অধিকার একটি বৈধ দাবী, যা দেশের শাসনসতন্ত্র, নীতিমালা, আর্ন্তজাতিক চুক্তি ও সংবিধান দ্বারা সংরক্ষিত। স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক মানবাধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম। স্বাস্থ্য সর্বজনীনভাবে মানব উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসাবে ও স্বীকৃত।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব এবং অনুচ্ছেদ ১৮ (১) অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যের উন্নতি করা, রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্তব্য বলা হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলমা-আতা ঘোষণা, জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ২৫ (১), শিশু অধিকার সনদ, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণের কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী দেশ। এই সমস্ত আন্তর্জাতিক সনদে স্বাস্থ্যকে একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বর্তমান সরকার নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০০০ মূল্যায়ন করেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পরিমার্জন ও সম্প্রসারণ করে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১ চূড়ান্ত করেছে। স্বাস্থ্য যখন মানুষেরর মৌলিক মানবাধিকার, তখন রাষ্ট্রকে অবশ্যই চারটি মূল উপাদান বিবেচনা করে স্বাস্থ্য নীতি ও সেবা নিশ্চিত করতে হয় যেমন;
পর্যাপ্ততাঃ স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলির প্রাপ্যতার জন্য একটি দেশ তার অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে তার জনগোষ্ঠির জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার সুবিধাগুলি নিশ্চিত করবে।
প্রবেশগম্যতাঃ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সবার কাছে সহজলভ্য ও প্রবেশগম্য করা। স্বাস্থ্য সেবায় প্রবেশগম্যতার ক্ষেত্রে চারটি বিষয় বিবেচনা করতে হয় যেমন; বৈষম্যহীনতা, শারীরিক প্রবেশগম্যতা, অর্থনৈতিক প্রবেশগম্যতা (সাধ্যের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা), স্বাস্থ্য তথ্যের প্রবেশগম্যতা।
গ্রহণযোগ্যতাঃ স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলি নৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে উপযুক্ত হতে হয়।
গুণগতমানঃ স্বাস্থ্য পরিষেবা অবশ্যই বৈজ্ঞানিক এবং চিকিৎসাগতভাবে অনুমোদিত হতে হয়। গুণগতমান হল ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজের একটি মূল উপাদান । মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলোকে মানতে হয় যেমন; নিরাপদ, কার্যকরী, জন-কেন্দ্রিক, সময়মত, ন্যায়সঙ্গত, ইন্টিগ্রেটেড , দক্ষ।
উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করে, বাংলাদেশের জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি নির্ণয় করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১ এর লক্ষ্য হলোঃ সকলের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং জরুরি স্বাস্থ্য সেবার প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা; সাম্যতার ভিত্তিতে সকলের জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য-সেবা নিশ্চিত করা ও সেবার পরিধি প্রসারিত করা; অধিকার এবং মর্যাদা বিবেচনা করে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা বাড়ান। জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি-২০১১ এর প্রাধান্য বিষয়গুলো হলো; সমাজের সকল স্তরে স্বাস্থ্যসেবাকে একটি অধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা, জনস্বাস্থ্যের ও পুষ্টির উন্নতির উপাদানগুলি নিশ্চিত করা, শহর ও গ্রাম নির্বিশেষে সবার জন্য মানসম্পন্ন এবং সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, প্রতি ৬০০০ জনসংখ্যার জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা, জরুরী স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি করা; মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা; মা ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিশ্চিত করা এবং প্রতিটি গ্রামে নিরাপদ প্রসবের পরিষেবা নিশ্চিত করা; পরিবার পরিকল্পনা পরিষেবাগুলির সহজলভ্যতা এবং প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা, বিশেষ করে দরিদ্র এবং নিম্ন আয়ের মানুষদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া; স্বাস্থ্য সেবায় লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করা; স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় তথ্য প্রযুক্তির কার্যকর ও দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা; মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য সরকারি স্বাস্থ্যসেবার সুবিধাগুলিতে পর্যাপ্ত রসদ ও জনবলের সরবরাহ নিশ্চিত করা; বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি এবং চিকিৎসা খরচ নিয়ন্ত্রণ; দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা শিক্ষা ও প্রযুক্তির আধুনিকায়ন ও অভিযোজন নিশ্চিত করা; সরকার এবং এনজিওগুলির মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করা; প্রতিরোধমূলক পরিষেবাগুলিকে শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে টিকাদান কর্মসূচি উন্নতি করা; স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত তথ্যের অবাধ প্রবেশগম্যতা; ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করে প্রয়োজনীয় ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা; স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলির ট্র্যাকিং করা; এবং সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যসেবা (ইউনানি, আয়ুর্বেদ এবং হোমিওপ্যাথিক) শিক্ষা এবং ব্যবস্থার উন্নতি নিশ্চিত করা।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে, ৯০টি আইন স্বাস্থ্য বা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। এই আইনগুলোকে রিভিউ করলে দেখা যায় সমস্ত বিষয়াদি সাতটি বিস্তৃত বিষয়ের অধীনে পড়ে যেমন; গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধন এবং কল্যাণ আইন, জনস্বাস্থ্য, সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য অনুশীলন, পরিবেশগত স্বাস্থ্য, এবং শিশু ও মহিলাদের সুরক্ষা।
তাছাড়াও বৈশ্বিক উন্নয় লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) বিভিন্ন লক্ষ্য ও সূচকে স্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্যের কথা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে, যেমন লক্ষ্য-০৩ (সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ) সরাসরি স্বাস্থ্যসেবা ও অধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এসডিজি লক্ষ্য-০৩ এর টার্গেট ৩.১ ও ৩.২ বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে মাতৃমৃত্যুর হারের অনুপাত প্রতি লাখে ৭০ এর নিচে নামিয়ে আনা ও জীবিত ৫ বছরের শিশুর মৃত্যুর হারের অনুপাত প্রতি লাখে ২৫ এর নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। অন্যান্য এসডিজি লক্ষ্য ও সূচকেও স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্যকর জীবন নিশ্চিত করার ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়েছে যেমন; দারিদ্র্য বিলোপ (এসডিজি ১); ক্ষুধা মুক্তি (এসডিজি ২), নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন (এসডিজি ৬) নারী এবং মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা দূর কর(এসডিজি ৫.২.১) ও অসমতার হ্রাস (এসডিজি ১০)।
WHO কাউন্সিল অন দ্য ইকোনমিক্স অফ হেলথ ফর অল মতে, বিশ্বে অন্তত ১৪০ টি দেশ তাদের সংবিধানে স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবুও সে দেশগুলি তাদের জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিত করতে পারেনি এবং নিশ্চিত করার জন্য সহায়ক আইনগুলি অনুশীলন করছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০২১ সালে বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি জনগোষ্ঠি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলির কভার করা হয়নি, যদি সে সমস্ত দেশে স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে এবার ২০২৪ সালের ০৭ এপ্রিল উদযাপিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব স্থাস্থ্য দিবস, এই বছর দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো আমার স্বাস্থ্য, আমার অধিকার'। বাংলাদেশ এবছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘স্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিতে কাজ করি একসাথে’। এই বছরের থিমটি প্রত্যেকের অধিকার, সর্বত্র মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা এবং তথ্য, সেইসাথে নিরাপদ পানীয় জল, বিশুদ্ধ বায়ু, পুষ্টি, মানসম্পন্ন আবাসন, শালীন কাজ এবং পরিবেশগত অবস্থা এবং স্বাধীনতা পাওয়ার অধিকারকে বেছে নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সরকার বা পাবলিক সেক্টরের উপর অনেক বেশি নির্ভর করে, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি অনেক উদ্যেক্তা এই খাতে এগিয়ে এসেছে ও ভালো করছে। বিগত এক দশকে এই খাতের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, তবে করোনাকালীন সময়ে দেখা গেছে এই খাতের ব্যাপক উন্নয়নের চাহিদা ও বাস্তবতা। নিম্নের আলোচনায়, এই খাতের চলমান অবস্থা ও প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করা হলো, আলোচিত বিষয়গুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিক সমাধান হতে পারে, স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন ও অধিকারের বাস্তবায়ন।
সীমিত পাবলিক ফ্যাসিলিটি
স্বাস্থ্য সেবাখাতে বাংলাদেশে পাবলিক ফ্যাসিলিপির উন্নয়নের বেশ সুযোগ রয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অধীনে সারা দেশে মোট ১৮,০০০ কমিউনিটি ক্লিনিক আছে, যেখানে প্রতি ৬০০০ জনের একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক থাকার কথা রয়েছে (জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি-২০১১ )। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য সারাদেশে উপজেলা পযায়ে ৪৭২টি সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা কেন্দ্র বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে,যেখানে বাংলাদেশে মোট উপজেলার সংখ্যা ৪৯৫ টি। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পরিচর্যা কেন্দ্রগুলোতে মোট শয্যার সংখ্যা প্রায় ১৮,৮৮০ টি।সারা বাংলাদেশে ১২৬ টি সেকেন্ডারি এবং টারশিয়ারি কেয়ার সুবিধা রয়েছে। সেকেন্ডারি এবং টারশিয়ারি পাবলিক কেয়ার সুবিধাগুলিতে মোট শয্যা রয়েছে ২৭,০৫৩টি। বেসরকারি খাতে ২৯৮৩ টি নিবন্ধিত হাসপাতাল রয়েছে। এই হাসপাতালে মোট ৪৫,৪৮৫টি শয্যা রয়েছে। এই সীমিত ফ্যাসিলিটি মনে করিয়ে দেয় করোনা’র প্রারম্ভীক সময়ের ভয়াবহতা, যেমন রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত শয্যার অভাব, আইসিইউ অভাব ইত্যাদি।
সারাংশে, দেখা যায়, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতোলে প্রতি ১০০০ জনসংখ্যার জন্য ০.৩২ শয্যা বরাদ্দ রয়েছে; যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশে বলা হয়েছে, সরকারী হাসপাতালে প্রতি ১০০০ জনসংখ্যার জন্য ৩.৫ শয্যার ব্যবস্থা রাখা।
ভারসাম্যহীন স্বাস্থ্য সেবা ও অধিক চিকিৎসা খরছ
সরকারি হাসপাতালে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি অন্যান্য সুবিধাগুলি বিনামূল্যে হওয়ার কথা থাকলেও, রোগীদের ওষুধ এবং ল্যাবরেটরি পরীক্ষার খরচ নিজে বহন করতে হয়, সেইসাথে কিছু অতিরিক্ত অপ্রদর্শিত খরচও বহন করতে হয়। এই খরচগুলি গরীব এবং সুবিধাবঞ্চিতদের গুনগত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে গুরুতরভাবে বাধা সৃষ্টি করছে। অনেক ক্ষেত্রে গুরুতর রোগীরা অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রাপ্ত থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। গবেষণায় দেখা যায়, স্বাস্থ্যসেবার খরচের প্রায় ৬৬% ব্যক্তি এবং পরিবারের দ্বারা বহন করা হয়, যা আউট অব পকেট এক্সপেন্স ,যেটি রোগীকে দারিদ্রতার দুষ্ট চক্রে ফেলে দিচ্ছে।
সংক্ষেপে বলা যায়, স্বাস্থ্য সেবায় জনস্বাস্থ্য নীতি অনুশীলনের মধ্যে একটি গ্যাপ রয়েছে যা গরীব এবং সুবিধাবঞ্চিতদের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি করছে, যার ফেলে, দেশর জনগণ সাংবিধানিক অধিকার ও ন্যায্যতার আদায় হতে বঞ্চিত হচ্ছেন ।
স্বাস্থ্যসবা কেন্দ্রগুলিতে প্রয়োজনীয় উপকরনের অভাব
বেশিরভাগ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, বিশেষ করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং জেলা হাসপাতালে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য উপকরণ সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সগুলির রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বা জ্বালানির অর্থের কারণে প্রায়শই অকার্যকর হয়ে থাকা। এক্স-রে মেশিন, ইনকিউবেটর ও বিভিন্ন ল্যাবের যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকার্যকর হয়ে থাকা। বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং পরিবার পরিকল্পনার পণ্যগুলি চুরি করে বেসরকারী খাতের বিক্রি হওয়া। স্থানীয় পর্যায়ে চিকিৎসা সেবায় দক্ষ জনবলের ঘাটতি রয়েছে। যার ফলে, রোগির প্রয়োজনের সময় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা অনেকক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়াও স্থানীয় সেবা প্রদানকারীরা গুণগত সেবা প্রদানে ব্যার্থ হওয়ায়, লোকজন সামান্য চিকিৎসার প্রয়োজেনে জেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রেরমুখী হতে হয়। যার ফলে, চিকিৎসা খরছ বেড়ে যায় ও জেলা পর্যায়ের সেবা কেন্দ্রগুলোতে রোগীর ভীড় দেখা যায়। এর ফলে জেলা পর্যায়ের প্রয়োজনীয় রোগীরা চিকিৎসা সেবা পেতে বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে।
সারাংশে বলা যায়, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য উপকরণগুলো ব্যবহারের কার্যকারীতা বাড়াতে হবে, প্রয়োজনীয় বরাদ্দ ও তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। এই ক্ষেত্রে ইউনিয়ন ও উপজেলা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সেবার মান বাড়াতে হবে ও লোকজনকে ছোটখাট স্বাস্থ্য সেবার জন্য শহরমুখির প্রবণতা থামাতে হবে।
জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের অপ্রতুলতা
প্রয়োজনীয় আর্থিক সম্পদের অভাব বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। বর্তমান স্বাস্থ্যসেবা বাজেট বরাদ্দ ২০২৩-২০২৪ সালে ৩৮০৫২ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের ২.৬৩%। ২০১৬ সালে শ্রীলঙ্কায় স্বাস্থ্যসেবা বাজেটের বরাদ্দ ছিল জিডিপির ৩.৮৯%। এমনকি দ্বীপপুঞ্জের দেশ মালদ্বীপও বাংলাদেশের তুলনায় ১০ গুণ বেশি বরাদ্দ করে। ২০২০ সালে, বাংলাদেশে মাথাপিছু মোট স্বাস্থ্য ব্যয় মাত্র ৫১ মার্কিন ডলার। এটি চ্যাথাম হাউসের প্রস্তাবিত US$86 এর অর্ধেকেরও কম।
সারাংশে বলা যায়, স্বল্প বরাদ্দ দিয়ে ১৬ কোটি জনগোষ্ঠিকে গুনগত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান খুব কঠিন, এই খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীর ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের অভাব
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত দক্ষ মানব সম্পদের অভাব একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। বর্তমান স্বাস্থ্যকর্মীরা শুধু চিকিত্সকদের দিকে ঝুঁকছে অন্যান্য পেশায় আসতে চাচ্ছেন না। বর্তমানে ডাক্তার, নার্স এবং টেকনোলজিস্ট এর অনুপাত হল ১:০.৪:০.২৪ যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশে বলা হয়েছে, ডাক্তার-নার্স-টেকনোলজিস্ট অনুপাত হবে ১:৩:৫। উল্লেখ্য বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি ১৮৪৭ জনের জন্য মাত্র একজন চিকিৎসক রয়েছেন। তাছাড়াও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে গবেষণার ঘাটতি ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অভাব রয়েছে।
সারাংশে বলা যায়, স্বাস্থ্য সেবায় পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল নিয়োগ করতে হবে, এবং শুধুমাত্র ডাক্তার পেশায় মনোনিবেশ বা ঝুঁকলে হবে না, ডাক্তারের পাশাপাশি দক্ষ নার্স ও টেকনোলজিস্ট তৈরী করতে হবে। তবেই জনগণের সাংবিধানিক অধিকার আদায় হবে। এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বেশি করে গবেষণা করতে হবে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও প্রমোশনে মনোযোগী হতে হবে।
উচ্চ ঔষধ খরচ
বাংলাদেশের মানুষের উচ্চ মূল্যে ওষুধ ক্রয় করতে গিয়ে দারিদ্রতার দুষ্ট চক্রের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে আউট অব পকেট এক্সপেন্স প্রায় ৬৩ শতাংশ। ওষুধের এই উচ্চ ক্রয়মূল্য নিয়মিতভাবে বেড়ে যাচ্ছে। সারাংশে বলা যায়, প্রয়োজনীয় ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
প্রবীণ লোকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের জন্য বিশেষ কোন নীতিমালা নেই ও বরাদ্দের স্বল্পতা
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাচ্ছে, পাশাপাশি প্রবীণ জনগোষ্ঠির সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবীণ জনগোষ্ঠির স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য ও বিষয়টিকে বিবেচনায় নেবার জন্য তেমন কোন নীতিমালা নেই ও প্রয়োজনীয় বরাদ্দের স্বল্পতা রয়েছে।
চিকিৎসায় সুসংহত রেফারেল ব্যবস্থার অনুপস্থিতি
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য কোনো বাংলাদেশে তেমন কোনো রেফারেল নেটওয়ার্ক এর বিধান নেই। সরকার ও বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি ও পরিলক্ষিত। সারাংশে বলা যায়, স্বাস্থ্যসেবার মত সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের জন্য রেফারেল ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সরকারী, বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ও এনজিওদের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করতে হবে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে ক্রমবর্ধমান এবং অব্যাহত বৈষম্য
দরিদ্র এবং সুবিধাবঞ্চিতগোষ্ঠী এখনও ধনী মানুষের তুলনায় স্বাস্থ্যসেবায় কম অ্যাক্সেস রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, ধনী আয়ের গর্ভবতী মহিলারা প্রসবপূর্ব, প্রসব এবং প্রসবোত্তর সেবার জন্য ৫৩% স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা ক্লিনিকে আসেন ও বাচ্চা প্রসব করেন, অপরদিকে মাত্র 8% দরিদ্র গর্ভবতী মহিলা প্রসবপূর্ব, প্রসব এবং প্রসবোত্তর সেবার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা ক্লিনিকে আসেন। এইক্ষেত্রে প্রসবপূর্ব এবং প্রসবোত্তর যত্নের ক্ষেত্রে গুরুতর বৈষম্যরে অভিযোগ রয়েছে।
সারাংশে বলা যায়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে এই বৈষম্য কমিয়ে আনতে হলে দরিদ্র এবং সুবিধাবঞ্চিতগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা ক্লিনিকে অবাধ প্রবেশগম্যতার ক্ষেত্র তৈরী করতে হবে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অঙ্গীকারের অভাব
একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অস্থিরতা প্রায়ই সহিংসতায় পরিণত হয়। এই ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা স্বাস্থ্যসেবায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। হরতালের সময় (সরকারি ও বেসরকারী পরিবহন এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রায়ই বন্ধ থাকে) ডাক্তার এবং নার্স (পাশাপাশি অন্যরা) নিরাপত্তার অভাবে কাজে যেতে ভয় পান। রোগীরাও একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হন। এই ধরনের জাতীয় রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় খুব কম সংখ্যক ব্যক্তি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবা পেতে পারেন। সারাংশে বলা যায়, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে রাজনৈতিক কার্যক্রমের উর্ধ্বে রাখতে হবে, যাতে কোন অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা বিঘ্নিত না হয়।
দুর্বল স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা
একটি দক্ষ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার অন্যতম শর্ত হলে আপ-টু-ডেট স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত তথ্য ব্যবস্থ। WHO স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিল্ডিং ব্লক সিস্টেম এর উপর জোর দিয়েছে । শুধুমাত্র মাঠ পর্যায়ের ডাটা যথেষ্ট নয়; সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুবিধার্থে এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সেন্ট্রালী অর্গানাইজ স্বাস্থ্য ডাটা জন্য খুবই জরুরী। বছরের পর বছর ধরে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে ছোট পরিসরে জরিপ, নজরদারি এবং গবেষণা পরিচালিত হয়েছে; তবে এখনও কেন্দ্রিয়ভাবে ডাটা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাই সারাংশে বলা যায়, জনস্বাস্থ্যের প্রবণতা নির্ণয়, আগাম ধারনা লাভ ও কার্যক্রর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা দাড় করাতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি নির্ণয়
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে নানারকম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের মানুষ, যা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন চিন্তার খোরাক। শ্বাসকষ্ট, হীটস্ট্রোক বা গরমজনিত মৃত্যু কিংবা তীব্র ঠান্ডাজনিত মৃত্যু ইত্যাদি এখন খুব সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বখ্যাত স্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য-প্রভাব নিয়ে করা তাদের গবেষণা রিপোর্টে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে যেসব রোগের প্রকোপ দেখা দিতে পারে, সে সম্বন্ধে উল্লেখ করেছে: সংক্রমণ ও কীটপতঙ্গবাহিত রোগের ধরনে পরিবর্তন আসবে; তাপপ্রবাহে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে; জলোচ্ছাস, ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়ে সরাসরি জখমের সংখ্যাও বাড়বে। তা ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে শারীরিকভাবে আহত হোন শিশু, মহিলা ও বৃদ্ধগণ। এছাড়া বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে শিশুরা মানসিকভাবেও হয়ে পড়ে পর্যুদস্ত। বিপুল মানুষ নিজস্ব আবাস ছেড়ে উদ্বাস্তুর জীবনে পদার্পণ করায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে গর্ভবতি মায়েদের জীবনে। তারা পাননা ন্যূনতম স্বাস্থ্য-সুবিধা, ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সন্তান জন্ম দেওয়া, লালন-পালনের কারণে অনায়াসেই সন্তানের শরীরে জায়গা করে নেয় নানা রোগব্যাধী। এছাড়া উদ্বাস্তু জীবনে বয়ঃসন্ধিকালে, কিশোর-কিশোরীরা পায়না উপযুক্ত ন্যূনতম পরিবেশ। কম বৃষ্টিপাতের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার সমস্যা দিনে দিনে আরো প্রকট হয়ে দাড়িয়েছে। বরিশাল ও পটুয়াখালীতে লবণাক্ততার পরিমাণ ২ পিপিটি (লবণাক্ততা পরিমাপক মাত্রা) থেকে বেড়ে ৭ পিপিটি হয়ে গেছে (প্রেক্ষিত ২০০৯)। চট্টগ্রাম শহর সন্নিকটের হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে ৮ পিপিটি হয়ে গেছে (২০০৯)। ক্রমাগত লবণাক্ত পানি পান ও ব্যবহারের ফলে মহিলাদের গর্ভধারনে দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন জটিলতা। তাই সারাংশে বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকিগুলা নির্ণয় করে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
স্বাস্থ্য এবং মানবাধিকারের মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে যেটি দেশের সংবিধান ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংবিধানেও এনটাইটেল করা হয়েছে। স্বাস্থ্য হল সম্পূর্ণ শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতার একটি অবস্থা এবং শুধুমাত্র রোগ বা দুর্বলতার অনুপস্থিতি নয়। জাতি, ধর্ম, রাজনৈতিক বিশ্বাস, অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রতিটি মানুষ কোন পার্থক্য ছাড়াই রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বাস্থ্য সেবা উপভোগ করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংবিধানের পাশাপাশি, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি (ICESCR) স্বাস্থ্যের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই আমাদের উচিত, স্বাস্থ্য এবং মানবাধিকারের মধ্যে লিঙ্কগুলো খুঁজে বের করে তা সমন্বয় করা ও মানবাধিকারকে সমুন্নত রাখা। স্বাস্থ্যসেবা ও মানবাধিকারের উন্নয়নের জন্য সরকার, এনজিও এবং সুশীল সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।