চট্টগ্রাম বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী ও অন্যতম বন্দর নগরী । আকার ও জনসংখ্যার দিক থেকে রাজধানী ঢাকা’র পরেই চট্টগ্রামের স্থান। পাহাড় আর সমুদ্র দিয়ে ঘেরা চট্টগ্রাম শহর। ১৯৯০ সালে এই শহরের জনসংখ্যা ছিল ২০ লক্ষ, বর্তমানে এই শহরের লোকসংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ। কিন্ত ৩৫ বছরে শহরের আয়তন বাড়েনি। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে উন্নত যোগযোগ ব্যবস্থা, কর্মসংস্থানের সুযোগ, এই শহরের জনসংখ্যা জ্যামিতিক আকারে বাড়ছে। বর্ধিত জনসংখ্যা ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে হারিঁয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির আশীর্বাদখ্যাত চট্টগ্রাম শহরের সৌন্দর্য। এছাড়া বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিগত প্রায় কয়েক দশক ধরেই এই নগর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, জোয়ার-ভাটা, পাহাড় ধসসহ বিভিন্ন দুর্যোগে আক্রান্ত হচ্ছে নিয়মিত। চট্টগ্রামে গত দুই দশকে যে সমস্যাটি নগরবাসীকে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে ফেলেছে সেটি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। প্রতি বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির সময় নগরের অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। নগরের জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ শহরের বর্জ্যগুলো খাল-নালায় গিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি। জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার চারটি প্রকল্প চলমান। নগরবাসীর মতে, উপরোক্ত প্রকল্পের মধ্যে আন্ত:সমন্বয়ের অভাব রয়েছে, বিশেষ করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নতিকরণের কোন সম্পূরক প্রকল্প না থাকা। ফলে নগরবাসী আশংকা করছে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নতি না করলে জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প ভেস্তে যেতে পারে। সামনের বর্ষা মৌসুমের আগেই এই বিষয়ে নিয়ে ভাবতে হবে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মতে, একজন নাগরিক প্রতিদিন গড়ে ৬০০ গ্রাম (বিশ্বব্যাংকের মতে, ৭৪০ গ্রাম) বর্জ্য উৎপাদন করে। সে হিসেবে, ৭০ লাখ লোক চট্টগ্রাম নগরে প্রতিদিন ৪২০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন করে। বছরে উৎপন্ন হয় ১৫ লক্ষ ৩৩ হাজার টন বর্জ্য। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৯ লাখ ১৩ হাজার টন বর্জ্য সংগ্রহ করেছে। তাহলে বাকি, ৬ লক্ষ ২০ হাজার টন বর্জ্য খাল-নালা, নদীতে ও পরিবেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই অসংগ্রহীত বা ব্যবস্থাপনার বাহিরের বর্জ্য নগরের জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ। এই অব্যবস্থাপনাকৃত বর্জ্য সংগ্রহে বা ব্যবস্হাপনায় আনতে কোন উদ্যোগ বা প্রকল্প নগরবাসীর জানা নেই। তাই জনমনে শংকা দেখা দিয়েছে, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সফলতা ও কার্যকারিতা নিয়ে। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পগুলোর কৌশলহলো চট্টগ্রাম শহরের খাল-নালা, নর্দমাগুলোর পরিস্কার, সংস্কার, পুনঃখনন, সম্প্রসারণ ইত্যাদি। সরেজমিনে দেখা গেছে, খালগুলোর পরিস্কারের সাথে সাথে সেগুলো আবার বর্জ্যে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নগরের অনেক জায়গায় বাসা-বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা বর্জ্য ডাম্প করা হয় খালের পাড়ে। উম্মুক্ত জায়গায় রাখা এইসব বর্জ্য পরিবেশ দূষণ করছে ও একসময় খালে পড়ে খাল ভরাট করছে। যার ফলে খালের পানি চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। নগরের উৎপাদিত বর্জ্য সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা না আনতে পারলে, প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও নগরের জলাবদ্ধতার তেমন কোন পরিবর্তন আসবে না।
চট্টগ্রাম শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নীতিগত দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের। শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতিতে কাজ করছে সিটি করপোরেশন। উৎস হতে বর্জ্য সংগ্রহের জন্য সিটি করপোরেশন ২০১৬ সাল থেকে “ডোর টু ডোর কর্মসূচীর” মাধ্যমে ১৯৯৫ সেবক এই কর্মসূচীতে নিয়োজিত করেছে। তাছাড়া, ড্রেন ক্লিনার, রাস্তার ঝাড়ুদার, বর্জ্য লোডিং এবং আনলোডিং শ্রমিক, স্প্রে ম্যান, ভ্যান চালক ও ওজন কর্মীসহ সব মিলিয়ে ৩৬৫৫ শ্রমিক বর্জ্য সংগ্রহে নিয়োজিত রয়েছে। তারা প্রাথমিক উৎস পয়েন্ট (বাসাবাড়ি) থেকে বর্জ্য সংগ্রহ (রিকশা, ভ্যান, টমটম মাধ্যমে) করে সেকন্ডারী পয়েন্ট (ডাস্টবিন, কন্টেইনার, এসটিএস) রেখে আসে, সেখান থেকে সিটি করপোরেশনের গাড়ি (ডাম্প ট্রাক, কম্পেকটর) করে এইসব বর্জ্য ল্যান্ডফিলে চুড়ান্তভাবে নিস্কাশন করা হয়। ৭০ লক্ষ নগরবাসীর সৃষ্ট বর্জ্য মাত্র ১৯৯৫ সেবক দিয়ে সংগ্রহ করা রীতিমত চ্যালেঞ্জ, তাই অনেকক্ষেত্রে সঠিক, পরিপূর্ণ নিয়মিতভাবে বর্জ্য সংগ্রহ ব্যহত হচ্ছে। প্রাথমিক উৎস থেকে বর্জ্য সংগ্রহের বিষয়টি প্রাইভেট সেক্টর বা কমিউনিটি ভিত্তিক সংগ্রহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে সাশ্রয়ী, ফলপ্রসু ও কার্যকর হবে। সেকেন্ডারী পয়েন্ট থেকে ল্যান্ডফিলে চুড়ান্তভাবে নিস্কাশন বিষয়টি সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে। সেক্ষেত্রে, সেকেন্ডারী কালেকশন পয়েন্ট, সেকেন্ডারি ট্রান্সপার স্টেশন এর আধুনিকায়ন করতে হবে। এবং সেকেন্ডারী কালেকশন পয়েন্ট, সেকেন্ডারি ট্রান্সপার স্টেশন হতে বর্জ্য চুড়ান্তভাবে নিস্কাশনের জন্য ব্যবহ্রত পরিবহন মাধ্যমগুলোর পর্যাপ্ততা ও আধুনিকায়ন নিশ্চিত করতে হবে। চট্টগ্রাম শহরে যে দুটি ল্যান্ডফিল (আরেফিন নগর ও আনন্দ বাজার) রয়েছে সেগুলোর আধুনিকায়ন করতে হবে সেনিটারি ল্যান্ডফিল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে নতুন আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব ল্যান্ডফিল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহার করতে হবে। চট্টগ্রাম সিটির উৎপাদিত বর্জ্যের ৬৩শতাংশ হল খাদ্যের উচ্ছিষ্টাংশ বা খাদ্যবর্জ্য, ১০ শতাংশ হল কাগজ জাতীয় বর্জ্য, ৯ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য, কৃষিজ বর্জ্য ৭ শতাংশ, বাকিগুলো অন্যান্য বর্জ্য। শহরের উৎপাদিত ৮০-৯০ শতাংশ বর্জ্যই পুনর্ব্যবহারযোগ্য। পরিসংখ্যানে দেখা যায় চট্টগ্রামে বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের হার মাত্র ৮-১০%। এই বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করতে পারি। যার ফলে, অর্থনৈতিকভাবে লাভবান, কার্বন নিঃসরণ কমানো ও দূষণের হাত থেকে পরিবেশকে রক্ষা করতে পারি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বৃত্তাকার অর্থনৈতিক মডেল চালু করতে হবে। বৃত্তাকার অর্থনৈতিক মডেলে উৎপাদন ও ভোগের মধ্য সমন্বয় সাধন করে। এটি পণ্যের সম্ভব অতিরিক্ত মূল্য নিশ্চিত করে এবং পণ্যের জীবনচক্রকে প্রসারিত করে।
চট্টগ্রাম শহরে উৎপাদিত বর্জ্যকে, পুনর্ব্যবহারকরণের পথে অন্যতম বাধাঁ হলো উৎসে বর্জ্য পৃথকীকরণ না হওয়া। বর্জ্য উৎসে পৃথকীকরণ না হলে সেটাকে প্রসেস করা সময় ও ব্যয় সাপেক্ষ। সেক্ষেত্রে, নগরবাসীকে উৎসে বর্জ্য পৃথকীকরণের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পচঁনশীল, অপচঁনশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য আলাদা করে রাখার অভ্যাগ গড়ে তুলতে হবে। বর্জ্য সংগ্রহে কালার কোডেড বিন ব্যবহারকে প্রচার এবং নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে, মিক্সড বর্জ্য থেকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য আলাদাকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য সংগ্রহের জন্য বর্জ্য সংগ্রহকারীদের প্রশিক্ষণ ও অনুদান প্রদান করতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ভ্যালু চেইন নির্ণয় করে, সেখানকার ইনসেনটিভ ও ইন্টারেস্টকে অবহিত করে এক্টরদেরকের কানেকটেড করতে হবে। উৎপাদনকারীকে ভোক্তা পর্যায়ে সৃষ্ট বর্জ্য সংগ্রহ বা ব্যবস্থাপনায় কাজ করতে হবে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মধ্যে নিয়মিত সমন্বয় ও সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে ওয়াসা, চট্টগ্রাম বন্দর, বেসরকারী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অর্ন্তভূক্ত করা যেতে পারে।
সর্বোপরি, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের পঞ্চম তফসিলে বর্জ্য ফেলে খাল-নালা ভরাটকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। অপরাধ দন্ডের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সিটি করপোরেশনকে। আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে, যত্রতত্র ময়লা ফেলা বন্ধে জরিমানা ও কঠোর শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে হবে। তবেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নতি হবে। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের সুফল পাবে নগরবাসী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন