সোমবার, ২১ জুলাই, ২০২৫

একটি অপারেশন ও বিকল আইপিএস থেকে শিক্ষা

 কিছু অভিজ্ঞতা জীবনে এমন শিক্ষা দিয়ে যায়, যা বইয়ে পাওয়া যায় না। সম্প্রতি, আমার জীবনে এমনই দুটি ঘটনা ঘটে গেল যা আমাকে শিখিয়ে দিল কিভাবে বাস্তব সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

কয়েকদিন আগে আমার স্ত্রী হঠাৎ তীব্র ব্যথা অনুভব করে। আমি ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই এবং দ্রুত তাকে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই। চিকিৎসক আল্ট্রাসনোগ্রামসহ বেশ কিছু পরীক্ষা করান। টেষ্ট রিপো্ট দেখে ডাক্তার তড়িঘড়ি করে বলেন, "অপারেশন করতে হবে, দেরি করা যাবে না!" আমি থমকে যাই, এত বড় সিদ্ধান্ত! তখন আমি সময় চেয়ে নিই এবং সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলি। তাদের পরামর্শে আমি আরেকজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। সেই চিকিৎসক পরীক্ষা করে বলেন, “এটা কোনো বড় সমস্যা না, অপারেশন লাগবে না।” তার পরামর্শে প্রয়োজনীয় ওষুধে স্ত্রী এখন ভালো আছেন। ভাবতে গিয়েই গা শিউরে ওঠে, প্রথম চিকিৎসকের কথায় যদি অপারেশন করিয়ে ফেলতাম, কী ভয়ংকর অপূরনীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারত!

আরেকটা ঘটনা ঘটে গেল আজকে। হঠাৎ করে বাসার আইপিএসটি বিকল হয়ে যায়। পরিচিত এক টেকনিশিয়ানকে ডেকে আনলাম। সে দেখে বলল, "এইটা আর ঠিক হবে না, নতুন আইপিএস কিনতে হবে।" আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম, লোডশেডিং এই লাগামহীন সময়ে বাসায় বিদুৎ না থাকলে আমার ছোট ছোট মেয়েরা খুব কষ্ট পাবে, ভাবলাম যেভাবেই হোক টাকা ম্যানেজ করে নতুন আইপিবসে কিনতে হবে, আবার মনে মনে বিকল্প উপায় খুঁজলাম

কিন্তু তখনই মনে পড়ে গেল আমার স্ত্রীর চিকিৎসার ঘটনার কথা। ভাবলাম, আরেকজনের মতামত নেই দেখি। আমি যেখান থেকে আইপিএসটি কিনেছিলাম, সেখানে যাই। তারা বলল, ওয়ারেন্টি শেষ, কিন্তু সাহায্য করবে। একজন দক্ষ টেকনিশিয়ানকে পাঠাল। তিনি এসে ভালোভাবে পরীক্ষা করে ছোট একটা যান্ত্রিক ত্রুটি খুঁজে পান এবং মিনিট দশেকেই আইপিএসটি মেরামত করে দেন। এখন আবার আগের মতো আইপিএসটি কাজ করছে! টেকনিশিয়ান বলল, সমস্যা হলে জানাবেন ভাবতে পারেন নতুন মেশিন কেনা মানে যে বড় অর্থনৈতিক চাপ ছিল, তা আপাতত এড়ানো গেল।

এই দুটি ঘটনার পর আমি একটি মূল্যবান শিক্ষা পেয়েছি: একটি সমস্যার সমাধান খুঁজতে কখনো এককভাবে সিদ্ধান্তে না গিয়ে, সময় নিয়ে আরও কিছু মতামত সংগ্রহ পরিচিতদের কাছ থেকে মতামত সংগ্রহ করা উচিত। একাধিক মত থেকে যাচাই-বাছাই করে আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত এবং অভিজ্ঞতায় বলে সে সিদ্ধান্তের ফলাফল হবে বাস্তবসম্মত, সাশ্রয়ী এবং নিরাপদ সত্যিই, জীবনের অনেক কঠিন মুহূর্তে ঠান্ডা মাথায় ভাবা আর বিকল্প খোঁজার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সঠিক পথের সন্ধান।

AI হোক আপনার চিন্তার সহযোগী কিন্ত আপনার চিন্তার বিকল্প নয়!

 সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে এক গুরুত্বপূর্ণ এবং কিছুটা উদ্বেগজনক তথ্য; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এর অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষের স্মৃতিশক্তি, উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা এবং সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ ক্ষমতা হ্রাস করতে পারে। গবেষকরা চার মাস ধরে ৫৪ জন শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন। দেখা যায়, যারা লেখার ক্ষেত্রে নিয়মিত AI-এর ওপর নির্ভর করছিলেন, তাদের মস্তিষ্কের কার্যক্রম তুলনামূলকভাবে কম সক্রিয়। এতে তাদের স্মৃতিশক্তি ও বিশ্লেষণী চিন্তার দক্ষতা হ্রাস পেয়েছে।

অন্যদিকে, যেসব শিক্ষার্থী প্রাথমিকভাবে AI ছাড়া গতানুগতিক পড়াশোনা শুরু করেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ChatGPT-এর মতো AI ব্যবহার করে ধারণা সংগ্রহ করেছেন, তাদের মস্তিষ্ক আরও বেশি সক্রিয় নিয়মিত AI ব্যবহারকারী তুলনায়। এ থেকে বোঝা যায়, AI তখনই সবচেয়ে কার্যকর যখন এটি চিন্তার বিকল্প না হয়ে চিন্তাকে সমৃদ্ধ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

গবেষকরা আরও সতর্ক করেছেন যে, যখন ব্যবহারকারীরা যাচাই-বাছাই না করে অ্যালগরিদমিক উত্তর গ্রহণ করেন, তখন "ইকো চেম্বার" তৈরি হয়, যা চিন্তাধারার বৈচিত্র্য নষ্ট করে ফেলে। এই গবেষণা একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়, AI হতে পারে এক মূল্যবান সহযোগী, তবে এটি যেন কখনো আমাদের নিজস্ব চিন্তাশক্তির বিকল্প না হয়ে ওঠে। তাই AI ব্যবহারে আমাদের হতে হবে পরোক্ষ অংশগ্রহণকারী, কেবল সক্রিয় ব্যবহারকারী নয়। নিজের বিশ্লেষণ, প্রশ্ন এবং চিন্তার ভিতের উপর দাঁড়িয়ে AI-কে ব্যবহার করলেই তা হয়ে উঠবে আমাদের প্রকৃত বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়ক। আমরা AI কে নিয়ন্ত্রন করব, AI আমাদেরকে নয়!

বুধবার, ২ জুলাই, ২০২৫

ইউএসএআইডি শুধুই একটি দাতা সংস্থা নয়, এটি ছিল বিশ্ব মানবতার এক শক্তিশালী হাত

যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (USAID) ১৯৬১ সাল থেকে বৈশ্বিক উন্নয়ন, দারিদ্র্যতা হ্রাস, গণতন্ত্রের বিকাশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, মানবাধিকার এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছিল। বিশ্বের নানা দেশে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর টেকসই উন্নয়নের পথে ইউএসএআইডি একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে কাজ করছিল। মার্কিন সরকারে রাস্ট্রীয় ঘোষণায় গত ০১ জুলাই ২০২৫ (USAID) আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। গত জানুয়ারী থেকে, ট্রাম্প প্রশাসন মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (USAID) কে পদ্ধতিগতভাবে ভেঙে দিয়েছে, হাজার হাজার চুক্তি বাতিল করেছে, বিদেশে হাজার হাজার কর্মীকে বরখাস্ত করেছে। বাংলাদেশেও ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে পরিচালিত সব উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ হয়েছে (বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম ছাড়া), প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট জনবল চাকুরী হারিয়েছে (বাংলাদেশে এর সংখ্যা প্রায় ৫০,০০০)। ফেব্রুয়ারির শুরুতে, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছেন যে USAID যে লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছিল, সেই লক্ষ্য থেকে ইউএসএআইডি অনেক আগেই সরে গেছে এবং অভিযোগ উঠেছে এর তহবিল মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহার হয়েছে”। যার ফলে এই আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাটি গত ০১ জুলাই বন্ধ হয়ে গেছে।

ইউএসএআইডি বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে টেকসই উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে। এই সংস্থার অর্থায়নে আফ্রিকার গ্রামীণ জনগোষ্ঠী সুপেয় পানি ও পুষ্টিকর খাদ্য, লাতিন আমেরিকায় উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা, দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্যোগ প্রস্তুতি ও জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়ে আসছিল।

বাংলাদেশের উন্নয়নে ইউএসএআইডির অবদান অনস্বীকার্য। স্বাধীনতার পর থেকেই ইউএসএআইডির  আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় এদেশে বহুমুখী উন্নয়ন ঘটেছে। যেমন: স্বাস্থ্য খাতে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা; সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ তৈরি; দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বহুমুখী প্রস্তুতি ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা; নারীর ক্ষমতায়ন ও মানবাধিকার রক্ষায় গ্রামীণ নারীদের প্রশিক্ষণ ও অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি; গণতন্ত্র ও সুশাসন, স্থানীয় সরকার জবাবদিহিকরণ, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ এবং নাগরিক সমাজকে সক্রিয় করা মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত । বিশেষ করে, এনজিও ও সুশীল সমাজের সঙ্গে কাজ করে ইউএসএআইডি গণতান্ত্রিক চর্চা ও উন্নয়নকে বেগবান করেছে।

সংশ্লিষ্ট বিশেজ্ঞরা মনে করছেন, ইউএসএআইডির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বৈশ্বিকভাবে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। মানবিক সহায়তা বা বরাদ্ধ কমে যাবে, দুর্যোগ-প্রবণ অঞ্চলে সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা হ্রাস পাবে, এবং অনেক দেশে গরিব মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে, স্বাস্থ্যখাত, স্থানীয় উন্নয়ন, দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং নাগরিক ক্ষমতায়নে যে সহায়তা আসতো তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সর্বোপরি, ইউএসএআইডি শুধুই একটি দাতা সংস্থা নয়, এটি ছিল বিশ্ব মানবতার এক শক্তিশালী হাত। এই সংকট উত্তরণে প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত পদক্ষেপ, বিকল্প উন্নয়ন অংশীদার খোঁজা এবং স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের উন্নয়নে কিভাবে আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারে, তার উপায় খোঁজা। একইসাথে, বাংলাদেশ সরকার ও এনজিওগুলোর উচিত ইউএসএআইডির বিকল্প উৎস খুঁজে পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা।


মঙ্গলবার, ২৪ জুন, ২০২৫

ছোট গল্প: অপেক্ষা ও কৌতুহল

 প্লেনের টিকিট কেটে আমি বেশ উত্তেজিত। ঢাকায় যাচ্ছি! সিট নম্বর ০৪ সি — জানালার পাশে। সূর্যের আলো মুখে পড়ে সিনেমার হিরোর মতো লাগছিল নিজেকে। চমৎকার! জানালার পাশে বসলেই তো দিগন্ত দেখা যায়, আর পাশের সিটে কেউ মজার লোক পড়লে তো কথাই নেই। পরিচয় হবে, গল্প হবে, হয়তো বন্ধুত্ব পর্যন্ত গড়াবে। কিন্তু আমার মন পুরোপুরি স্যাটিসফাইড হচ্ছিল না। কেননা পাশের সিটটা তখনো ফাঁকা। ব্যাগ রেখে আরাম করে বসলাম, মনে মনে ভাবলাম, কে আসবে? হয়তো কোনো প্রবাসী ভাই, না হয় কোনো কর্পোরেট ভদ্র পুরুষ/মহিলা, কিংবা কোনো শিক্ষানবিশ তরুণ/ তরুণী যার সাথে পরিচয় হবে ফেসবুক আইডি, লিংকড-ইনের একাউন্ট পর্যন্ত বিনিময় হয়ে যাবে! আমি আরো ভাবতে লাগলাম, "আহা, যদি পাশের যাত্রীটি হয় কোন ভদ্রলোক গল্প করার মতো, হালকা ঠাণ্ডা স্বভাবের। হয়তো বই পড়েন, কিংবা ট্রাভেল লাভার। নয়তো এমন কেউ, যার সাথে রাজনীতি থেকে শুরু করে আমের চাটনি পর্যন্ত আলোচনা করা যায়!" ভাবনায় ভাবনায় চলে গেলাম আরেক লেভেলে, যদি পাশের সিটে বসে কোন... ?। গল্পে গল্পে বন্ধুত্ব হয়ে যাবে, হঠাৎ নিজেকে থামালাম “এইসব চিন্তা বাদ দাও ভাই, গল্পই হবে না যদি পাশের যাত্রী সাইলেন্ট মোডের হয়।”

এত ভাবনা শেষে ঘড়ির কাঁটা দেখে দেখি, প্লেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে, বিমান ক্রু নিরাপত্তা নির্দেশিকা দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। অনেক সহযাত্রী প্রিয়জনকে ফোন করে বিমানে অনবোর্ড হবার কথা জানাচ্ছে। আমি মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে ০৪ সি’র সম্ভাব্য যাত্রীকে খুঁজছি, কেউ কি এইদিকে আসছে? না, সবাই পাশ কাটিয়ে চলে গেল। প্লেনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আমার কৌতূহলের বিদ্যুৎ চুপচাপ নিভে গেল। সিটটা তখনো ফাঁকাই রয়ে গেল!




শনিবার, ৮ মার্চ, ২০২৫

স্বাস্থ্য বীমা কি? বর্জ্য সংগ্রহকারীদের স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা

স্বাস্থ্য বীমা হলো একটি আর্থিক সুরক্ষা ব্যবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রিমিয়াম পরিশোধের মাধ্যমে চিকিৎসা ব্যয় বহনের নিশ্চয়তা পায়। এটি অসুস্থতা, দুর্ঘটনা বা চিকিৎসা সংক্রান্ত জরুরি পরিস্থিতিতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। বিশ্বের অনেক দেশ তাদের নাগরিকদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা বা সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা (Universal Health Coverage - UHC) নিশ্চিত করেছে। কিছু দেশ সম্পূর্ণ সরকারি ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে, আবার কিছু দেশ সরকারি ও বেসরকারি উভয় ব্যবস্থার মাধ্যমে এটি পরিচালনা করে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসুরক্ষা প্রকল্প পাইলট স্টেজে আছে। সাধারণভাবে, বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিক কর্মজীবীদের জন্য স্বাস্থ্য বীমা কিছু ক্ষেত্রে প্রচলিত হলেও, বর্জ্য সংগ্রহকারীদের জন্য স্বাস্থ্য বীমা খুব কঠিন ও দুরুহ বিষয়।

বর্জ্য সংগ্রহকারীরা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও তারা অবহেলিত কর্মজীবী শ্রেণি।  বর্জ্য সংগ্রহকারীরা প্রতিদিন ঘরবাড়ি, রাস্তা, কারখানা ও বাজার এলাকা থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে, যা পরিবেশ দূষণ রোধ করতে সহায়তা করে। যদি তারা না থাকত, তাহলে শহরে আবর্জনার স্তুপ জমে গিয়ে মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যা তৈরি হতো। বর্জ্য সংগ্রহকারীরা নিয়মিতভাবে আবর্জনা পরিষ্কার করে এডিস মশা, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসজনিত রোগ (যেমন ডেঙ্গু, কলেরা, টাইফয়েড) প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্জ্য সংগ্রহকারীরা অনেক পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ (যেমন প্লাস্টিক, কাগজ, ধাতু) আলাদা করে যা রিসাইক্লিং শিল্পের চাহিদা মেটাচ্ছে। রিসাইক্লিং কাঁচামালের চাহিদা কমায় এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে সহায়তা করে। বর্জ্য সংগ্রহকারীদের সংগ্রহ করা পুনঃব্যবহারযোগ্য সামগ্রী বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত হয়, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (Sustainable Development Goals - SDGs) মধ্যে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, সুস্বাস্থ্য এবং টেকসই নগর ব্যবস্থাপনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বর্জ্য সংগ্রহকারীরা এ লক্ষ্য পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বর্জ্য সংগ্রহকারীরা সমাজের জন্য অবদান রাখলেও তাদের কাজের স্বীকৃতি এবং সুরক্ষা খুবই কম। তাদের স্বাস্থ্য, সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার। সেই প্রেক্ষাপটে, ইপসা চট্টগ্রামে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় প্রায় ২০০০ বর্জ্য সংগ্রহকারীদের জন্য স্বাস্থ্য বীমা চালু করেছে। এই কার্যক্রমে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করছে ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড। গত ০৪ মার্চ, ২০২৫ ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড এর প্রধান কর্পোরেট কার্যালয় ঢাকায়, ইপসা ও মেটলাইফ এর সাথে বর্জ্য সংগ্রহকারীদের স্বাস্থ্য বীমা বিষয়ক এক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে বর্জ্য সংগ্রহকারীরা মূত্য ও দুর্ঘটনাজনিত কারণে অঙ্গহানি হলে সবোর্চ্চ ৩ লক্ষ টাকা পাবে, ও কর্মস্থলে দুর্ঘটনা শিকার হলে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা খরছ পাবেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে বর্জ্য সংগ্রহকারীদের জন্য এই ধরনে স্বাস্থ্য বীমা দেশে বিরল ও অন্যতম।

স্বাস্থ্য বীমার আওতায় বর্জ্য সংগ্রহকারীদের আনা খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি সবছেয়ে বেশি। বর্জ্য সংগ্রহের সময় তারা বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও টক্সিক পদার্থের সংস্পর্শে আসেন, যা সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। রাসায়নিক বর্জ্য, মেডিকেল বর্জ্য এবং ই-ওয়েস্ট থেকে বিষাক্ত গ্যাস বা পদার্থের সংস্পর্শে আসার ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। ধুলাবালি, গ্যাস, এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থ ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার কারণ হয়ে থাকে। যার ফলে তারা সহজেই ডায়রিয়া ও পেটের সংক্রমণ, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস A, কলেরা, যক্ষ্মা (TB), ফাঙ্গাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে ত্বকে চুলকানি, অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, স্নায়ুবিক সমস্যা, কিডনি ও লিভারের রোগ, ক্যান্সার আক্রান্ত হচ্ছেন। চিকিৎসা ব্যায়ের অভাবে তারা সহজেই মূত্যুবরণ করছেন। গবেষণায় দেখা গেছে বর্জ্য সংগ্রহকারীদের জীবন আয়ু সাধারণ মানুষদের তুলনায় অনেক কম হয়ে থাকে।  তাই তাদের হেলথ ইনসুরেন্সের আওতায় আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থনৈতিক সুরক্ষার জন্য বর্জ্য সংগ্রহকারীদের স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আনা গুরুত্বপূর্ণ। বর্জ্য সংগ্রহকারীরা সাধারণত নিম্ন আয়ের মানুষ, যারা চিকিৎসার খরচ বহন করতে পারে না। ইনসুরেন্স তাদের চিকিৎসার খরচ কমাতে সাহায্য করবে। যদি তারা ইনসুরেন্সের আওতায় থাকে, তাহলে কম খরচে বা বিনামূল্যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারবে। অনেক সময় দেখা যায়, বড় অসুস্থতার কারণে  তারা কাজ করতে পারে না। সেক্ষত্রে, কোনো বড় অসুস্থতার কারণে কাজ করতে না পারলে তাদের আয় বন্ধ হয়ে যায়। হেলথ ইনসুরেন্স থাকলে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। তাই তাদের হেলথ ইনসুরেন্সের আওতায় আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলমা-আতা ঘোষণা, জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ২৫ (১), শিশু অধিকার সনদ, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণের কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী দেশ।  এই সমস্ত আন্তর্জাতিক সনদে স্বাস্থ্যকে একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য যখন মানুষেরর মৌলিক মানবাধিকার, তখন রাষ্ট্রকে অবশ্যই সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি বর্জ্য সংগ্রহকারীদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার আছে। একজন বর্জ্য সংগ্রহকারীর স্বাস্থ্য বীমা থাকলে তার সহজেই চিকিৎসা সুবিধা পেতে পারে, যা তাদের সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে।  স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হলে তারা আরও কর্মক্ষম ও সুস্থ থাকবে, যা সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্যও উপকারী।  তাই তাদের হেলথ ইনসুরেন্সের আওতায় আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সেই প্রেক্ষাপটে, ইপসা চট্টগ্রামে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় ১৮২৭ বর্জ্য সংগ্রহকারীদের জন্য স্বাস্থ্য বীমা চালু করেছে। এই কার্যক্রমে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করছে ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড। বর্জ্য সংগ্রহকারীদের স্বাস্থ্য বীমা নিশ্চিত করার জন্য ইপসা ও মেটলাইফ এর সাথে বর্জ্য সংগ্রহকারীদের স্বাস্থ্য বীমা বিষয়ক এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে বর্জ্য সংগ্রহকারীরা মূত্য ও দুর্ঘটনাজনিত কারণে অঙ্গহানি হলে সবোর্চ্চ ৩ লক্ষ টাকা পাবে, দুর্ঘটনাজনিত কারণে অঙ্গহানি হলে ১.৫ লক্ষ টাকা পাবেন ও কর্মস্থলে দুর্ঘটনা শিকার হলে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা খরছ পাবেন। বর্জ্য সংগ্রহকারীরা এই স্বাস্থ্য সেবার জন্য কোন প্রিমিয়াম দিতে হবে না। তবে, চট্টগ্রাম শহরে প্রায় দশ হাজারের অধিক বর্জ্য সংগ্রহকারী রয়েছে, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে এই শহর আমরা বাসযোগ্য পাচ্ছি, তাদের সবার কথা আমাদের ভাবতে হবে, এভাবে পর্যায়ক্রমে সারাদেশে এই সেবা নিশ্চিত করতে হবে, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া সবার নাগরিক অধিকার। পাশাপাশি, ইপসা ও ইউনিলিভারের মত অন্যান্য বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতির কোম্পানীকে এই বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। স্বাস্থ্য বীমা শুধু একজন কর্মীর ব্যক্তিগত কল্যাণ নয়, বরং প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনঃ প্রবালের জীবন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের গঠন, গুরুত্ব ও সংরক্ষণে করণীয়

পৃথিবীর তিনভাগ জল আর একভাগ স্থল। পৃথিবী সৃষ্টির রহস্য লুকিয়ে আছে সমুদ্রে। সমুদ্রে কত প্রজাতির প্রাণি আছে তার সঠিক তথ্য বিজ্ঞানীরা এখনো সঠিকভাবে বলতে পারেনি। ভবিষ্যতে হয়তো জানা যাবে। মনে করা হয়, সমুদ্রের মাত্র এক-দুই শতাংশ প্রাণীকুল সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। সমুদ্রে যত প্রাণী রয়েছে তার মধ্যে প্রবাল (Coral) এক বিষ্ময়কর প্রাণী। প্রাথমিক দৃষ্টিতে প্রবালকে জড়বস্ত মনে হলেও আসলে এরা জীবন্ত সামুদ্রিক প্রাণী। অন্যান্য স্বাভাবিক প্রাণীর ন্যায় এরা খাবার গ্রহণ করে, বংশবিস্তার করে কিন্ত চলাফেরা করতে পারে না। সাগরতলে এক জায়গায় ঘাঁটি গেড়ে সরাটা জীবন কাটিয়ে দেয়। প্রাণীজগতে এদের স্থান অ্যান্থোজোয়া শ্রেণীতে, এরা অমেরুদন্ডী এবং অনেকগুলো প্রজাতি আছে।

এক একটা প্রবাল-প্রাণীকে বলা হয় পলিপ। এই পলিপগুলো সাধারণত আকারে খুবই ছোটো (মাত্র ১/২ মিলিমিটার লম্বা)। এরকম হাজার হাজার প্রবাল-পলিপ সমুদ্রের নিচে কলোনি বানিয়ে একসাথে বাস করে। এই কলোনি থেকেই গড়ে ওঠে প্রবাল প্রাচীর ও প্রবাল দ্বীপ। ধারনা করা হয়, বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বিপ সেন্ট মার্টিন এভাবে গড়ে ওঠেছে। প্রবালের পলিপ নিজের দেহের ওপর ক্যালসিয়াম কার্বোনেট দিয়ে এক বিশেষ খোলস তৈরি করে। একই কলোনির হাজার হাজার পলিপের খোলস পরস্পর জুড়ে গিয়ে ক্রমশ একটা বড়ো কাঠামো গড়ে ওঠে। সেই কাঠামোর ওপরে প্রবাল-পলিপরা মারা যাওয়ার পর সেখানে বেড়ে ওঠে নতুন পলিপদের কলোনি। এই ভাবে শত শত বছর ধরে একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে সমুদ্রের নিচে রূপ নেয় প্রবাল প্রাচীর (Coral Reef)। প্রবাল প্রাচীরগুলো দেখতে অপূর্ব সুন্দর। এগুলো বাদামি, লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, সোনালি, ইত্যাদি নানান রঙে রঙানো থাকে। প্রবালে বসবাসকারী অ্যালজি, স্পঞ্জ ও অন্যান্য জীবরা এতে নানান উপাদান যোগ করে এর বর্ণবৈচিত্রকে আরো বাড়িয়ে তোলে।

প্রবালের খাওয়াদাওয়া, বংশবিস্তার সব কিছুই অদ্ভুত। প্রবাল প্রাণী, তাই তারা উদ্ভিদের মতো নিজেদের খাবার নিজেরা তৈরি করতে পারে না। প্রবালের পলিপগুলো তাদের ছোট ছোট হাত টেন্টাকেলের মাধ্যমে সাগরের জলে ভেসে আসা অতিক্ষুদ্র প্রাণী-প্ল্যাঙ্কটন শিকার করে খায়। সাধারণত রাতের বেলায় এরা এইভাবে শিকার করে খাবর খায়। তবে এইভাবে পলিপগুলো তাদের পুষ্টি চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ পূরণ করে। এদের পুষ্টির বেশিরভাগটা আসে এদের দেহকলায় আশ্রয় নেওয়া অতিসূক্ষ্ম অ্যালজিদের (Zooxanthellae) কাছ থেকে। অ্যালজিদের সাথে প্রবালের বন্ধুত্ব অতি ঘনিষ্ঠ। অ্যালজিরা প্রবাল থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিয়ে সূর্যের আলো ব্যবহার করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার খাবার তৈরি করে। এই তৈরি খাবারের ভাগ পায় প্রবাল। অ্যালজিরা খাবার তৈরির সময় অক্সিজেন ও জৈব উপাদান উৎপাদন করে যা প্রবাল খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। এই প্রক্রিয়াকে সিমবায়োটিক পদ্ধতি বলে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে এই ক্ষুদ্র প্রাণী প্রবাল কোটি কোটি বছর টিকে আছে।  এছাড়াও প্রবাল সাগরের জল থেকে অজৈব ক্যালসিয়াম, নাইট্রোজন, ফসফরাস, ইত্যাদি শোষণ করে কাজে লাগাতে পারে। অ্যালজিরা প্রবালের রং নির্ণয়েও  ভূমিকা রাখে।

প্রবালের প্রজনন বা বংশবিস্তারঃ

প্রবাল সাধারণত দুইভাবে প্রজনন ও বংশবিস্তার করে যেমন; অযৌন এবং যৌনভাবে। অযৌন প্রজননে, নতুন ক্লোনাল পলিপগুলি পিতামাতার পলিপ থেকে অঙ্কুরিত হয় এবং নতুন উপনিবেশ তৈরি করে। এটি ঘটে যখন পিতামাতার পলিপ একটি নির্দিষ্ট আকারে পৌঁছায় এবং বিভক্ত হয়। এই প্রক্রিয়াটি প্রবালের জীবন জুড়ে চলতে থাকে। যৌন জননের ক্ষেত্রে অন্তঃনিষেক ও বহিঃনিষেক, দুই-ই হয়ে থাকে। বহিঃনিষেকের জন্য প্রবালের পছন্দ বসন্তকাল। এই সময় পূর্ণিমা থেকে পরপর ক’দিন, জোছনা রাতে সাগরজলের মায়াবী পরিবেশে প্রবাল প্রাচীরের পলিপরা ডিম্বাণু ও শুক্রাণু ছড়িয়ে যৌন জননে মেতে ওঠে। ডিম্বাণু ও শুক্রাণুগুলোর মিলনে জন্ম নেয় নতুন নতুন পলিপ।

কিভাবে প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন গড়ে ওঠেছেঃ

সমুদ্রের বুকে প্রবাল প্রাচীরগুলো খুব ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। প্রবাল বংশ বিস্তারের জন্য সমুদ্রজলের উষ্ণতা ২০ সেঃ- ২১ সেঃ আদর্শ িএবং সে অংশে সূর্যালোক পৌঁছা আবশ্যক। তাই গ্রীষ্মমন্ডলীয় অংশে প্রবাল দ্বীপ গড়ে ওঠেছে।  প্রবাল প্রাচীর লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বাড়তে বাড়তে একসময় ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের ফলে দ্বীপে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর বৃহত্তম প্রবাল প্রাচীর হলো অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড উপকূলের কাছে অবস্থিত গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ। সেন্টমার্টিন দ্বীপটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ মূলত জীবন্ত প্রবাল দ্বারা গঠিত। প্রবাল পলিপ নামক সামুদ্রিক প্রাণী চুনযুক্ত কঙ্কাল তৈরি করে। এই কঙ্কাল একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে প্রবাল প্রাচীর গঠন করেছে। ধারনা করা হয়, প্রাচীনকালে বঙ্গোপসাগরের পানির তলদেশে প্রবাল বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ধীরে ধীরে স্তূপ আকারে উঁচু হতে শুরু করে। ভূগোলবিদদের মতে, বঙ্গোপসাগরের তলদেশে টেকটোনিক প্লেটের ধাক্কা ও আন্দোলনের ফলে এক ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের কিছু অংশ উঁচু হয়ে দ্বীপ হিসেবে উত্থিত হয়। এবং পরবর্তিতে প্রবাল গঠনের আর্দমিক পরিবশে পেয়ে বঙ্গোপসাগরের পানির তলদেশে প্রবাল বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ধীরে ধীরে স্তূপ আকারে উঁচু সেন্টমার্টিন দ্বীপ গড়ে ওঠে। প্রবাল প্রাচীরের সাথে পলি ও বালি জমা হয়ে দ্বীপের মাটি শক্ত হয়। সময়ের সাথে সাথে ঢেউ, বায়ুপ্রবাহ এবং সমুদ্রের স্রোত দ্বীপটির প্রান্তে পরিবর্তন ঘটায়। এই প্রক্রিয়া সেন্ট মার্টিনের আকৃতি ও গঠনকে আরও উন্নত করে।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সুনির্দিষ্ট বয়স নির্ধারণ করা কঠিন, কারণ এটি প্রাকৃতিকভাবে গঠিত এবং এর গঠন প্রক্রিয়া কয়েক হাজার বছর ধরে চলেছে। তবে ভূতাত্ত্বিক গবেষণার ভিত্তিতে ধারণা করা হয় যে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের গঠন শুরু হয়েছিল প্রায় ৬,০০০ থেকে ৭,০০০ বছর আগে। প্রবাল গঠনের হার খুবই ধীর, প্রতি বছরে মাত্র কয়েক মিলিমিটার। এর ভিত্তিতে বোঝা যায় যে দ্বীপটি কয়েক হাজার বছর ধরে ধীরে ধীরে গঠিত হয়েছে।

প্রবাল প্রাচীর গড়ে ওঠার কারণ ও সহায়ক নিয়ামকঃ

১. সমুদ্রজলের উষ্ণতা ও গভীরতা : প্রবাল কীটের পলিপের বংশ বিস্তারের জন্য সমুদ্রজলের উষ্ণতা অবশ্যই ২০ সে.-২১ সে. হওয়া দরকার এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬০-৭৫ মিটার গভীরতায় প্রবালকীট পলিপ বৃদ্ধির সহায়ক, কারণ এই গভীরতা পর্যন্ত অংশে সূর্যালোক পৌঁছায়।

২. জলের আলোড়ন ও সমুদ্র স্রোত : জলের আলোড়ন ও সমুদ্রস্রোত প্রবাল কীট পলিপের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অক্সিজেনের জোগান অব্যাহত রাখে। এজন্য জীবন্ত প্রবাল কীট উপহ্রদের পরিবর্তে উন্মুক্ত সমুদ্রে বেশি লক্ষ্য করা যায়।

৩. পলিমুক্ত স্বচ্ছ জল : প্রবাল কীটের মুখে পলিকণা জমতে থাকলে তারা অক্সিজেন নিতে পারে না। ফলে এরা পরিপাক করতে পারে না ও মারা যায়। সেই জন্য পলিমুক্ত স্বচ্ছ জল দরকার।

৪. মিষ্টি জলের প্রভাব মুক্ততা : পরিষ্কার মিষ্টি জল প্রবাল কীটের পক্ষে ক্ষতিকর বলে মোহানা থেকে দূরে এরা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।

৫. লবণতার পরিমাণ : প্রচুর পরিমাণে চুনের কার্বোনেট প্রবাল কীটের প্রধান খাদ্য। জলের গড় লবণতা ২৭% থেকে ৪০%-এর বেশি হয়ে গেলে ওই কার্বোনেটের পরিমাণ কমে যায় এবং প্রবালকীট বংশবিস্তার করতে ব‍্যহত হয়।

৬. অন্তঃসাগরীর মঞ্চের অবস্থান : তটভূমি বরাবর  ১০০ মিটার গভীরতায় মহাদেশীয় শক্ত শিলার উপস্থিতি প্রবাল কীটের সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপনের সহায়ক।

সেন্ট মার্টিন প্রবাল দ্বীপের গুরুত্বঃ

সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। পাথুরে এ দ্বীপটি তার অনন্য জীববৈচিত্র্য এবং প্রবালসমৃদ্ধ পরিবেশের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এটি কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য নয়, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশগত সুরক্ষা, এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯৭ সালের পর থেকে এ দ্বীপের প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ সরকারি জরিপ হয়নি। ১৯৯৭ সালে কানাডিয়ান সমুদ্রবিজ্ঞানী থমাস তমাসিকের নেতৃত্বে একটি গবেষণায় সেন্টমার্টিনের সমৃদ্ধ প্রাণ-প্রকৃতির তথ্য পাওয়া যায়। সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য রক্ষায়  প্রবাল দ্বীপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থলঃ প্রবাল দ্বীপকে "সামুদ্রিক বন" বলা হয়। এটি বিশ্বের ২৫% সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য বাসস্থান সরবরাহ করে। সমুদ্রতলের মাত্র ১ শতাংশ জায়গা দখল করে থাকা প্রবাল প্রাচীরগুলো সমস্ত সামুদ্রিক প্রজাতির প্রায় ২৫ শতাংশকে আশ্রয় দেয়।  সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রবালের পাশাপাশি মাছ, কাঁকড়া, শামুক, ডলফিন, সামুদ্রিক কচ্ছপসহ অসংখ্য সামুদ্রিক জীবের বাসস্থান রয়েছে। এখানে বেশ কয়েকটি বিরল এবং হুমকির মুখে থাকা প্রাণী যেমন অলিভ রিডলে কচ্ছপ দেখা যায়। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, দ্বীপটিতে রয়েছে ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল এবং কচ্ছপ, কাঁকড়াসহ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী। তবে এসব তথ্য দীর্ঘদিন ধরে হালনাগাদ হয়নি। বিচ্ছিন্ন কিছু গবেষণায় প্রবালের সংখ্যা কমার প্রমাণ মিললেও নতুন স্থানে প্রবালের জন্মও লক্ষ্য করা গেছে।

পর্যটন শিল্পে ভূমিকাঃ সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। এর স্বচ্ছ নীল পানি, প্রবাল পাথর, এবং মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। প্রতিবছর ৪-৫ লক্ষ পর্যটক এই দ্বীপে ভ্রমন করে থাকেন। পর্যটন থেকে স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হয় এবং অনেক মানুষের জীবিকা নির্বাহের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

উপকূলীয় সুরক্ষাঃ দ্বীপটি বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকাকে জলোচ্ছ্বাস ও ঝড়ের প্রভাব থেকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে। প্রবাল প্রাচীর প্রাকৃতিক বাঁধের মতো কাজ করে, যা সাগরের ঢেউ ও জোয়ারের তীব্রতা কমায়।

পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষাঃ প্রবাল প্রাচীর সমুদ্রের জলের গুণগত মান উন্নত করে এবং সামুদ্রিক খাদ্যজাল বজায় রাখে। এটি কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে ভূমিকা রাখে।

গবেষণা ও শিক্ষাঃ সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পরিবেশ ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি উন্মুক্ত ল্যাবরেটরি, যেখানে তারা সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে শিক্ষা নিতে পারে।

স্থানীয় সংস্কৃতি ও জীবিকাঃ  স্থানীয় মানুষের জীবিকার একটি বড় অংশ মাছ ধরা এবং পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত। দ্বীপটির পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সরেজমিনে দেখা গেছে, গত দু'দশক ধরে পর্যটনে নির্ভর দ্বীপবাসী পূর্ব পুরুষদের পেশা মাছ ধরা ধীরে ছেড়ে দিয়েছে। ছেড়ে দিয়েছে পুরো দমে চাষাবাদও।

ঔষধি ও প্রাকৃতিক সম্পদঃ সেন্ট মার্টিনের প্রবাল প্রাচীর থেকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান পাওয়া যায়, যা ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার হতে পারে। প্রবাল প্রাচীর থেকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক যৌগ সংগ্রহ করা হয়, যা ক্যান্সার, এইচআইভি, আর্থ্রাইটিস, এবং অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার হয়।

সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ সুরক্ষায় আইনি কাঠামো ও সরকারের পদক্ষেপসমূহঃ
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সর্বশেষ ২০২০ সালের আগস্টে সেখানে পর্যটক নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০২১ সালের ২ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। এতে সেন্ট মার্টিনের সৈকতে আলো জ্বালিয়ে বারবিকিউ, দোকানপাটে বেচাকেনা, সৈকতের পাথরে সংগ্রহ, মোটরসাইকেলসহ যেকোনো ধরনের যানবাহনে চলাচল নিষিদ্ধসহ ১৪টি বিধিনিষেধ আরোপ করে।  ২০২৩ সালে জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পর্যটক নিয়ন্ত্রণ, টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল সীমিত করাসহ ১৩টি বিষয়ে নীতিমালা তৈরি করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। সেন্ট মার্টিন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালে, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সভায় সেন্ট মার্টিনে চার মাস পর্যটকদের যাতায়াত ও অবস্থান সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নভেম্বরে পর্যটকেরা যেতে পারলেও রাতে থাকতে পারবেন না। আর ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে গিয়ে রাতেও থাকতে পারবেন। তবে ওই সময় দিনে দুই হাজারের বেশি পর্যটক যেতে পারবেন না। আর ফেব্রুয়ারিতে পর্যটকেরা সেখানে যেতে পারবেন না। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পর্যটন নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগের বিষয়টি নিয়ে উল্টো প্রচার শুরু হয়। সেখানে মার্কিন ঘাঁটি তৈরিসহ নানা ধরনের অপপ্রচার চলতে থাকে। সরকারের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মাঠে নেমেছে ‘কক্সবাজারে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পরিবেশ ও পর্যটন উন্নয়ন জোট’ নামের একটি সংগঠন। সংশ্লিষ্টদের মতে, পর্যটন সীমিত করার ফলে এই খাতের সঙ্গে জড়িত ও স্থানীয় মানুষদের জীবন ও জীবিকাতেও আঘাত এসেছে। সেখানকার কুকুরগুলো খাদ্য অভাবে মারা যাচ্ছে। 

গত দুই যুগে ধরে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের কারণে, হাজার বছরের পুরোনো দ্বীপটির  মাটি, পানি ও বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, পর্যটনের কারণে উচ্চ তাপমাত্রার পাশাপাশি লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন উজাড়, দূষণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, কচ্ছপের আবাস ধ্বংস, প্লাস্টিকের ব্যবহার, মিঠাপানির সংকট, জোয়ারে সমুদ্রভাঙনসহ নানা বিপদ দেখা দিয়েছে। দ্বীপটির পরিবেশ রক্ষার জন্য টেকসই ব্যবস্থাপনা, সচেতন পর্যটন এবং সরকারের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।

সেন্ট মার্টিন সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা ও অস্বচ্ছতা দূর করতে সরকার সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ সুরক্ষায় ফেব্রুয়ারী মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ সাসটেইনেবল এলায়েন্স (বিএসএ)উদ্যোগে নেওয়া হয়েছে সমুদ্র সৈকত পরিছন্নতা কার্যক্রম। এই আয়োজনে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। স্থানীয় জনগণের পরিবেশ স্বাক্ষরতা ও সমুদ্র সৈকত পরিছন্নতা কার্যক্রমে কারিগরী জ্ঞান প্রদান করে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ইপসা। এই কার্যক্রমে উপস্থিত ছিলেন টেকনাফ উপজেলার নির্বাহী অফিসার, পরিবেশ অধিদপ্তর, কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রবৃন্দ, ছাত্র প্রতিনিধি, পরিবেশ কর্মী, শিক্ষক এবং সেন্টমার্টিনে অবস্থানরত বিভিন্ন সংগঠন ও পেশাজীবি’র প্রতিনিধি।


শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনের পূর্ব শর্ত সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

চট্টগ্রাম বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী ও অন্যতম বন্দর নগরী । আকার ও জনসংখ্যার দিক থেকে রাজধানী ঢাকা’র পরেই চট্টগ্রামের স্থান। পাহাড় আর সমুদ্র দিয়ে ঘেরা চট্টগ্রাম শহর। ১৯৯০ সালে এই শহরের জনসংখ্যা ছিল ২০ লক্ষ, বর্তমানে এই শহরের লোকসংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ। কিন্ত ৩৫ বছরে শহরের আয়তন বাড়েনি। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে উন্নত যোগযোগ ব্যবস্থা, কর্মসংস্থানের সুযোগ, এই শহরের জনসংখ্যা জ্যামিতিক আকারে বাড়ছে। বর্ধিত জনসংখ্যা ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে হারিঁয়ে যাচ্ছে  প্রকৃতির আশীর্বাদখ্যাত চট্টগ্রাম শহরের সৌন্দর্য। এছাড়া বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিগত প্রায় কয়েক দশক ধরেই এই নগর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি,  জোয়ার-ভাটা, পাহাড় ধসসহ বিভিন্ন দুর্যোগে আক্রান্ত হচ্ছে নিয়মিত। চট্টগ্রামে গত দুই দশকে যে সমস্যাটি নগরবাসীকে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে ফেলেছে সেটি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। প্রতি বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির সময় নগরের অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। নগরের জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ শহরের বর্জ্যগুলো খাল-নালায় গিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি। জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরে  প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার চারটি প্রকল্প চলমান। নগরবাসীর মতে, উপরোক্ত প্রকল্পের মধ্যে আন্ত:সমন্বয়ের অভাব রয়েছে, বিশেষ করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নতিকরণের কোন সম্পূরক প্রকল্প না থাকা। ফলে নগরবাসী আশংকা করছে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নতি না করলে জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প ভেস্তে যেতে পারে। সামনের বর্ষা মৌসুমের আগেই এই বিষয়ে নিয়ে ভাবতে হবে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মতে, একজন নাগরিক প্রতিদিন গড়ে ৬০০ গ্রাম (বিশ্বব্যাংকের মতে, ৭৪০ গ্রাম) বর্জ্য উৎপাদন করে। সে হিসেবে, ৭০ লাখ লোক চট্টগ্রাম নগরে প্রতিদিন ৪২০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন করে। বছরে উৎপন্ন হয় ১৫ লক্ষ ৩৩ হাজার টন বর্জ্য। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৯ লাখ ১৩ হাজার টন বর্জ্য সংগ্রহ করেছে। তাহলে বাকি, ৬ লক্ষ ২০ হাজার টন বর্জ্য খাল-নালা, নদীতে ও পরিবেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই অসংগ্রহীত বা ব্যবস্থাপনার বাহিরের বর্জ্য নগরের জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ। এই অব্যবস্থাপনাকৃত বর্জ্য সংগ্রহে বা ব্যবস্হাপনায় আনতে কোন উদ্যোগ বা প্রকল্প নগরবাসীর জানা নেই। তাই জনমনে শংকা দেখা দিয়েছে, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সফলতা ও কার্যকারিতা নিয়ে। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পগুলোর কৌশলহলো চট্টগ্রাম শহরের খাল-নালা, নর্দমাগুলোর পরিস্কার, সংস্কার, পুনঃখনন, সম্প্রসারণ ইত্যাদি। সরেজমিনে দেখা গেছে, খালগুলোর পরিস্কারের সাথে সাথে সেগুলো আবার বর্জ্যে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নগরের অনেক জায়গায় বাসা-বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা বর্জ্য ডাম্প করা হয় খালের পাড়ে। উম্মুক্ত জায়গায় রাখা এইসব বর্জ্য পরিবেশ দূষণ করছে ও একসময় খালে পড়ে খাল ভরাট করছে। যার ফলে খালের পানি চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। নগরের উৎপাদিত বর্জ্য সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা না আনতে পারলে, প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও নগরের জলাবদ্ধতার তেমন কোন পরিবর্তন আসবে না।

চট্টগ্রাম শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নীতিগত দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের। শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতিতে কাজ করছে সিটি করপোরেশন। উৎস হতে বর্জ্য সংগ্রহের জন্য সিটি করপোরেশন ২০১৬ সাল থেকে “ডোর টু ডোর কর্মসূচীর” মাধ্যমে ১৯৯৫ সেবক এই কর্মসূচীতে নিয়োজিত করেছে। তাছাড়া, ড্রেন ক্লিনার, রাস্তার ঝাড়ুদার, বর্জ্য লোডিং এবং আনলোডিং শ্রমিক, স্প্রে ম্যান, ভ্যান চালক ও ওজন কর্মীসহ সব মিলিয়ে ৩৬৫৫ শ্রমিক বর্জ্য সংগ্রহে নিয়োজিত রয়েছে। তারা প্রাথমিক উৎস পয়েন্ট (বাসাবাড়ি) থেকে বর্জ্য সংগ্রহ (রিকশা, ভ্যান, টমটম মাধ্যমে) করে সেকন্ডারী পয়েন্ট (ডাস্টবিন, কন্টেইনার, এসটিএস) রেখে আসে, সেখান থেকে সিটি করপোরেশনের গাড়ি (ডাম্প ট্রাক, কম্পেকটর) করে এইসব বর্জ্য ল্যান্ডফিলে চুড়ান্তভাবে নিস্কাশন করা হয়। ৭০ লক্ষ নগরবাসীর সৃষ্ট বর্জ্য মাত্র ১৯৯৫ সেবক দিয়ে সংগ্রহ করা রীতিমত চ্যালেঞ্জ, তাই অনেকক্ষেত্রে সঠিক, পরিপূর্ণ নিয়মিতভাবে বর্জ্য সংগ্রহ ব্যহত হচ্ছে। প্রাথমিক উৎস থেকে বর্জ্য সংগ্রহের বিষয়টি প্রাইভেট সেক্টর বা কমিউনিটি ভিত্তিক সংগ্রহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে সাশ্রয়ী, ফলপ্রসু ও কার্যকর হবে। সেকেন্ডারী পয়েন্ট থেকে ল্যান্ডফিলে চুড়ান্তভাবে নিস্কাশন বিষয়টি সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে। সেক্ষেত্রে, সেকেন্ডারী কালেকশন পয়েন্ট, সেকেন্ডারি ট্রান্সপার স্টেশন এর আধুনিকায়ন করতে হবে। এবং সেকেন্ডারী কালেকশন পয়েন্ট, সেকেন্ডারি ট্রান্সপার স্টেশন হতে বর্জ্য চুড়ান্তভাবে নিস্কাশনের জন্য ব্যবহ্রত পরিবহন মাধ্যমগুলোর পর্যাপ্ততা ও আধুনিকায়ন নিশ্চিত করতে হবে। চট্টগ্রাম শহরে যে দুটি ল্যান্ডফিল (আরেফিন নগর ও আনন্দ বাজার) রয়েছে সেগুলোর আধুনিকায়ন করতে হবে সেনিটারি ল্যান্ডফিল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে নতুন আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব ল্যান্ডফিল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহার করতে হবে। চট্টগ্রাম সিটির উৎপাদিত বর্জ্যের ৬৩শতাংশ হল খাদ্যের উচ্ছিষ্টাংশ বা খাদ্যবর্জ্য, ১০ শতাংশ হল কাগজ জাতীয় বর্জ্য, ৯ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য, কৃষিজ বর্জ্য ৭ শতাংশ, বাকিগুলো অন্যান্য বর্জ্য। শহরের উৎপাদিত ৮০-৯০ শতাংশ বর্জ্যই পুনর্ব্যবহারযোগ্য। পরিসংখ্যানে দেখা যায় চট্টগ্রামে বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের হার মাত্র ৮-১০%। এই বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করতে পারি। যার ফলে, অর্থনৈতিকভাবে লাভবান, কার্বন নিঃসরণ কমানো ও দূষণের হাত থেকে পরিবেশকে রক্ষা করতে পারি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বৃত্তাকার অর্থনৈতিক মডেল চালু করতে হবে।  বৃত্তাকার অর্থনৈতিক মডেলে উৎপাদন ও ভোগের মধ্য সমন্বয় সাধন করে। এটি পণ্যের সম্ভব অতিরিক্ত মূল্য নিশ্চিত করে এবং পণ্যের জীবনচক্রকে প্রসারিত করে। 

চট্টগ্রাম শহরে উৎপাদিত বর্জ্যকে, পুনর্ব্যবহারকরণের পথে অন্যতম বাধাঁ হলো উৎসে বর্জ্য পৃথকীকরণ না হওয়া। বর্জ্য উৎসে পৃথকীকরণ না হলে সেটাকে প্রসেস করা সময় ও ব্যয় সাপেক্ষ। সেক্ষেত্রে, নগরবাসীকে উৎসে বর্জ্য পৃথকীকরণের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পচঁনশীল, অপচঁনশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য আলাদা করে রাখার অভ্যাগ গড়ে তুলতে হবে। বর্জ্য সংগ্রহে কালার কোডেড বিন ব্যবহারকে প্রচার এবং নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে, ‍মিক্সড বর্জ্য থেকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য আলাদাকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য সংগ্রহের জন্য বর্জ্য সংগ্রহকারীদের  প্রশিক্ষণ ও অনুদান প্রদান করতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ভ্যালু চেইন নির্ণয় করে, সেখানকার ইনসেনটিভ ও ইন্টারেস্টকে অবহিত করে এক্টরদেরকের কানেকটেড করতে হবে। উৎপাদনকারীকে ভোক্তা পর্যায়ে সৃষ্ট বর্জ্য সংগ্রহ বা ব্যবস্থাপনায় কাজ করতে হবে।

জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মধ্যে নিয়মিত সমন্বয় ও সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে ওয়াসা, চট্টগ্রাম বন্দর, বেসরকারী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অর্ন্তভূক্ত করা যেতে পারে।

সর্বোপরি, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের পঞ্চম তফসিলে বর্জ্য ফেলে খাল-নালা ভরাটকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। অপরাধ দন্ডের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সিটি করপোরেশনকে। আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে, যত্রতত্র ময়লা ফেলা বন্ধে জরিমানা ও কঠোর শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে হবে। তবেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নতি হবে। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের সুফল পাবে নগরবাসী।