শনিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০২৫

নিরাপদ ফুটপাত চাই , হাঁটতে চাই, হাঁটা নগরবাসীর অধিকার

শরীরচর্চার সবচেয়ে সহজ উপায়টি হলো হাঁটাহাঁটি করা। আমরা সবাই কমবেশি হাঁটি। কারণে-অকারণে হাঁটি। কিছু মানুষ আছেন, যারা নিয়ম করে প্রতিদিনই হাঁটেন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাঁটার অনেক উপকারিতা আছে। এর ফলে পেশী সুগঠিত হয়, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুরক্ষিত থাকে ও মেরামত হয়, হজমে সাহায্য করে এবং মস্তিষ্ককেও সতেজ রেখে বার্ধক্য প্রতিরোধ করে। হাঁটার ফলে মানুষের চিন্তার সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়, মেজাজ বা মুড ভালো থাকে, মানসিক চাপ কমে। দ্রুত নগরায়ণ ও যান্ত্রিক নির্ভরতার কারণে হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস কমে গেছে বা নগরের হাঁটাহাঁটি করা সহায়ক পরিবেশ নেই। নগরের হাঁটাহাঁটি করার পরিবেশ ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে।

হাজার বছরের ইতিহাস আর ঐতিহ্য বুকে নিয়ে জেগে আছে চট্টগ্রাম। পাহাড়, নদী আর সাগরের সম্মিলনে এই নগরী বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য মানুষের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। নগরে বিপুলসংখ্যক মানুষের বাস। কিন্তু নগরবাসীর নিরাপদে হাঁটার ব্যবস্থা নগরীতে তেমন নেই, যা ছিল তাও ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে। গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরে সড়কের তুলনায় ৭গুণ বেশি যানবাহন চলাচল করে। যে কারণে শহরে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। দিনে দিনে বাড়ছে ট্রাফিক জ্যাম। নগরবাসী ট্রাফিক জ্যামের ভয়ে অল্প দূরত্বে গন্তব্য হলে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে শ্রমজীবী, পোশাককর্মী সব সময় হেঁটে তাঁদের কর্মস্থলে যান। চসিকের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরে সড়ক আছে ১ হাজার ৪৪২ কিলোমিটার। বিপরীতে ফুটপাত আছে মাত্র ২৮১ কিলোমিটার; যা মোট সড়কের মাত্র ১৯ শতাংশ। এর মধ্যে অধিকাংশ অবৈধ দখলে। কেউ রাজনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে ফুটপাতের ওপর দোকান তৈরি করে ভাড়া দিচ্ছেন। কেউ কেউ ভ্রাম্যমাণ জুতার দোকান, ডাবের দোকান, শরবতের দোকান, চুড়ির দোকান, বইয়ের দোকান দিয়ে ফুটপাত চলাচলের অনুপযোগী করে ফেলেছেন। এমন অবস্থায় জনগন রাস্তা দিয়ে চলাচলের সময় মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।

ব্লমবার্গ ফিলানথ্রপিস ইনিশিয়েটিভ ফর গ্লোবাল রোড সেফটি (বিআইজিআরএস) এর মতে, ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫৬৯ জন। এর মধ্যে পথচারীর সংখ্যা ৩১৩, অর্থাৎ ৫৫ শতাংশ। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে সড়কে পথচারী মৃত্যুর হার বেড়েছে ৬০ শতাংশ। চট্টগ্রামে এই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হবার অন্যতম কারণ হল শহরে পথচারীরা নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত ফুটপাত নেই; যা আছে তার মধ্যে কিছু অবৈধ দখলে, কিছু ভাঙাচোরা। তাছাড়া যেখানে দখলমুক্ত ফুটপাত আছে, সেখানেও অসমতল ও ধারাবাহিকতা নেই। বাধ্য হয়ে সড়ক দিয়ে যাতায়াত করেন পথচারীরা, যার ফলে সহজেই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। গবেষকরা বলছেন, চট্টগ্রাম নগরের ২০টি মোড় ও ১০টি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে সিটি গেট, আউটার রিংরোডের খেজুরতলা, বারিক বিল্ডিং মোড়, সিঅ্যান্ডবি ও কালামিয়া বাজার মোড় সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। ৩ বছরে এ মোড়গুলোতে ২৯ জন নিহত হয়েছেন। রুটগুলোর মধ্যে সব চেয়ে বিপজ্জনক বহদ্দারহাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত সড়ক। এই পাঁচ কিলোমিটার সড়কে ২৪ জন নিহত হয়েছেন। তাছাড়াও এই নগরে ভারী যানবাহন চাপায় পথচারী নিহত হবার ঘটনাও ঘটছে। বন্দর নগরী হবার কারণে, এই শহরে পণ্যবাহী ভারী যানবাহন চলাচল করে। অনেকক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রীত গাড়ি চলাচলের কারণে দুর্ঘটনায় পথচারীরা গাড়ির চাপা পড়ে মারা যান। ড্রেনে পড়ে পথচারী ও কলেজ ছাত্রীর মৃত্যুরমত ঘটনাও এই শহরে ঘটেছে। নগরের রাস্তায় হাঁটার মতো পরিবেশে যে ধরনের অবকাঠামো দরকার, তা এই শহরে অনুপস্থিত।  

যানজট যেন চট্টগ্রাম শহরের নিত্তমৈত্রিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে । অক্সিজেন মোড় থেকে পতেঙ্গা কাঠগড় বাজার এবং কর্নেলহাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত পুরো নগরীতেই সড়কে চলছে চরম বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য। নিউমার্কেট মোড়, জুবিলী রোড, রিয়াজউদ্দিন বাজার, জহুর হকার্স মার্কেট, তামাকমুণ্ডি লেন, শাহ আমানত সিটি করপোরেশন মার্কেট, গোলাম রসুল মার্কেট, চকবাজার, ষোলশহর, অক্সিজেনসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক এলাকার অবস্থা আরো ভয়াবহ। এসব এলাকায় ফুটপাত হকারদের দখলে থাকায় যানবাহন থেকে যাত্রী ও মালামাল ওঠানামা হয়ে থাকে সড়কে। আবার অনেক সড়কে যানবাহন রাখা হয় এলোপাতাড়িভাবে। এর পাশাপাশি শহর জুড়ে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলমান থাকায় সড়ক সংকীর্ণ হয়ে গেছে। নগরীতে পর্যাপ্তসংখ্যক বৈধ বাস ও ট্রাক টার্মিনালের অভাবে শহরের তিনটি প্রবেশমুখে গড়ে উঠেছে অবৈধ টার্মিনাল। সেসব স্থানে যত্রতত্র বাস, অটোরিকশা ও প্রাইভেট কার পার্কিং করে রাখা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর ও ইপিজেডমুখী সবগুলো সড়কেই রয়েছে অসহনীয় যানজট। নগরীতে পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা ছাড়াই একের পর এক গড়ে উঠছে নতুন নতুন মার্কেট ও হাসপাতাল। মার্কেটে আসা ক্রেতা-বিক্রেতারা রাস্তার ওপর গাড়ি রাখেন। মার্কেটের দোকানপাটের মালামাল রাস্তায় ওঠানামা করানো হচ্ছে। এছাড়া নিউমার্কেট এলাকার আশপাশে পুরো এলাকা জুড়েই ফুটপাত ও রাস্তার প্রায় অর্ধেক অংশ হকারদের দখলে। ফুটপাত বেদখল থাকায় মানুষ রাস্তা দিয়ে হাঁটে। এতে যানজট আরো তীব্র হচ্ছে। নগরীর বায়েজীদ থেকে ষোলশহর হয়ে চকবাজার পর্যন্ত সড়কটিতেও সব সময় যানজট থাকে। এসব এলাকায় বেশ কয়েকটি শিল্পকারখানার পাশাপাশি অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক এলাকা রয়েছে। যানজটের কারণে এসব এলাকার বাসিন্দাদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়।

এদিকে, নগরীতে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় চলমান কাজের বিভিন্ন সরঞ্জাম ও খাল থেকে তোলা মাটি রাস্তার উপরেই স্তূপ করে রাখার কারণে রাস্তা সরু হয়ে পড়ায় যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। তার মধ্যে একটি হলো বন্দর ব্যবহারকারী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান পার্কিংয়ের জন্য কোনো টার্মিনাল নেই। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পণ্যবাহী যানবাহনগুলো বাধ্য হয়ে সড়কের এক পাশে পার্কিং করে রাখতে হচ্ছে। চট্টগ্রামের আবাসিক এলাকাগুলোতে নেই কোন ফুটপাথ, অনেক বাসিন্দা/বাড়িওয়ালা তার বাড়ির সামনে ফুটপাথ দখল করে নিয়েছে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে বাগান করে বা গাছ লাগিয়ে। যার ফলে, আবাসিক এলাকাগুলোতেও পথচারীরর নিরাপদের হাঁটার ব্যবস্থা নেই, সেখানেও পথচারীরা প্রতি নিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।

নগরীতে পথচারীদের নিরাপদে হাঁটা ও চলাচলের উপযুক্ত স্থান ফুটপাত। প্রশস্ত ফুটপাতের কারণে যানজট বা দুর্ঘটনাও কমে অনেক। পাশাপাশি রাস্তা বা সড়কের সৌন্দর্যও বাড়ায় ফুটপাত। বাড়তি সুবিধা, নিয়মিত হাঁটার কারণে নগরবাসীর বিভিন্ন শারীরিক ও মানষিক উন্নতি। নগরের ফুটাপাতগুলো নিরাপদ ও চলাচল উপযোগীর জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে;

  • নগর পরিকল্পনায় পথচারীর স্বার্থ বিবেচনা করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে;
  • পথচারী নিরাপত্তা প্রবিধানমালা ২০২১ দ্রুত প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন;
  • পথচারীদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করে ফুটপাত নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ; 
  • সহজে ও নিরাপদে জেব্রা ক্রসিংয়ের মাধ্যমে রাস্তা পারাপারের সুযোগ সৃষ্টি;
  • রাতে পথচারীদের (বিশেষ করে নারী ও বয়স্কদের) চলাচল নিরাপদ করার লক্ষ্যে ফুটপাথ ও সড়কে আলোর ব্যবস্থা করা;
  • ফুটপাতে ছাউনি, বসার ব্যবস্থা, খাওয়ার পানি, মোবাইল চার্জ ব্যবস্থা ও গণশৌচাগার নিশ্চিতকরণ;
  • সাইন সিগন্যাল স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাহিদাকে গুরুত্ব প্রদান;
  • হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীর জন্য ফুটপাতে ঢালু পথ (র‍্যাম্প) তৈরি;
  • দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যবহার উপযোগী করে ফুটপাতে টেকটাইলস স্থাপন;
  • অবকাঠামো দিয়ে পথচারীর নিরবচ্ছিন্ন চলাচলে বাধা তৈরি না করা;
  • বিল্ডিং তৈরীর সরঞ্জমাদি বা কাঠামোগত উন্নয়নের সরঞ্জমাদি   ফুটপাতে না রাখা হয়, তার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ানো;
  • ফুটপাত ও সড়কে অবৈধ পার্কিং বন্ধ করা;
  • আবাসিক এলাকাগুলোতে ফুটপাথ নির্মাণ ও দখলমুক্ত করা;
  • ফুটপাতে হকারদের ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসা। সকালে উচ্ছেদের পর সন্ধ্যায় যেন আবার দখল না পড়ে সে জন্যও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। হকারদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে;
  • যেখানে পথচারী চলাচলের ঘনত্ব বেশি, সেখানে কেবল পথচারীদের জন্য সড়কব্যবস্থা চালু করা;
  • গণ-পরিবহনের সেবার মান উন্নয়ন করে, ব্যক্তিক গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে আনা;
  • নগরের বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানের সাথে কানেকটেড ফুটপাথগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া এব সেখানকার প্রতিবন্ধকতাসমূহ দুর করা;
  • হাঁটা আমার অধিকার, নগরবাসীকে এই বিষয় নিয়ে সামাজিক উদ্ধেগ গ্রহণে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাসমূহ কার্যক্রর ভূমিকা রাখা;
  • নিরাপদ ফুটপাথ এর জন্য যুবরা বিভিন্ন উদ্ধেগ গ্রহণে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয়ে কাজ করা;
  • অনিরাপদ ফুটপাথের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ পথচারীর উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান।

উৎসঃ
  1. https://www.prothomalo.com/bangladesh/capital/7jwmioh7qu
  2. https://www.tbsnews.net/bangla/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6/news-details-167698
  3. https://www.bhorerkagoj.com/accident/760075
  4. https://www.ittefaq.com.bd/118740/
  5. https://www.bhorerkagoj.com/tp-editorial/764128
  6. https://www.bhorerkagoj.com/tp-editorial/749948

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন