর্জ্য সংগ্রহে বা ব্যবস্হাপনায় আনতে কোন উদ্যোগ বা প্রকল্প নগরবাসীর জানা নেই। তাই জনমনে শংকা দেখা দিয়েছে, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সফলতা ও কার্যকারিতা নিয়ে। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পগুলোর কৌশলহলো চট্টগ্রাম শহরের খাল-নালা, নর্দমাগুলোর পরিস্কার, সংস্কার, পুনঃখনন, সম্প্রসারণ ইত্যাদি। সরেজমিনে দেখা গেছে, খালগুলোর পরিস্কারের সাথে সাথে সেগুলো আবার বর্জ্যে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নগরের অনেক জায়গায় বাসা-বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা বর্জ্য ডাম্প করা হয় খালের পাড়ে। উম্মুক্ত জায়গায় রাখা এইসব বর্জ্য পরিবেশ দূষণ করছে ও একসময় খালে পড়ে খাল ভরাট করছে। যার ফলে খালের পানি চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। নগরের উৎপাদিত বর্জ্য সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা না আনতে পারলে, প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও নগরের জলাবদ্ধতার তেমন কোন পরিবর্তন আসবে না।

চট্টগ্রাম শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নীতিগত দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের। শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতিতে কাজ করছে সিটি করপোরেশন। উৎস হতে বর্জ্য সংগ্রহের জন্য সিটি করপোরেশন ২০১৬ সাল থেকে “ডোর টু ডোর কর্মসূচীর” মাধ্যমে ১৯৯৫ সেবক এই কর্মসূচীতে নিয়োজিত করেছে। তাছাড়া, ড্রেন ক্লিনার, রাস্তার ঝাড়ুদার, বর্জ্য লোডিং এবং আনলোডিং শ্রমিক, স্প্রে ম্যান, ভ্যান চালক ও ওজন কর্মীসহ সব মিলিয়ে ৩৬৫৫ শ্রমিক বর্জ্য সংগ্রহে নিয়োজিত রয়েছে। তারা প্রাথমিক উৎস পয়েন্ট (বাসাবাড়ি) থেকে বর্জ্য সংগ্রহ (রিকশা, ভ্যান, টমটম মাধ্যমে) করে সেকন্ডারী পয়েন্ট (ডাস্টবিন, কন্টেইনার, এসটিএস) রেখে আসে, সেখান থেকে সিটি করপোরেশনের গাড়ি (ডাম্প ট্রাক, কম্পেকটর) করে এইসব বর্জ্য ল্যান্ডফিলে চুড়ান্তভাবে নিস্কাশন করা হয়। ৭০ লক্ষ নগরবাসীর সৃষ্ট বর্জ্য মাত্র ১৯৯৫ সেবক দিয়ে সংগ্রহ করা রীতিমত চ্যালেঞ্জ, তাই অনেকক্ষেত্রে সঠিক, পরিপূর্ণ নিয়মিতভাবে বর্জ্য সংগ্রহ ব্যহত হচ্ছে। প্রাথমিক উৎস থেকে বর্জ্য সংগ্রহের বিষয়টি প্রাইভেট সেক্টর বা কমিউনিটি ভিত্তিক সংগ্রহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে সাশ্রয়ী, ফলপ্রসু ও কার্যকর হবে। সেকেন্ডারী পয়েন্ট থেকে ল্যান্ডফিলে চুড়ান্তভাবে নিস্কাশন বিষয়টি সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে। সেক্ষেত্রে, সেকেন্ডারী কালেকশন পয়েন্ট, সেকেন্ডারি ট্রান্সপার স্টেশন এর আধুনিকায়ন করতে হবে। এবং সেকেন্ডারী কালেকশন পয়েন্ট, সেকেন্ডারি ট্রান্সপার স্টেশন হতে বর্জ্য চুড়ান্তভাবে নিস্কাশনের জন্য ব্যবহ্রত পরিবহন মাধ্যমগুলোর পর্যাপ্ততা ও আধুনিকায়ন নিশ্চিত করতে হবে। চট্টগ্রাম শহরে যে দুটি ল্যান্ডফিল (আরেফিন নগর ও আনন্দ বাজার) রয়েছে সেগুলোর আধুনিকায়ন করতে হবে সেনিটারি ল্যান্ডফিল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে নতুন আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব ল্যান্ডফিল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহার করতে হবে। চট্টগ্রাম সিটির উৎপাদিত বর্জ্যের ৬৩শতাংশ হল খাদ্যের উচ্ছিষ্টাংশ বা খাদ্যবর্জ্য, ১০ শতাংশ হল কাগজ জাতীয় বর্জ্য, ৯ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য, কৃষিজ বর্জ্য ৭ শতাংশ, বাকিগুলো অন্যান্য বর্জ্য। শহরের উৎপাদিত ৮০-৯০ শতাংশ বর্জ্যই পুনর্ব্যবহারযোগ্য। পরিসংখ্যানে দেখা যায় চট্টগ্রামে বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের হার মাত্র ৮-১০%। এই বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করতে পারি। যার ফলে, অর্থনৈতিকভাবে লাভবান, কার্বন নিঃসরণ কমানো ও দূষণের হাত থেকে পরিবেশকে রক্ষা করতে পারি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বৃত্তাকার অর্থনৈতিক মডেল চালু করতে হবে।  বৃত্তাকার অর্থনৈতিক মডেলে উৎপাদন ও ভোগের মধ্য সমন্বয় সাধন করে। এটি পণ্যের সম্ভব অতিরিক্ত মূল্য নিশ্চিত করে এবং পণ্যের জীবনচক্রকে প্রসারিত করে। 

চট্টগ্রাম শহরে উৎপাদিত বর্জ্যকে, পুনর্ব্যবহারকরণের পথে অন্যতম বাধাঁ হলো উৎসে বর্জ্য পৃথকীকরণ না হওয়া। বর্জ্য উৎসে পৃথকীকরণ না হলে সেটাকে প্রসেস করা সময় ও ব্যয় সাপেক্ষ। সেক্ষেত্রে, নগরবাসীকে উৎসে বর্জ্য পৃথকীকরণের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পচঁনশীল, অপচঁনশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য আলাদা করে রাখার অভ্যাগ গড়ে তুলতে হবে। বর্জ্য সংগ্রহে কালার কোডেড বিন ব্যবহারকে প্রচার এবং নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে, ‍মিক্সড বর্জ্য থেকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য আলাদাকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য সংগ্রহের জন্য বর্জ্য সংগ্রহকারীদের  প্রশিক্ষণ ও অনুদান প্রদান করতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ভ্যালু চেইন নির্ণয় করে, সেখানকার ইনসেনটিভ ও ইন্টারেস্টকে অবহিত করে এক্টরদেরকের কানেকটেড করতে হবে। উৎপাদনকারীকে ভোক্তা পর্যায়ে সৃষ্ট বর্জ্য সংগ্রহ বা ব্যবস্থাপনায় কাজ করতে হবে।

জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মধ্যে নিয়মিত সমন্বয় ও সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে ওয়াসা, চট্টগ্রাম বন্দর, বেসরকারী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অর্ন্তভূক্ত করা যেতে পারে।

সর্বোপরি, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের পঞ্চম তফসিলে বর্জ্য ফেলে খাল-নালা ভরাটকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। অপরাধ দন্ডের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সিটি করপোরেশনকে। আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে, যত্রতত্র ময়লা ফেলা বন্ধে জরিমানা ও কঠোর শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে হবে। তবেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নতি হবে। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের সুফল পাবে নগরবাসী।


শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০২৫

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি কমিয়ে আনতে যুবদের ভূমিকা

পৃথিবীর জনসংখ্যার বড় একটি অংশ যুব শ্রেণির জনগোষ্ঠি, এই সংখ্যা প্রায়ই ১.২ বিলিয়ন। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৪% যুব, এই সংখ্যা প্রায়ই প্রায় ৫ কোটি। বাংলাদেশ বর্তমানে "ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড"-এর পর্যায়ে রয়েছে, এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। আমি মনে করি, টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত উন্নয়ন কার্যক্রমে যুবদের অংশগ্রহণ। তাই, উন্নয়ন চক্রে যুবদের সক্রিয়তা, অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশীদার, বাস্তবায়নের সহযোদ্ধা ও মনিটরিংয়ে যুবদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে  উন্নয়নের বিভিন্ন স্তরে নতুন ধারণা, উদ্ভাবন এবং ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। 

জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমানে বৈশ্বিক একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ এর অন্যতম । জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় যুবরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাদের অংশগ্রহণ, সৃজনশীলতা এবং জলবায়ু সহনশীল প্রযুক্তির ব্যবহার টেকসই পরিবর্তন আনতে যুবরা সহায়ক হতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন কি

আবহাওয়ার সেই চেনাজানা ধরন বদলে যাওয়াকেই বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। যেমন, বাংলাদেশে শীতকাল শুরু হবার কথা নভেম্বরের শেষ থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত, সেখানে ডিসেম্বর মাসেও কোন শীত অনুভূত হয়নি। ষড় ঋতুর বাংলাদেশে এখন বছরের ১০ মাসেই গ্রীষ্মকাল বা গরমকাল অনুভূত হয়। তার মানে বাকি যে চারটি ঋতু রয়েছে, তাদের উপস্থিতি এখন আর বুঝা যায় না। বাংলাদেশে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ও সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে, পৃথিবী গরম হয়ে পড়ছে এবং দ্রুত বদলে যাচ্ছে আবহাওয়ার বহুদিনের চেনাজানা আচরণ।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ

জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী একটি আলোচিত বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তন একটি দীর্ঘমেয়াদী ফল ও অন্যতম কারণ হল প্রাকৃতিকগত কারণ। প্রাকৃতিক কারণসমূহ কন্টিনেন্টাল ড্রিফট’ বা মহাদেশীয় সরণ, আইসোস্ট্যাসিস চলন, অরোজেনিক চলন, আগ্নেয়গিরির অগ্নি-উৎপাত ‘আরথস টিল্ট বা পৃথিবীর হেলে থাকা ২৩.৫০, ও সমুদ্রের স্রোতপ্রবাহ ইত্যাদি। পৃথীবীর বয়স ৪.৫৪ বিলিয়ন, জিওলজিক্যাল টাইম স্কেল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পৃথীবী এখন হলোসিন এপোক পার করছে, যেটি শুরু হয়েছে আজ থেকে ১০,০০০ হাজার বছর আগে। পৃথীবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ২০ টি বরফ যুগ ও বরফগলা যুগ (ইন্টার গ্লেসিয়াল যুগ) অতিক্রম করেছে। জলবায়ুগত পরিবর্তরে কারলে ডাইনুসরের মতে প্রানী পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে আমরা ইন্টার গ্লেসিয়াল যুগ অতিক্রম করছি, যেটি শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২.৭ মিলিয়ন বছর আগে। যখন পৃথীবীতে মানুষ ছিল না, শিল্প-কারখানা ছিল না তখন থেকেই বরফগলা যুগ শুরু হয়েছে।  তাহলে আমরা বলতে পারি জলবায়ু পরিবর্তন একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। তবে, বর্তমান দুনিয়া, বিশ্ব উষ্ণায়ন বা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কেন এ চিন্তিত! সাধামাটা উত্তর, জলবায়ু পরিবর্তন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া হলেও এটিকে ত্বরানিত করছে মানুষ ও মানুষের কর্মকান্ড। মানুষ যখন থেকে কল-কারখানা এবং যানবাহন চালাতে বা শীতে ঘর গরম রাখতে তেল, গ্যাস এবং কয়লা পোড়াতে শুরু করলো (১৮৮০ সাল,  শিল্প বিপ্লবের পর) সেই সময়ের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা এখন ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। বায়ুমণ্ডলে অন্যতম একটি গ্রিন হাউজ গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ উনবিংশ শতকের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে।। গত দুই দশকে বেড়েছে ১২ শতাংশ, বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণেও বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যান্য কারণগুলো হল; সামাজিক কারণ; সমাজের প্রচলিত নিয়ম, নীতি, আইন ও জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। বাস্তুচ্যুতি, খাদ্য নিরাপত্তা, নগরায়ন, পানির ঘাটতি এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা ইত্যাদি। তাছাড়া, রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোও জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে, সেগুলেকে বলা হয় জলবায়ু পরিবর্তনের রাজনৈতিক কারণ। তাই, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হিসেবে প্রাকৃতিক, মানব সৃষ্ট, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণকে ধরা হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

বিশ্বজুড়ে জৈব জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং বন ধ্বংসের ফলে বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড এর মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা বায়ুমন্ডলকে উত্তপ্ত করছে। এর ফলে মেরুর হিমবাহ ও পর্বতের চুড়ার বরফ দ্রুত গলছে যার ফলে দীর্ঘমেয়াদী বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে এবং সমুদ্রতলের উচ্চতা বাড়ছে। বায়ুমন্ডলের বাড়তি উত্তাপের ফলে পৃথিবীর কোন কোন অঞ্চলে অনাবৃষ্টিজনিত শুস্কতার ফলে মরুকরণ দেখা দিয়েছে এবং চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। আবার সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। গ্লোবাল কাইমেট রিস্ক ইনডেক্স-২০১৭ এর মতে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্থ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬ষ্ঠ । জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে একাধারে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা সমস্যা, নদীর তলা ভরাট, বন্যা, খড়া, অতিবৃষ্টি, বর্জ্রপাত, ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত তালিকায় বন্যার জন্য ঝুকিপূর্ণ ১২ টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অবস্থান ১ম। Bangladesh Institute of Water Modeling মতে বাংলাদেশে বন্যাপ্রবণ এলাকার পরিমাণ বেড়েছে, যেমন ২০২৪ সালে সংঘটিত ইস্টার্ন ফ্লাড, বাংলাদেশের প্রায় ১১টি জেলায় বন্যা আক্রান্ত হয় তার মধ্যে, ফেনী, লক্ষীপুর, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অন্যতম। এইসব জলবায়ুগত পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের ফলে ঐ সব এলাকায় বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে ঐ সব এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে এবং জনসাধারণ ঐ সকল এলাকা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবেই সৃষ্টি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত বা স্থানচ্যুত। সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক সংস্থা ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের (আইডিএমসি) মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষের সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় এবং এর সংখ্যা প্রায় ৫৭ লাখ। আর এই স্থানচ্যুত মানুষগুলো জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে আশ্রয় নিচ্ছে নগরে, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের বস্তিগুলোতে। দেশের মোট বস্তিবাসীর অর্ধেকের বেশি বসবাস করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে। আইওএম এর মতে, নগরের বস্তির ৫০ শতাংশই বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠি যারা নদী ভাঙ্গনসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত বস্তি শুমারী-২০১৪ অনুযায়ী বাংলাদেশে বস্তিবাসীর সংখ্যা গত দুই দশকে প্রায় তিনগুন বেড়েছে। বস্তি শুমারী-২০১৪ অনুযায়ী দেশে এখন সাড়ে ২২লাখ মানুষ বস্তিতে বসবাস করে। তবে, নগরবিদরা বলেছেন বাস্তবিকভাবে এই সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। বস্তি শুমারী-২০১৪ অনুযায়ী দেশের বস্তির মোট ১৬ শতাংশ চট্টগ্রাম সিটি এলাকায়, যেখানে ১লক্ষ ২৮ হাজার পরিবারের বসবাস। বস্তিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে তিনটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে তাদের মধ্যে নদী ভাঙ্গনসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ অন্যতম।  বঙ্গোপসাগরের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে ৭১০ কি.মি দীঘ উপকূলভাগ, UNFCCC মতে, বিংশ শতাব্দিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা ১০-২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে, ২০৫০ সাল নাগাত সমুদ্রপ্রষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি হলে ১৭% ভূমি সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। SCAIR মতে. যে হারে এন্টাকটিকার বরফ গলছে, তাতে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপুষ্ঠ উচ্চদা বাড়বে ৫ ফুট। ধারনা করা হচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি সাত জনের একজন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে স্থানচ্যুত হবেন এবং এর সংখ্যা হবে প্রায়ই ২০ মিলিয়ন। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ  ৩ কোটি মানুষ গৃহহীন হতে পারে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির মতে, বাংরাদেশে প্রতিবছর ১-১.৫ কোটি মানুষ বড় বড় শহরের দিকে ধাবিত হচ্চে। এসব উদ্বাস্তুর কারণে বড় বড় শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে চাপ পড়েছে রাজধানী ও বিভাগীয় শহরগুলোতে। ১৯৭২ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৬,৮৮,০০০ সেখানে ২০২৩ সালে হয় ২৩,২১০,০০০ । বিশ্বব্যাংকের মতে ২০২৫ সালে ঢাকার জনসংখ্যা হবে ২.৫ কোটি।

গবেষণায় দেখা যায় এই বাস্তুচ্যুত মানুষেরা নগরের বস্তিতে, বাঁধের পাশে, মহাসড়কের পাশে বা কোন পতিত জমিতে মানবেতরভাবে জীবন যাপন করছে। শহরে এসে তারা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন যেমন, নিরাপদ আবাসন সংকট, শোভন কর্মপরিবেশের অভাব, বিশুদ্ধ পানীয় খাবারের অভাব, পয়ঃনিস্কাশন অভাব, উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার অভাব, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাব, আইনি সহায়তা বা প্রবেশম্যতার সীমাবদ্ধতা, দক্ষতা ও নেতৃত্ব বিকাশ ব্যবস্থার অভাব, বিনোদনের অভাব ও সবধরনের নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। 

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি পুষিয়ে আনতে যুবদের করনীয়:

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও ক্ষতি পুষিয়ে আনতে যুবদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। যুবসমাজ তাদের উদ্যম, সৃজনশীলতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবিলায় বিভিন্নভাবে অবদান রাখতে পারে। যুবরা দুর্যোগ প্রস্ততি, সাড়া, পুনরুদ্ধার এবং অভিযোজন ধাপে কাজ করতে হবে। 

প্রস্তুতি: জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বা দুর্যোগে প্রস্তুতি বলতে বোঝায় সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। এর মধ্যে রয়েছে সচেতনতা বৃদ্ধি, দুর্যোগ মোকাবিলার পরিকল্পনা তৈরি, এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সামর্থ্য গড়ে তোলা। যুবসমাজ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাদের সম্ভাব্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে: সচেতনতা বৃদ্ধি: স্থানীয় মানুষদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে জানানো; বিদ্যালয়, মহল্লা বা কমিউনিটিতে কর্মশালা আয়োজন; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারাভিযান চালানো। প্রাক-দুর্যোগ প্রস্তুতি: নিরাপদ আশ্রয়স্থল চিহ্নিত করা এবং মানুষকে সেখানে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করা; প্রাথমিক চিকিৎসা বা উদ্ধার কার্যক্রমের প্রশিক্ষণ নেওয়া; বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, বা ভূমিধসের মতো পরিস্থিতিতে কীভাবে কাজ করতে হবে, তা শিখে রাখা।  পরিবেশ সুরক্ষা উদ্যোগ: গাছ লাগানো এবং বন সংরক্ষণ; বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ; পুনর্ব্যবহারযোগ্য জিনিস ব্যবহার ও প্রসার করা। যেমন; ইপসা’র যুবরা ইয়ুথ লিড ক্লাইমেট এ্যাকশন প্রকল্পের মাধ্যমে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য সমুদ্রের প্রাচীর/বাঁধে নির্মাণের জন্য জনসচেতনতা তৈরী করছে, মানবন্ধন করছে, সরকারের নিকট ম্মারকলিপি জমা দিচ্ছে। আবার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বীচ ক্যাম্পেইন করছে, যাতে করে পর্যটকদের ব্যবহ্রত বর্জ্য সমুদ্রে তীরে না ফেলে, নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা হয়। যার ফলে, মেরিন প্লাষ্টিক দূষণ কমে আসবে, সমুদ্রের বাস্তসংস্থান রক্ষা পাবে। আবার স্থানীয় জনগোষ্ঠিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও ক্ষতিকারকদিক ও মোকাবেলা সম্পর্কে স্বাক্ষরতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে পারে। স্থানীয় এলাকায় বিপদপূর্ণ স্থানের মানচিত্র তৈরি এবং আপডেট রাখতে সাহায্য করতে পারে। যুবসমাজ সঠিকভাবে অংশগ্রহণ করলে দুর্যোগের ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব এবং একটি নিরাপদ ও সহনশীল সমাজ গঠন করা যাবে।

সাড়া প্রদান: জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দুর্যোগে সাড়া দেওয়া বলতে বুঝায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ঝুঁকি ও বিপদের সময়ে তাৎক্ষণিক ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যুবরো যেসব সাড়াপ্রদান কাজে নিজেদেরকে অর্ন্তভূক্ত করতে পারে যেমন, দুর্যোগকালীন সময়ে, মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া, খাদ্য, পানি এবং চিকিৎসাসেবা প্রদান, এবং পরবর্তী পুনরুদ্ধার কাজে সহায়তা অন্তর্ভুক্ত। এই সাড়া দেওয়ার মূল লক্ষ্য হলো ক্ষয়ক্ষতি কমানো এবং মানুষের জীবন রক্ষা করা। ইপসা’র ইয়ুথ কমিউনিটি স্বোচ্ছাসেবকরা, চট্টগ্রাম শহরের যেকোন দুর্যোগে অংশগ্রহণ করছে।

পুনরুদ্ধার: জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ইভেন্ট বা দুর্যোগে পুনরুদ্ধার বলতে বোঝানো হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর পরিবেশ, জীবনযাত্রা এবং অবকাঠামোর পুনরায় স্থিতিশীলতা অর্জনের প্রক্রিয়া। এটি একটি সামগ্রিক উদ্যোগ, যার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়কে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সহায়তা করা হয়। যুবরা যেসব প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে যেমন; দুযোর্গের ফলে ক্ষয়ক্ষতির মূল্যায়ন: দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ও জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন চিহ্নিত করা; সাহায্য বিতরণ: খাদ্য, পানি, ওষুধ, ও আশ্রয় প্রদান; অবকাঠামো পুনর্গঠন: রাস্তা, ঘরবাড়ি, স্কুল ও হাসপাতালের মেরামত;  মানসিক সহায়তা: দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার।; পরিবেশ পুনর্বাসন: গাছপালা লাগানো, দূষণ পরিষ্কার করা; উদ্ভাবনী সমাধান: টেকসই কৃষি, পানি সংরক্ষণ প্রযুক্তি, ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় কাজ করা। যুবদের উদ্যম ও উদ্ভাবনী চিন্তা দুর্যোগ-পরবর্তী পুনরুদ্ধারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

অভিযোজন: জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ইভেন্ট বা দুর্যোগে অভিযোজন বলতে বুঝায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগের ক্ষতি ও প্রভাব কমিয়ে আনার জন্য গৃহীত পদক্ষেপ ও কর্মকৌশল। এটি মূলত মানুষের জীবন, সম্পদ, পরিবেশ, এবং অর্থনীতিকে টেকসই রাখার ও পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে পরিকল্পিত প্রস্তুতি এবং প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম গ্রহণের প্রক্রিয়া। যুবরা দুর্যোগে অভিযোজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অভিযোজনে যুবরা যেসব কাজ বা উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে; সচেতনতা বৃদ্ধি: জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাব সম্পর্কে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করা; সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা চালানো। স্থানীয় সমস্যা চিহ্নিতকরণ: নিজের কমিউনিটির দুর্বলতা এবং ঝুঁকি চিহ্নিত করা; স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সবুজায়ন এবং পরিবেশ সুরক্ষা: বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পরিচালনা; টেকসই কৃষি পদ্ধতি প্রচলন; জলবায়ু সহনশীল কৃষিজাতের প্রসার; পানি সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ। উন্নত টেকসই প্রযুক্তির ব্যবহার: সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহারে চর্চা ও উদ্ধুদ্ধ করা; আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং সতর্কতা সিস্টেম সম্পর্কে ধারণা প্রদান; ডেটা সংগ্রহ এবং শেয়ার করার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করা। উদ্যোক্তা কার্যক্রম: স্থানীয়ভাবে অভিযোজনযোগ্য পণ্য ও পরিষেবা তৈরি করা; নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার উৎসাহিত করা। সার্কুলার ইকোনমি বা বৃত্তাকার অর্থনীতি: সার্কুলারিটি গ্যাপ রিপোর্ট-২০২১ এ দাবি করা হয় সার্কুলার ইকোনমি’র মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ৩৯ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা সম্ভব; প্লাস্টিক বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদান খরচ ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব; 3R (হ্রাস, পুনর্ব্যবহার ও পুনঃচক্রায়ন) 7R পর্যন্ত প্রসারিত করে যেমন; নতুন করে ডিজাইন (redesign); কমাতে (reduce); মেরামত (repair); পুনর্নবীকরণ (renewal); পুনরুদ্ধার (recover); পুনঃচক্রায়ন (recycle)। যুবরা তাদের উদ্যম, শক্তি, এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করার মাধ্যমে দুর্যোগে অভিযোজনে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।

টেকসই উন্নয়ন: উন্নয়নের ধারণাটি ১৯৮৭ সালে ব্রান্টল্যান্ড কমিশনের রিপোর্টে প্রথম স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা হয়। টেকসই উন্নয়ন বলতে এমন উন্নয়নকে বোঝায় যা বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা পূরণ করে, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজন মেটানোর ক্ষমতা ব্যাহত করে না। এটি একটি উন্নয়ন প্রক্রিয়া যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, এবং পরিবেশ সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। টেকসই যুবরা টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে কার্যক্রর ভূমিকা রাখতে পারে, যেমন কমিউনিটিতে যেসব উন্নয়ন কর্মকান্ড গ্রহণ করা হয়, সেগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, এবং পরিবেশ সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য আছে কিনা সে বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও অধিপরামর্শ করা।  গ্রামের মানুষ একসময় অন্ধকারে থেকেছে বা কেরোসিন ল্যাম্পের উপর নির্ভর করতো। এই সমস্যার সমাধানে নবায়নযোগ্য শক্তির ওপর ভিত্তি করে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (IDCOL) এবং বিভিন্ন অংশীদাররা মিলে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। যেকোন উন্নয়ন কার্যক্রমে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করে, তারপর উন্নয়ন কাজ শুরু করতে হবে, সেখানে যুবরা অংশ নিতে পারে। যুব সমাজের উদ্যোগ ও সক্রিয় অংশগ্রহণ টেকসইতা নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ: যুবসমাজ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। তারা স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জলবায়ু নীতিমালা এবং জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে তাদের মতামত জানাতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকট। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, তাপপ্রবাহ, খরা এবং ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশ্বব্যাপী মানুষকে প্রভাবিত করছে। এই প্রভাবগুলো মোকাবিলা করতে এবং একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে যুবসমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবিলায় যুবসমাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তাদের উদ্ভাবনী চিন্তা, শক্তি এবং নেতৃত্বের গুণাবলী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে এবং একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সহায়তা করতে পারে। সঠিক দিকনির্দেশনা ও সহায়তা পেলে যুবসমাজ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারবে। এজন্য সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা, উন্নয়ন সংস্থা এবং সমাজের প্রত্যেকের উচিত যুবদের সমর্থন ও সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা।

শনিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০২৫

নিরাপদ ফুটপাত চাই , হাঁটতে চাই, হাঁটা নগরবাসীর অধিকার

শরীরচর্চার সবচেয়ে সহজ উপায়টি হলো হাঁটাহাঁটি করা। আমরা সবাই কমবেশি হাঁটি। কারণে-অকারণে হাঁটি। কিছু মানুষ আছেন, যারা নিয়ম করে প্রতিদিনই হাঁটেন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাঁটার অনেক উপকারিতা আছে। এর ফলে পেশী সুগঠিত হয়, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুরক্ষিত থাকে ও মেরামত হয়, হজমে সাহায্য করে এবং মস্তিষ্ককেও সতেজ রেখে বার্ধক্য প্রতিরোধ করে। হাঁটার ফলে মানুষের চিন্তার সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়, মেজাজ বা মুড ভালো থাকে, মানসিক চাপ কমে। দ্রুত নগরায়ণ ও যান্ত্রিক নির্ভরতার কারণে হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস কমে গেছে বা নগরের হাঁটাহাঁটি করা সহায়ক পরিবেশ নেই। নগরের হাঁটাহাঁটি করার পরিবেশ ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে।

হাজার বছরের ইতিহাস আর ঐতিহ্য বুকে নিয়ে জেগে আছে চট্টগ্রাম। পাহাড়, নদী আর সাগরের সম্মিলনে এই নগরী বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য মানুষের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। নগরে বিপুলসংখ্যক মানুষের বাস। কিন্তু নগরবাসীর নিরাপদে হাঁটার ব্যবস্থা নগরীতে তেমন নেই, যা ছিল তাও ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে। গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরে সড়কের তুলনায় ৭গুণ বেশি যানবাহন চলাচল করে। যে কারণে শহরে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। দিনে দিনে বাড়ছে ট্রাফিক জ্যাম। নগরবাসী ট্রাফিক জ্যামের ভয়ে অল্প দূরত্বে গন্তব্য হলে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে শ্রমজীবী, পোশাককর্মী সব সময় হেঁটে তাঁদের কর্মস্থলে যান। চসিকের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরে সড়ক আছে ১ হাজার ৪৪২ কিলোমিটার। বিপরীতে ফুটপাত আছে মাত্র ২৮১ কিলোমিটার; যা মোট সড়কের মাত্র ১৯ শতাংশ। এর মধ্যে অধিকাংশ অবৈধ দখলে। কেউ রাজনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে ফুটপাতের ওপর দোকান তৈরি করে ভাড়া দিচ্ছেন। কেউ কেউ ভ্রাম্যমাণ জুতার দোকান, ডাবের দোকান, শরবতের দোকান, চুড়ির দোকান, বইয়ের দোকান দিয়ে ফুটপাত চলাচলের অনুপযোগী করে ফেলেছেন। এমন অবস্থায় জনগন রাস্তা দিয়ে চলাচলের সময় মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।

ব্লমবার্গ ফিলানথ্রপিস ইনিশিয়েটিভ ফর গ্লোবাল রোড সেফটি (বিআইজিআরএস) এর মতে, ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫৬৯ জন। এর মধ্যে পথচারীর সংখ্যা ৩১৩, অর্থাৎ ৫৫ শতাংশ। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে সড়কে পথচারী মৃত্যুর হার বেড়েছে ৬০ শতাংশ। চট্টগ্রামে এই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হবার অন্যতম কারণ হল শহরে পথচারীরা নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত ফুটপাত নেই; যা আছে তার মধ্যে কিছু অবৈধ দখলে, কিছু ভাঙাচোরা। তাছাড়া যেখানে দখলমুক্ত ফুটপাত আছে, সেখানেও অসমতল ও ধারাবাহিকতা নেই। বাধ্য হয়ে সড়ক দিয়ে যাতায়াত করেন পথচারীরা, যার ফলে সহজেই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। গবেষকরা বলছেন, চট্টগ্রাম নগরের ২০টি মোড় ও ১০টি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে সিটি গেট, আউটার রিংরোডের খেজুরতলা, বারিক বিল্ডিং মোড়, সিঅ্যান্ডবি ও কালামিয়া বাজার মোড় সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। ৩ বছরে এ মোড়গুলোতে ২৯ জন নিহত হয়েছেন। রুটগুলোর মধ্যে সব চেয়ে বিপজ্জনক বহদ্দারহাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত সড়ক। এই পাঁচ কিলোমিটার সড়কে ২৪ জন নিহত হয়েছেন। তাছাড়াও এই নগরে ভারী যানবাহন চাপায় পথচারী নিহত হবার ঘটনাও ঘটছে। বন্দর নগরী হবার কারণে, এই শহরে পণ্যবাহী ভারী যানবাহন চলাচল করে। অনেকক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রীত গাড়ি চলাচলের কারণে দুর্ঘটনায় পথচারীরা গাড়ির চাপা পড়ে মারা যান। ড্রেনে পড়ে পথচারী ও কলেজ ছাত্রীর মৃত্যুরমত ঘটনাও এই শহরে ঘটেছে। নগরের রাস্তায় হাঁটার মতো পরিবেশে যে ধরনের অবকাঠামো দরকার, তা এই শহরে অনুপস্থিত।  

যানজট যেন চট্টগ্রাম শহরের নিত্তমৈত্রিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে । অক্সিজেন মোড় থেকে পতেঙ্গা কাঠগড় বাজার এবং কর্নেলহাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত পুরো নগরীতেই সড়কে চলছে চরম বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য। নিউমার্কেট মোড়, জুবিলী রোড, রিয়াজউদ্দিন বাজার, জহুর হকার্স মার্কেট, তামাকমুণ্ডি লেন, শাহ আমানত সিটি করপোরেশন মার্কেট, গোলাম রসুল মার্কেট, চকবাজার, ষোলশহর, অক্সিজেনসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক এলাকার অবস্থা আরো ভয়াবহ। এসব এলাকায় ফুটপাত হকারদের দখলে থাকায় যানবাহন থেকে যাত্রী ও মালামাল ওঠানামা হয়ে থাকে সড়কে। আবার অনেক সড়কে যানবাহন রাখা হয় এলোপাতাড়িভাবে। এর পাশাপাশি শহর জুড়ে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলমান থাকায় সড়ক সংকীর্ণ হয়ে গেছে। নগরীতে পর্যাপ্তসংখ্যক বৈধ বাস ও ট্রাক টার্মিনালের অভাবে শহরের তিনটি প্রবেশমুখে গড়ে উঠেছে অবৈধ টার্মিনাল। সেসব স্থানে যত্রতত্র বাস, অটোরিকশা ও প্রাইভেট কার পার্কিং করে রাখা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর ও ইপিজেডমুখী সবগুলো সড়কেই রয়েছে অসহনীয় যানজট। নগরীতে পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা ছাড়াই একের পর এক গড়ে উঠছে নতুন নতুন মার্কেট ও হাসপাতাল। মার্কেটে আসা ক্রেতা-বিক্রেতারা রাস্তার ওপর গাড়ি রাখেন। মার্কেটের দোকানপাটের মালামাল রাস্তায় ওঠানামা করানো হচ্ছে। এছাড়া নিউমার্কেট এলাকার আশপাশে পুরো এলাকা জুড়েই ফুটপাত ও রাস্তার প্রায় অর্ধেক অংশ হকারদের দখলে। ফুটপাত বেদখল থাকায় মানুষ রাস্তা দিয়ে হাঁটে। এতে যানজট আরো তীব্র হচ্ছে। নগরীর বায়েজীদ থেকে ষোলশহর হয়ে চকবাজার পর্যন্ত সড়কটিতেও সব সময় যানজট থাকে। এসব এলাকায় বেশ কয়েকটি শিল্পকারখানার পাশাপাশি অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক এলাকা রয়েছে। যানজটের কারণে এসব এলাকার বাসিন্দাদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়।

এদিকে, নগরীতে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় চলমান কাজের বিভিন্ন সরঞ্জাম ও খাল থেকে তোলা মাটি রাস্তার উপরেই স্তূপ করে রাখার কারণে রাস্তা সরু হয়ে পড়ায় যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। তার মধ্যে একটি হলো বন্দর ব্যবহারকারী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান পার্কিংয়ের জন্য কোনো টার্মিনাল নেই। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পণ্যবাহী যানবাহনগুলো বাধ্য হয়ে সড়কের এক পাশে পার্কিং করে রাখতে হচ্ছে। চট্টগ্রামের আবাসিক এলাকাগুলোতে নেই কোন ফুটপাথ, অনেক বাসিন্দা/বাড়িওয়ালা তার বাড়ির সামনে ফুটপাথ দখল করে নিয়েছে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে বাগান করে বা গাছ লাগিয়ে। যার ফলে, আবাসিক এলাকাগুলোতেও পথচারীরর নিরাপদের হাঁটার ব্যবস্থা নেই, সেখানেও পথচারীরা প্রতি নিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।

নগরীতে পথচারীদের নিরাপদে হাঁটা ও চলাচলের উপযুক্ত স্থান ফুটপাত। প্রশস্ত ফুটপাতের কারণে যানজট বা দুর্ঘটনাও কমে অনেক। পাশাপাশি রাস্তা বা সড়কের সৌন্দর্যও বাড়ায় ফুটপাত। বাড়তি সুবিধা, নিয়মিত হাঁটার কারণে নগরবাসীর বিভিন্ন শারীরিক ও মানষিক উন্নতি। নগরের ফুটাপাতগুলো নিরাপদ ও চলাচল উপযোগীর জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে;

  • নগর পরিকল্পনায় পথচারীর স্বার্থ বিবেচনা করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে;
  • পথচারী নিরাপত্তা প্রবিধানমালা ২০২১ দ্রুত প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন;
  • পথচারীদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করে ফুটপাত নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ; 
  • সহজে ও নিরাপদে জেব্রা ক্রসিংয়ের মাধ্যমে রাস্তা পারাপারের সুযোগ সৃষ্টি;
  • রাতে পথচারীদের (বিশেষ করে নারী ও বয়স্কদের) চলাচল নিরাপদ করার লক্ষ্যে ফুটপাথ ও সড়কে আলোর ব্যবস্থা করা;
  • ফুটপাতে ছাউনি, বসার ব্যবস্থা, খাওয়ার পানি, মোবাইল চার্জ ব্যবস্থা ও গণশৌচাগার নিশ্চিতকরণ;
  • সাইন সিগন্যাল স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাহিদাকে গুরুত্ব প্রদান;
  • হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীর জন্য ফুটপাতে ঢালু পথ (র‍্যাম্প) তৈরি;
  • দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যবহার উপযোগী করে ফুটপাতে টেকটাইলস স্থাপন;
  • অবকাঠামো দিয়ে পথচারীর নিরবচ্ছিন্ন চলাচলে বাধা তৈরি না করা;
  • বিল্ডিং তৈরীর সরঞ্জমাদি বা কাঠামোগত উন্নয়নের সরঞ্জমাদি   ফুটপাতে না রাখা হয়, তার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ানো;
  • ফুটপাত ও সড়কে অবৈধ পার্কিং বন্ধ করা;
  • আবাসিক এলাকাগুলোতে ফুটপাথ নির্মাণ ও দখলমুক্ত করা;
  • ফুটপাতে হকারদের ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসা। সকালে উচ্ছেদের পর সন্ধ্যায় যেন আবার দখল না পড়ে সে জন্যও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। হকারদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে;
  • যেখানে পথচারী চলাচলের ঘনত্ব বেশি, সেখানে কেবল পথচারীদের জন্য সড়কব্যবস্থা চালু করা;
  • গণ-পরিবহনের সেবার মান উন্নয়ন করে, ব্যক্তিক গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে আনা;
  • নগরের বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানের সাথে কানেকটেড ফুটপাথগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া এব সেখানকার প্রতিবন্ধকতাসমূহ দুর করা;
  • হাঁটা আমার অধিকার, নগরবাসীকে এই বিষয় নিয়ে সামাজিক উদ্ধেগ গ্রহণে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাসমূহ কার্যক্রর ভূমিকা রাখা;
  • নিরাপদ ফুটপাথ এর জন্য যুবরা বিভিন্ন উদ্ধেগ গ্রহণে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয়ে কাজ করা;
  • অনিরাপদ ফুটপাথের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ পথচারীর উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান।

উৎসঃ
  1. https://www.prothomalo.com/bangladesh/capital/7jwmioh7qu
  2. https://www.tbsnews.net/bangla/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6/news-details-167698
  3. https://www.bhorerkagoj.com/accident/760075
  4. https://www.ittefaq.com.bd/118740/
  5. https://www.bhorerkagoj.com/tp-editorial/764128
  6. https://www.bhorerkagoj.com/tp-editorial/749948

শুক্রবার, ১১ অক্টোবর, ২০২৪

সফল নেতৃত্বের অন্যতম গুনাবলী আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা

আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ হল দুই বা ততোধিক মানুষের মধ্যে কথা, চিন্তা, ধারণা,অনুভূতি এবং আবেগের বিনিময়। সফল নেতৃত্বের অন্যতম অপরিহার্য গুনাবলী হলো আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা ।  দৃঢ় আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের একটি অন্যতম সূচক। আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা পেশাদার এবং ব্যক্তিগত জীবনের জন্য অত্যন্ত দরকারী। এটি আপনাকে চাকরির ইন্টারভিউ এগিয়ে রাখবে, আপনার কর্মজীবনে অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখেবে, সংস্থার বা সাংগঠনিক নেতৃত্বে অতুলনীয় করে রাখে। অন্যদিকে, আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতার অভাব সহকর্মীদের বা ব্যবস্থাপনার সাথে ভুল যোগাযোগ বা ভুল বোঝাবুঝির দিকে পরিচালিত করতে পারে, যা আরও উল্লেখযোগ্য দ্বন্দ্বে পরিণত হতে পারে।

সফল যোগাযোগকারীর আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ দক্ষতাসমূহঃ

  • কার্যপোযোগী সম্পর্ক স্থাপন;
  • বিষয় দক্ষতা;
  • কার্যকরি যোগযোগের পরিবেশ তৈরির দক্ষতা;
  • উন্মুক্ত প্রশ্ন করার দক্ষতা;
  • পরিবেশ পরিস্থিতি বোঝার দক্ষতা;
  • শোনা ও সাড়া দেয়ার দক্ষতা;
  • প্রতি উত্তর দক্ষতা;
  • সমঝোতার দক্ষতা;
  • বিচারমূলক শব্দ পরিহারের ও বিনয়ী;
  • পর্যবেক্ষণ করার দক্ষতা;
  • ভুল স্বীকার করা;
  • সারসংক্ষেপ করার দক্ষতা

আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতার উদাহরণসমূহঃ
সম্প্রতী, আমরা দেখেছি,মাননীয় প্রধান উপদেষ্ঠা ড. মুহাম্মদ ইউসনূস স্যার রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে মতবিনিময় সভায় আলাদা কোন প্রটোকল না নিয়ে ছাত্র ও অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের সাথে সমান অবস্থানে বসে মতবিনিময় সভায় অংশ নেন ও সফল একটি সভা সম্পন্ন করেন। নিরাপত্তা বা প্রটোকলের কারণে হয়ত, সবসময় উনি এই চর্চা করতে পারবেন না, তবে, যেটি দেখিয়েছেন সেটি আমাদের জন্য অনুকরনীয় । 

মাননীয় প্রধান উপদেষ্ঠা ড. মুহাম্মদ ইউসনূস স্যারে এই মতবিনিময় সভা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি এই মতবিনিময় সভা যেভাবে ছাত্রদের সাথে যেভাবে যোগাযোগ করলেন, তা কার্যক্রর সফল যোগাযোগের অন্যতম উদাহরণ যেমন; সম্পর্ক স্থাপন; মাননীয় উপদেষ্টা প্রথমেই ছাত্র ও অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের সাথে সালাম/শুভেচ্ছ বিনিময় ও কুশল জিজ্ঞাসা করলেন; কার্যক্রর যোগাযোগের পরিবেশ স্থাপন করলেন, যেমন সম-অবস্থানে বসলেন (উল্লেখ্য মাননীয় উপদেষ্টার জন্য আলাদা চেয়ারের থাকলেও উনি এটাতে না বসে, সবাই যে ধরনের চেয়ারে বসেছে, সে ধরনে চেয়ারের ব্যবস্থা করতে বললেন এবং সবার সাথে মিলিয়ে সেই ধরনের চেয়ারে বসলেন), চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বললেন, কথার গুরুত্ব বুঝে যথার্থভাবে স্পর্শ করে কথা বললেন। ধৈর্য ও মনোযোগের সাথে সবার কথা শুনলেন এবং সাড়া দিলেন। বিচামুলক শব্দ পরিহার করে, সারসংক্ষেপের মাধ্যমে সভা শেষ করলেন। 

ঠিক একই ধরনের আরেকটি আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ দক্ষতা দেখাগেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নব নিযুক্ত উপাচার্য প্রফেসর ড. নিয়াজ আহমেদ খান স্যারের মাঝে, ছুটির দিনে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল পরিদর্শন করেছেন। প্রাধ্যক্ষবিহীন (তৎকালীন) এই হলগুলোতে যাওয়ার পর প্রাধ্যক্ষের চেয়ারে তাকে বসতে দেওয়া হলেও তাতে না বসে হাউস টিউটরদের সঙ্গে মিলিয়ে বসেছেন। এই বিনয়ী আচরণের কারণে মুগ্ধ হয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তিনি বলেন বলেন, ‘যার চেয়ার সেখানে তিনিই বসবেন’। এটাই পরিবর্তন। এটাই মুগ্ধতা। এটিও একটি আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ দক্ষতা সম-অবস্থানে বসা ও অন্য সহকর্মীর মর্যাদাকে স্বিকার করা। 

বিনয় একটি মানবীয় গুণ। আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের অন্যতম দক্ষতা।  আমরা যখন কাহারও সাথে কথা বলবো বা আচরণ প্রকাশ করবো, তার সেই কথা ও আচরণে কোনো প্রকার ঔদ্ধত্য থাকবে না। মনে রাখতে হবে, ভুল স্বীকার করলে কখনো মানুষের সম্মান হ্রাস পায় না বরং তা বৃদ্ধি পায়। যে মানুষকে সম্মান করে অন্য ব্যক্তিরাও তার আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে সম্মান করতে চায়। তাই অন্যকে গুরুত্ব দেয়া বিনয়ী অর্জনের ভালো একটি উপায়। যে ব্যক্তি ভদ্র ও বিনয়ী তার মর্যাদা আল্লাহর কাছে ও অনেক।

শুক্রবার, ৩ মে, ২০২৪

থার্মোকল বা ককসিট বর্জ্যের দূষণচক্রে নগরীর পরিবেশ

আয়তেন বাংলাদেশ বিশ্বে ৯৪তম হলেও জনসংখায় অষ্টম, বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায়ই ১৭ কোটি। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৫ ভাগ লোক শহরে বাস করে। শহরে বাস করার তথা নগরায়ণের প্রবণতা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে যে ২০২৫ সালের মধ্যে এ দেশে নগরায়ণের মাত্রা ৫০ শতাংশে পৌঁছবে । ২০৫০ সালের মধ্যে শহরে বসবাসরত জনগণের সংখ্যা ৫৬ শতাংশে উন্নীত হবে (ইউএন, ২০১৪)। মানুষ নগরমুখী। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং সুচিন্তিত পদক্ষেপহীনতার কারণে নগরবাসী যথাযথ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত, এবং নগর সেবাদান কেন্দ্রগুলা অতিরিক্ত মানুষের চাপে সেবার মান নিম্নমুখী। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শহরে বর্জ্য তৈরির হার বেড়েই চলছে। ধারনা করা হয় বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে ২৫০০০ টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। রাজধানী ঢাকায় সমস্ত দেশের এক-চতুর্থাংশ বর্জ্য উৎপাদন হয়। বন্দর নগরী চট্টগ্রামের অবস্থান দ্বিতীয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মতে, প্রতিদিন এই শহরে ২২০-২৫০ টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নগরের একটি বড় সমস্যা। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে অশোধিত অবস্থায় পরিবেশে যুক্ত হচ্ছে বর্জ্য, যার ফলে নগরের পরিবেশ ও নগরবাসীর স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ছে। বর্জ্য আবাসিক, বাণিজ্যিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং শিল্প উৎস থেকে আসছে। সময়ের সঙ্গে শহরে বর্জ্যের ধরন বদলে যাচ্ছে। 

চট্টগ্রাম নগরীতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আরেক হুমকি হল থার্মোকল, স্টাইরোফোম বা ককসিট বর্জ্য। এই দুটি পলিস্টাইরিন পণ্য প্লাস্টিকের মতই যা, পেট্রোলিয়াম থেকে উৎপন্ন। থার্মোকল হালকা ওজনের, যা দামী ও ভঙ্গুর জাতীয় পণ্য/দ্রব্য প্যাকেজিং এবং দৈনন্দিন ব্যবহারযোগ্য পণ্য সংরক্ষণে ও পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। ককসিট তাপ নিরোধক (ইনসুলেটিং বৈশিষ্ট্যের জন্য) বলে, বিভিন্ন কাচাঁমাল- মাছ, শাক-সবজি, ফল-মুল ইত্যাদি পণ্য সংরক্ষণে ও পরিবহনে  বহুল ব্যবহৃত হয়। থার্মোকলের বহুমুখী ব্যবহারিতা রয়েছে, বর্তমানে বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানের সাজ সজ্জায় এটি বহুল ব্যবহ্রত হচ্ছে। তাছাড়া মৌসুম পরিবর্তনের সাথে সাথে ও এই থার্মোকলের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়ে থাকে, যেমন গ্রীষ্মকালে  থার্মোকলের ব্যবহার শীতকালের ছেয়ে তুলনামূলক বেশি হয়ে থাকে। কারণ, থার্মোকলের ইনসুলেটিং বৈশিষ্ট্যের জন্য গ্রীষ্মকালের আনেক ফলমূল, মাছ, শাক-সবজি সংরক্ষণ ও পরিবহনের উদ্দেশ্যে এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। তাছাড়াও বিভিন্ন দামী ও ফেন্সি উপকরণ যেমন, টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, এসি, কাচেঁর তৈরি বিভিন্ন পণ্য  প্যাকেজিং ও পরিবহনে থার্মোকল বা ককসিট এর ব্যবহার হয়। থার্মোকল একটি অপঁচনশীল বর্জ্য, এটি সহজে মাটিতে মিশে না। এটি নিস্পত্তি হতে বা পঁচে যেত প্লাস্টিক বর্জ্যের ন্যায় শত শত বছর সময় লাগে, যা মাটি ও পানির জৈব গুণ নষ্ট করছে। অতি ক্ষুদ্র ককসিট কণাকে মাছ ও পাখি খাবার মনে করে খেয়ে ফেলছে, এভাবে তা মানুষের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ছে ককসিট। এসব ককসিট খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে তা ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রোগবালাই তৈরি করছে।  

গবেষণায় জানা যায়, থার্মোকল বর্জ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য। যেহেতু, চট্টগ্রামে এখনো ককসিট বর্জ্যের পুনর্ব্যবহারের ভেল্যু চেইনটি গড়ে ওঠেনি। যার ফলে, এই বর্জ্যটি যেখানে সেখানে পড়ে থাকতে দেখা যায়। যার শেষ পরিণতি হয় ড্রেন, খাল, নালা বা জলাধার। যেহেতু এটি হালকা, তাই সেটি পানির উপর ভেসে থাকে ও নগরের ড্রেনেজ সিষ্টেমে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। যার ফলে সামান্য বৃষ্টিতে দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা ও বিভিন্ন ভেক্টর বাহিত রোগ। গ্রীষ্মকাল আসন্ন, কিছুদিনের মধ্যে শুরু হবে মৌসুমের বৃষ্টিপাত। তাই, শহরকে জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা করতে ও ভেক্টর বাহিত রোগের ঝুঁতি থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করতে এখনি নিতে হবে কার্যক্রর পদক্ষেপ। ধারনা করা হয়, ককসিটে জমা পনিতে এডিস মশা ডিম পাড়তে পারে যা, শহরের ডেঙ্গু  সংক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।  ২০২৩ সালে, বাংলাদেশে ডেঙ্গু  সংক্রমণ অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছিল। গত ২৩ বছরে দেশে ডেঙ্গুতে মোট মারা গেছেন ৮৬৮ জন। কিন্তু ২০২৩ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন প্রায় ১৮০০ জন। ঢাকার পর ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি হচ্ছে বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে। তাই, নগরের পরিবেশ সংরক্ষণ ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি এই থার্মোকল বা ককসিট বর্জ্যকে সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ককসিট বর্জ্যকে ল্যান্ডফিলে নিস্পত্তি না করে রিসিাইকেল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এনে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করতে হবে।

থার্মোকল বা ককসিট বর্জ্যকে সঠিক ব্যবস্থাপনায় আনতে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো বিবেচনায় আনা যেতে পারে;

  • ককসিট বর্জ্যকে উৎসে পৃথকিকরণ করতে হবে;
  • ককসিট বর্জ্য উৎসে পৃথকিকরণ ও সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য নগরবাসিকে সংবেদনশীল করতে হবে;
  • কঠিন বর্জ্য সংগ্রহকারী বা সেবকদের ককসিট বর্জ্য সংগ্রহের ব্যাপরে আগ্রহ ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে;
  • নগরের নির্দিষ্ট ভাংগারীওয়ালাদেরকে চিহ্নিত করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই ককসিট বর্জ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কৌশল সম্পর্কে অবগত করতে হবে;
  • প্রয়োজনে প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে বেশি কিছু ভাংগারীওয়ালা তৈরী করতে হবে, যারা ককসিট বর্জ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের আগ্রহী;
  • চট্টগ্রামের রিসাইক্লিং ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে, অবগত করা যে, ককসিট বর্জ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং এই পুনর্ব্যবহারের কৌশল ও কারিগরি সহায়তা প্রদান;
  • ককসিট বর্জ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে কথা বলা  ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০২১ অনুযায়ি উৎপাদনকারির সম্প্রসারিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি;
  • কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ ককসিট বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় পর্যায়ে জনগণকে অংশগ্রহণ করা ও এর সঠিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা;
  • সরকার, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানসমূহ ককসিট বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একসাথে কাজ করা।
ককসিট বর্জ্য বিষয়ে গবেষণার অভাবে সঠিকভাবে বলা খুব কষ্টকর যে, কি পরিমাণ ককসিট বর্জ্য প্রতিদিন এই শহরে উৎপন্ন হচ্ছে, তবে বর্জ্য সংগ্রহকারী ও ভাংগারীওয়ালাদের সাথে কথা বলে  ধারনা করা যায়, চট্টগ্রাম শহরে উৎপাদিত কঠিন বর্জ্যের প্রায়ই ৪-৫ শতাংশ হবে থার্মোকল বা ককসিট বর্জ্য। পরিমাণে এই অংশ কম হলেও আশংকা বা ঝুঁকি কিন্ত অনেক। বর্ষা মৌসুমে নগরের রাস্তা ও ড্রেন দুটোই পানিতে তলিয়ে যায়, ভেসে থাকে এই ককসিটগুলো আর তাই পথচারীরা বুঝতে পারে না কোথায় রাস্তা এবং কোথায় ড্রেন। যার ফলে ঘটছে, ড্রেনে পড়ে মুত্যুর সংখ্যা। পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০১৭ সাল থেকে গত ৭ বছরে নগরীর অরক্ষিত ড্রেন ও খালে পড়ে কমপক্ষে ৮ জন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হয়েছে। তাই, বর্ষা মৌসুমের আগে নগরির খোলা অরক্ষিত ড্রেনগুলা দ্রুত চিহ্নিত করে সংস্কার করতে হবে এবং জলাবদ্ধতার জন্য অন্যতম দায়ী থার্মোকল বা ককসিট বর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।

Photo Source: https://dainikishan.com


রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০২৪

স্বাস্থ্য সেবা, আমার অধিকারঃ পলিসি, চর্চা ও করনীয়

অধিকার একটি বৈধ দাবী, যা দেশের শাসনসতন্ত্র, নীতিমালা, আর্ন্তজাতিক চুক্তি ও সংবিধান দ্বারা সংরক্ষিত। স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক মানবাধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম। স্বাস্থ্য সর্বজনীনভাবে মানব উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসাবে ও স্বীকৃত। 

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব এবং অনুচ্ছেদ ১৮ (১) অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যের উন্নতি করা, রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্তব্য বলা হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলমা-আতা ঘোষণা, জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ২৫ (১), শিশু অধিকার সনদ, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণের কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী দেশ।  এই সমস্ত আন্তর্জাতিক সনদে স্বাস্থ্যকে একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বর্তমান সরকার নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০০০ মূল্যায়ন করেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পরিমার্জন ও সম্প্রসারণ করে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১ চূড়ান্ত করেছে।  স্বাস্থ্য যখন মানুষেরর মৌলিক মানবাধিকার, তখন রাষ্ট্রকে অবশ্যই চারটি মূল উপাদান বিবেচনা করে স্বাস্থ্য নীতি ও সেবা নিশ্চিত করতে হয় যেমন;

পর্যাপ্ততাঃ স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলির প্রাপ্যতার জন্য  একটি দেশ তার অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে তার জনগোষ্ঠির জন্য প্রয়োজনীয়  স্বাস্থ্যসেবার সুবিধাগুলি নিশ্চিত করবে। 

প্রবেশগম্যতাঃ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সবার কাছে সহজলভ্য ও প্রবেশগম্য করা। স্বাস্থ্য সেবায় প্রবেশগম্যতার ক্ষেত্রে চারটি বিষয় বিবেচনা করতে হয় যেমন; বৈষম্যহীনতা, শারীরিক প্রবেশগম্যতা, অর্থনৈতিক প্রবেশগম্যতা (সাধ্যের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা), স্বাস্থ্য তথ্যের  প্রবেশগম্যতা। 

গ্রহণযোগ্যতাঃ স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলি নৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে উপযুক্ত হতে হয়। 

গুণগতমানঃ স্বাস্থ্য পরিষেবা অবশ্যই বৈজ্ঞানিক এবং চিকিৎসাগতভাবে অনুমোদিত হতে হয়। গুণগতমান হল ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজের একটি মূল উপাদান । মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলোকে মানতে হয় যেমন; নিরাপদ, কার্যকরী, জন-কেন্দ্রিক, সময়মত, ন্যায়সঙ্গত, ইন্টিগ্রেটেড , দক্ষ।

উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করে, বাংলাদেশের জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি নির্ণয় করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১ এর লক্ষ্য হলোঃ  সকলের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং জরুরি স্বাস্থ্য সেবার প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা; সাম্যতার ভিত্তিতে সকলের জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য-সেবা নিশ্চিত করা ও সেবার পরিধি প্রসারিত করা;  অধিকার এবং মর্যাদা বিবেচনা করে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা বাড়ান। জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি-২০১১ এর প্রাধান্য বিষয়গুলো হলো; সমাজের সকল স্তরে স্বাস্থ্যসেবাকে একটি অধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা, জনস্বাস্থ্যের ও পুষ্টির উন্নতির উপাদানগুলি নিশ্চিত করা, শহর ও গ্রাম  নির্বিশেষে সবার জন্য মানসম্পন্ন এবং সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, প্রতি ৬০০০ জনসংখ্যার জন্য একটি করে কমিউনিটি  ক্লিনিক স্থাপন করা, জরুরী স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি করা; মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা; মা ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিশ্চিত করা এবং প্রতিটি গ্রামে নিরাপদ প্রসবের পরিষেবা নিশ্চিত করা; পরিবার পরিকল্পনা পরিষেবাগুলির সহজলভ্যতা এবং প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা, বিশেষ করে দরিদ্র এবং নিম্ন আয়ের মানুষদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া; স্বাস্থ্য সেবায় লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করা; স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় তথ্য প্রযুক্তির কার্যকর ও দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা; মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য সরকারি স্বাস্থ্যসেবার সুবিধাগুলিতে পর্যাপ্ত রসদ ও জনবলের সরবরাহ নিশ্চিত করা; বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি এবং চিকিৎসা খরচ নিয়ন্ত্রণ; দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা শিক্ষা ও প্রযুক্তির আধুনিকায়ন ও অভিযোজন নিশ্চিত করা; সরকার এবং এনজিওগুলির মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করা; প্রতিরোধমূলক পরিষেবাগুলিকে শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে টিকাদান কর্মসূচি উন্নতি করা; স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত তথ্যের অবাধ প্রবেশগম্যতা; ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করে প্রয়োজনীয় ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা; স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলির ট্র্যাকিং করা; এবং সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যসেবা (ইউনানি, আয়ুর্বেদ এবং হোমিওপ্যাথিক) শিক্ষা এবং ব্যবস্থার উন্নতি নিশ্চিত করা।

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে, ৯০টি আইন স্বাস্থ্য বা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। এই আইনগুলোকে রিভিউ করলে দেখা যায় সমস্ত বিষয়াদি সাতটি বিস্তৃত বিষয়ের অধীনে পড়ে যেমন; গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধন এবং কল্যাণ আইন, জনস্বাস্থ্য, সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য অনুশীলন, পরিবেশগত স্বাস্থ্য, এবং শিশু ও মহিলাদের সুরক্ষা।

তাছাড়াও বৈশ্বিক উন্নয় লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) বিভিন্ন লক্ষ্য ও সূচকে স্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্যের কথা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে, যেমন লক্ষ্য-০৩ (সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ) সরাসরি স্বাস্থ্যসেবা ও অধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এসডিজি লক্ষ্য-০৩ এর টার্গেট ৩.১ ও ৩.২ বলা হয়েছে,  ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে মাতৃমৃত্যুর হারের অনুপাত প্রতি লাখে ৭০ এর নিচে নামিয়ে আনা ও জীবিত ৫ বছরের শিশুর মৃত্যুর  হারের অনুপাত প্রতি লাখে ২৫ এর নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। অন্যান্য এসডিজি লক্ষ্য ও সূচকেও স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্যকর জীবন নিশ্চিত করার ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়েছে যেমন; দারিদ্র্য বিলোপ (এসডিজি ১); ক্ষুধা মুক্তি (এসডিজি ২), নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন (এসডিজি ৬)  নারী এবং মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা দূর কর(এসডিজি  ৫.২.১) ও অসমতার হ্রাস (এসডিজি ১০)।

WHO কাউন্সিল অন দ্য ইকোনমিক্স অফ হেলথ ফর অল মতে, বিশ্বে অন্তত ১৪০ টি দেশ তাদের সংবিধানে স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবুও সে দেশগুলি তাদের জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিত করতে পারেনি এবং নিশ্চিত করার জন্য সহায়ক আইনগুলি অনুশীলন করছে না।  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০২১ সালে বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি জনগোষ্ঠি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলির কভার করা হয়নি, যদি সে সমস্ত দেশে স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে এবার ২০২৪ সালের ০৭ এপ্রিল উদযাপিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব স্থাস্থ্য দিবস, এই বছর দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো আমার স্বাস্থ্য, আমার অধিকার'। বাংলাদেশ এবছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘স্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিতে কাজ করি একসাথে’। এই বছরের থিমটি প্রত্যেকের অধিকার, সর্বত্র মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা এবং তথ্য, সেইসাথে নিরাপদ পানীয় জল, বিশুদ্ধ বায়ু, পুষ্টি, মানসম্পন্ন আবাসন, শালীন কাজ এবং পরিবেশগত অবস্থা এবং স্বাধীনতা পাওয়ার অধিকারকে বেছে নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা  সরকার বা পাবলিক সেক্টরের উপর অনেক বেশি নির্ভর করে, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি অনেক উদ্যেক্তা এই খাতে এগিয়ে এসেছে ও ভালো করছে। বিগত এক দশকে এই খাতের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, তবে করোনাকালীন সময়ে দেখা গেছে এই খাতের ব্যাপক উন্নয়নের চাহিদা ও বাস্তবতা। নিম্নের আলোচনায়, এই খাতের চলমান অবস্থা ও প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করা হলো, আলোচিত বিষয়গুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিক সমাধান হতে পারে, স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন ও অধিকারের বাস্তবায়ন।

সীমিত পাবলিক ফ্যাসিলিটি
স্বাস্থ্য সেবাখাতে বাংলাদেশে পাবলিক ফ্যাসিলিপির উন্নয়নের বেশ সুযোগ রয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অধীনে সারা দেশে মোট ১৮,০০০ কমিউনিটি ক্লিনিক আছে, যেখানে প্রতি ৬০০০ জনের একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক থাকার কথা রয়েছে (জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি-২০১১ )। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য সারাদেশে উপজেলা পযায়ে ৪৭২টি সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা কেন্দ্র বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে,যেখানে বাংলাদেশে মোট উপজেলার সংখ্যা  ৪৯৫ টি। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পরিচর্যা কেন্দ্রগুলোতে  মোট শয্যার সংখ্যা প্রায় ১৮,৮৮০ টি।সারা বাংলাদেশে ১২৬ টি সেকেন্ডারি এবং টারশিয়ারি কেয়ার সুবিধা রয়েছে। সেকেন্ডারি এবং টারশিয়ারি পাবলিক কেয়ার সুবিধাগুলিতে মোট শয্যা রয়েছে ২৭,০৫৩টি। বেসরকারি খাতে ২৯৮৩ টি নিবন্ধিত হাসপাতাল রয়েছে। এই হাসপাতালে মোট ৪৫,৪৮৫টি শয্যা রয়েছে। এই সীমিত ফ্যাসিলিটি মনে করিয়ে দেয় করোনা’র প্রারম্ভীক সময়ের ভয়াবহতা, যেমন রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত শয্যার অভাব, আইসিইউ অভাব ইত্যাদি।

সারাংশে, দেখা যায়, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতোলে প্রতি ১০০০ জনসংখ্যার জন্য ০.৩২ শয্যা বরাদ্দ রয়েছে; যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশে বলা হয়েছে, সরকারী হাসপাতালে প্রতি ১০০০ জনসংখ্যার জন্য ৩.৫ শয্যার ব্যবস্থা রাখা।

ভারসাম্যহীন স্বাস্থ্য সেবা ও অধিক চিকিৎসা খরছ
সরকারি হাসপাতালে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি অন্যান্য সুবিধাগুলি বিনামূল্যে হওয়ার কথা থাকলেও, রোগীদের ওষুধ এবং ল্যাবরেটরি পরীক্ষার খরচ নিজে বহন করতে হয়, সেইসাথে কিছু অতিরিক্ত অপ্রদর্শিত খরচও বহন করতে হয়। এই খরচগুলি গরীব এবং সুবিধাবঞ্চিতদের গুনগত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে গুরুতরভাবে বাধা সৃষ্টি করছে। অনেক ক্ষেত্রে গুরুতর রোগীরা অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রাপ্ত থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। গবেষণায় দেখা যায়, স্বাস্থ্যসেবার খরচের প্রায় ৬৬% ব্যক্তি এবং পরিবারের দ্বারা বহন করা হয়, যা আউট অব পকেট এক্সপেন্স ,যেটি রোগীকে দারিদ্রতার দুষ্ট চক্রে ফেলে দিচ্ছে। 

সংক্ষেপে বলা যায়, স্বাস্থ্য সেবায় জনস্বাস্থ্য নীতি অনুশীলনের মধ্যে একটি গ্যাপ রয়েছে যা গরীব এবং সুবিধাবঞ্চিতদের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি করছে, যার ফেলে, দেশর জনগণ সাংবিধানিক অধিকার ও ন্যায্যতার আদায় হতে বঞ্চিত হচ্ছেন । 

স্বাস্থ্যসবা কেন্দ্রগুলিতে প্রয়োজনীয় উপকরনের অভাব
বেশিরভাগ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, বিশেষ করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং জেলা হাসপাতালে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য উপকরণ সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সগুলির রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বা জ্বালানির অর্থের কারণে প্রায়শই  অকার্যকর হয়ে থাকা। এক্স-রে মেশিন, ইনকিউবেটর ও বিভিন্ন ল্যাবের যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকার্যকর হয়ে থাকা। বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং পরিবার পরিকল্পনার পণ্যগুলি চুরি করে বেসরকারী খাতের বিক্রি হওয়া। স্থানীয় পর্যায়ে চিকিৎসা সেবায় দক্ষ জনবলের ঘাটতি রয়েছে। যার ফলে, রোগির প্রয়োজনের সময় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা অনেকক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়াও স্থানীয় সেবা প্রদানকারীরা গুণগত সেবা প্রদানে ব্যার্থ হওয়ায়, লোকজন সামান্য চিকিৎসার প্রয়োজেনে জেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রেরমুখী হতে হয়। যার ফলে, চিকিৎসা খরছ বেড়ে যায় ও জেলা পর্যায়ের সেবা কেন্দ্রগুলোতে রোগীর ভীড় দেখা যায়। এর ফলে জেলা পর্যায়ের প্রয়োজনীয় রোগীরা চিকিৎসা সেবা পেতে বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে।

সারাংশে বলা যায়, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য উপকরণগুলো ব্যবহারের কার্যকারীতা বাড়াতে হবে, প্রয়োজনীয় বরাদ্দ ও তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। এই ক্ষেত্রে ইউনিয়ন ও উপজেলা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সেবার মান বাড়াতে হবে ও লোকজনকে ছোটখাট স্বাস্থ্য সেবার জন্য শহরমুখির প্রবণতা থামাতে হবে।


জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের অপ্রতুলতা
প্রয়োজনীয় আর্থিক সম্পদের অভাব বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। বর্তমান স্বাস্থ্যসেবা বাজেট বরাদ্দ ২০২৩-২০২৪ সালে ৩৮০৫২ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের  ২.৬৩%। ২০১৬ সালে শ্রীলঙ্কায় স্বাস্থ্যসেবা বাজেটের বরাদ্দ ছিল জিডিপির ৩.৮৯%। এমনকি দ্বীপপুঞ্জের দেশ মালদ্বীপও বাংলাদেশের তুলনায় ১০ গুণ বেশি বরাদ্দ করে। ২০২০ সালে, বাংলাদেশে মাথাপিছু মোট স্বাস্থ্য ব্যয় মাত্র ৫১ মার্কিন ডলার। এটি চ্যাথাম হাউসের প্রস্তাবিত US$86 এর অর্ধেকেরও কম।

সারাংশে বলা যায়, স্বল্প বরাদ্দ দিয়ে ১৬ কোটি জনগোষ্ঠিকে গুনগত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান খুব কঠিন, এই খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।

পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীর ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের অভাব
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত দক্ষ মানব সম্পদের অভাব একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। বর্তমান স্বাস্থ্যকর্মীরা শুধু  চিকিত্সকদের দিকে ঝুঁকছে অন্যান্য পেশায় আসতে চাচ্ছেন না। বর্তমানে ডাক্তার, নার্স এবং টেকনোলজিস্ট এর অনুপাত হল ১:০.৪:০.২৪ যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশে বলা হয়েছে, ডাক্তার-নার্স-টেকনোলজিস্ট অনুপাত হবে ১:৩:৫। উল্লেখ্য বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি ১৮৪৭ জনের জন্য মাত্র একজন চিকিৎসক রয়েছেন।  তাছাড়াও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে গবেষণার ঘাটতি ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অভাব রয়েছে।

সারাংশে বলা যায়,  স্বাস্থ্য সেবায় পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল নিয়োগ করতে হবে, এবং শুধুমাত্র ডাক্তার পেশায় মনোনিবেশ বা ঝুঁকলে হবে না, ডাক্তারের পাশাপাশি দক্ষ নার্স ও টেকনোলজিস্ট তৈরী করতে হবে। তবেই জনগণের সাংবিধানিক অধিকার আদায় হবে। এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বেশি করে গবেষণা করতে হবে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও প্রমোশনে মনোযোগী হতে হবে।

উচ্চ ঔষধ খরচ
বাংলাদেশের মানুষের উচ্চ মূল্যে ওষুধ ক্রয় করতে গিয়ে  দারিদ্রতার দুষ্ট চক্রের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে আউট অব পকেট এক্সপেন্স প্রায় ৬৩ শতাংশ। ওষুধের এই উচ্চ ক্রয়মূল্য নিয়মিতভাবে বেড়ে যাচ্ছে। সারাংশে বলা যায়, প্রয়োজনীয় ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

প্রবীণ লোকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের জন্য বিশেষ কোন নীতিমালা নেই ও বরাদ্দের স্বল্পতা
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাচ্ছে, পাশাপাশি প্রবীণ জনগোষ্ঠির সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবীণ জনগোষ্ঠির স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য ও বিষয়টিকে বিবেচনায় নেবার জন্য  তেমন কোন নীতিমালা  নেই ও প্রয়োজনীয় বরাদ্দের স্বল্পতা রয়েছে।

চিকিৎসায় সুসংহত রেফারেল ব্যবস্থার অনুপস্থিতি
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য কোনো বাংলাদেশে তেমন কোনো রেফারেল নেটওয়ার্ক এর বিধান নেই। সরকার ও বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি ও পরিলক্ষিত। সারাংশে বলা যায়, স্বাস্থ্যসেবার মত সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের জন্য রেফারেল ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সরকারী, বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান  ও এনজিওদের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করতে হবে।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে ক্রমবর্ধমান এবং অব্যাহত বৈষম্য
দরিদ্র এবং সুবিধাবঞ্চিতগোষ্ঠী এখনও ধনী মানুষের তুলনায় স্বাস্থ্যসেবায় কম অ্যাক্সেস রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, ধনী আয়ের গর্ভবতী মহিলারা প্রসবপূর্ব, প্রসব এবং প্রসবোত্তর সেবার জন্য ৫৩% স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা ক্লিনিকে আসেন ও বাচ্চা প্রসব করেন, অপরদিকে মাত্র 8% দরিদ্র গর্ভবতী মহিলা প্রসবপূর্ব, প্রসব এবং প্রসবোত্তর সেবার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা ক্লিনিকে আসেন। এইক্ষেত্রে প্রসবপূর্ব এবং প্রসবোত্তর যত্নের ক্ষেত্রে গুরুতর বৈষম্যরে অভিযোগ রয়েছে।

সারাংশে বলা যায়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে এই বৈষম্য কমিয়ে আনতে হলে দরিদ্র এবং সুবিধাবঞ্চিতগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা ক্লিনিকে অবাধ প্রবেশগম্যতার ক্ষেত্র তৈরী করতে হবে।

রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অঙ্গীকারের অভাব
একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অস্থিরতা প্রায়ই সহিংসতায় পরিণত হয়। এই ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা স্বাস্থ্যসেবায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। হরতালের সময় (সরকারি ও বেসরকারী পরিবহন এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রায়ই বন্ধ থাকে) ডাক্তার এবং নার্স (পাশাপাশি অন্যরা) নিরাপত্তার অভাবে কাজে যেতে ভয় পান। রোগীরাও একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হন। এই ধরনের জাতীয় রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় খুব কম সংখ্যক ব্যক্তি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবা পেতে পারেন। সারাংশে বলা যায়, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে রাজনৈতিক কার্যক্রমের উর্ধ্বে রাখতে হবে, যাতে কোন অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা বিঘ্নিত না হয়।

দুর্বল স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা
একটি দক্ষ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার অন্যতম শর্ত হলে আপ-টু-ডেট স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত তথ্য ব্যবস্থ।  WHO স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিল্ডিং ব্লক সিস্টেম এর উপর জোর দিয়েছে । শুধুমাত্র মাঠ পর্যায়ের ডাটা  যথেষ্ট নয়; সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুবিধার্থে এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সেন্ট্রালী অর্গানাইজ স্বাস্থ্য ডাটা জন্য খুবই জরুরী। বছরের পর বছর ধরে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে ছোট পরিসরে জরিপ, নজরদারি এবং গবেষণা পরিচালিত হয়েছে; তবে এখনও কেন্দ্রিয়ভাবে ডাটা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাই সারাংশে বলা যায়, জনস্বাস্থ্যের প্রবণতা নির্ণয়, আগাম ধারনা লাভ ও কার্যক্রর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা দাড় করাতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি নির্ণয়
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে নানারকম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের মানুষ, যা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন চিন্তার খোরাক। শ্বাসকষ্ট, হীটস্ট্রোক বা গরমজনিত মৃত্যু কিংবা তীব্র ঠান্ডাজনিত মৃত্যু ইত্যাদি এখন খুব সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বখ্যাত স্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য-প্রভাব নিয়ে করা তাদের গবেষণা রিপোর্টে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে যেসব রোগের প্রকোপ দেখা দিতে পারে, সে সম্বন্ধে উল্লেখ করেছে: সংক্রমণ ও কীটপতঙ্গবাহিত রোগের ধরনে পরিবর্তন আসবে; তাপপ্রবাহে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে; জলোচ্ছাস, ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়ে সরাসরি জখমের সংখ্যাও বাড়বে। তা ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে শারীরিকভাবে আহত হোন শিশু, মহিলা ও বৃদ্ধগণ। এছাড়া বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে শিশুরা মানসিকভাবেও হয়ে পড়ে পর্যুদস্ত। বিপুল মানুষ নিজস্ব আবাস ছেড়ে উদ্বাস্তুর জীবনে পদার্পণ করায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে গর্ভবতি মায়েদের জীবনে। তারা পাননা ন্যূনতম স্বাস্থ্য-সুবিধা, ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সন্তান জন্ম দেওয়া, লালন-পালনের কারণে অনায়াসেই সন্তানের শরীরে জায়গা করে নেয় নানা রোগব্যাধী। এছাড়া উদ্বাস্তু জীবনে বয়ঃসন্ধিকালে, কিশোর-কিশোরীরা পায়না উপযুক্ত ন্যূনতম পরিবেশ। কম বৃষ্টিপাতের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার সমস্যা দিনে দিনে আরো প্রকট হয়ে দাড়িয়েছে। বরিশাল ও পটুয়াখালীতে লবণাক্ততার পরিমাণ ২ পিপিটি (লবণাক্ততা পরিমাপক মাত্রা) থেকে বেড়ে ৭ পিপিটি হয়ে গেছে (প্রেক্ষিত ২০০৯)। চট্টগ্রাম শহর সন্নিকটের হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে ৮ পিপিটি হয়ে গেছে (২০০৯)। ক্রমাগত লবণাক্ত পানি পান ও ব্যবহারের ফলে মহিলাদের গর্ভধারনে দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন জটিলতা। তাই সারাংশে বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকিগুলা নির্ণয় করে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

স্বাস্থ্য এবং মানবাধিকারের মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে যেটি দেশের সংবিধান ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংবিধানেও এনটাইটেল করা হয়েছে।  স্বাস্থ্য হল সম্পূর্ণ শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতার একটি অবস্থা এবং শুধুমাত্র রোগ বা দুর্বলতার অনুপস্থিতি নয়। জাতি, ধর্ম, রাজনৈতিক বিশ্বাস, অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রতিটি মানুষ কোন পার্থক্য ছাড়াই রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বাস্থ্য সেবা উপভোগ করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংবিধানের পাশাপাশি, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি (ICESCR) স্বাস্থ্যের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই আমাদের উচিত, স্বাস্থ্য এবং মানবাধিকারের মধ্যে লিঙ্কগুলো খুঁজে বের করে তা সমন্বয় করা ও মানবাধিকারকে সমুন্নত রাখা। স্বাস্থ্যসেবা ও মানবাধিকারের উন্নয়নের জন্য সরকার, এনজিও এবং সুশীল সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।