শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

পরিবেশ, জলবায়ু ও রোগ-ব্যাধির প্রকোপ-বিস্তার আন্তসম্পর্ক বিশ্লেষণ

রোগ-ব্যাধির প্রকোপ ও বিস্তার মানব সমাজের সমস্যাগুলির মধ্যে অন্যতম। এই সমস্যার প্রকটতা ব্যাক্তি, সমাজ, অঞ্চল, রাস্ট্র ও মহাদেশ ভিত্তিক ভ্ন্নি হতে পারে। রোগ-ব্যাধির প্রকোপ ও বিস্তার ভৌগলিক পরিবেশ এবং আর্থ সামাজিক অবস্থা, জলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে তা প্রথম বলেছিলেন হিপ্পোক্রেটস (৪৬০-৩৭০ খ্রী.)। তিনি বলেছিলেন যে "বায়ু, জল, স্থান" সবই মানুষের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। তিনি বলেছিলেন, একজন চিকিৎসকের রোগের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করে রোগীর চিকিৎসা করা। যেমন- রোগীর প্রতিদিনকার জীবনযাত্রা, তার পিতা-মাতাদের রোগের ইতিহাস, তার কাজকর্ম, কোন পরিবেশে সে বসবাস করে। এই সব তথ্যের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখেই রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা নির্ধারণ করা।
রোগ-ব্যাধির প্রকোপ ও বিস্তার যে, ভৌগলিক পরিবেশদ্বারা প্রভাবিত হয় তার একটি অন্যতম উদাহরণ হল ১৮৫৪ সালে লন্ডনের ব্রড স্ট্রিটে কলেরার প্রকোপের কারণ নির্ণয়ের মাধ্যমে। তখন লন্ডনের ব্রড স্ট্রিটে মৃত্যুর পরিমাণ বেড়ে যায় এবং লোকেরা আশঙ্কা করেছিল যে তারা মাটি থেকে উঠা বাষ্পের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। জন স্নো কলেরাতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের বাড়িঘর এবং জল পাম্পগুলির অবস্থান চিত্রিত করে একটি মানচিত্র আঁকেন। তিনি দেখতে পান যে ব্রড স্ট্রিটের পাম্পকে কেন্দ্র করে কাছাকাছি দূরত্বে থাকা বাড়িগুলোতেই কলেরায় মৃতদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। পাম্প থেকে যতদূরে বাড়ির অবস্থান, মৃতের হার তত কম। তিনি উপসংহারে পৌঁছেলেন যে এই পাম্পের দূষিত পানিই রোগাক্রান্ত ক্ষেত্রে দায়ী। তিনি কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিলেন যেন পাম্পটির হাতল সরিয়ে ফেলতে। ফলস্বরূপ, নতুন কলেরা আক্রান্তের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে। 

পৃথিবীর ভৌগলিক পরিবেশ ও জলবায়ু স্থান অঞ্চলভেদে ভিন্ন। এটি লক্ষ্য করা গেছে যে বেশিরভাগ রোগ-ব্যাধি নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চল, নির্দিষ্ট পরিবেশ ও জলবায়ুর সাথে সম্পর্কিত। প্রাণী এবং গাছপালা বিস্তরণ জলবায়ু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলগুলি উষ্ণ এবং আর্দ্র, তাই সেখানে বিভিন্ন বৈচিত্রজাতের উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণী রয়েছে। রোগের বিকাশের জন্য এটিও প্রধান শর্ত। যদি আমরা শীতল অঞ্চলে চলে যাই (উচ্চ অক্ষাংশ এবং উচ্চতর উচ্চতায়) বন্যপ্রাণীর বৈচিত্রতা কম, রোগের বিস্তার ও সেখানে কম। রোগের বিস্তার উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে বিভিন্ন পোকামাকড়/ অনুজীবদের অবস্থান ও তার প্রজনন করার অনুকূল পরিবেশর উপর। এই সমস্ত পোকামাকড় মানুষের রোগের প্রধান বাহক। তাছাড়াও ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও অনুজীবদের প্যাটান পরিবর্তন ও প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলেও রোগের বিস্তার ঘটছে। যেমনঃ ম্যালেরিয়, ডেঙ্গু, কোভিড-১৯, যক্ষ্মা, এইচআইভি/এইডস এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা।
ম্যালেরিয়াঃ ম্যালেরিয়া মশা দ্বারা সৃষ্ট একটি সংক্রামক রোগ। ম্যালেরিয়ার বিস্তার তার বাহক প্লাজমোডিয়াম জীবাণু বহনকারী মশার ভৌগলিক পরিবেশে উপর নির্ভর করে। ম্যালেরিয়ার জীবানু বহনকারী মশার (অ্যানোফিলিস) জীবনকাল নির্ভর করে জলবায়ুর উপাদানের উপর যেমন তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাত। সাধারণত গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলে অ্যানোফিলিস মশা বেঁচে থাকতে পারে এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করতে পারে। রেকর্ড সংখ্যক ম্যালিরিয়া জীবাণু বহনকারী মশা অ্যানোফিলিস এর বিস্তরণ দেখা যায় আফ্রিকা, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ওশেনিয়ায়। এই সমম্ত এলাকায় ১০০ টিরও বেশি দেশের অবস্থান যেখানে প্রায় ৩.৩ বিলিয়ন মানুষের বসবাস। বিপরীতে উচ্চ উচ্চতা ও ঠান্ডা অঞ্চলে ম্যালিরিয়ার প্রকোপ দেখা যায় না।
ডেঙ্গুঃ ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা সংঘটিত জ্বর। এটি এডিস ইজিপ্টাই ধরণের মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এই মশা সাধারণত বিষুব রেখার ৩৫০ উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশে এবং ১০০০ মিটার উচ্চতায় বাস করে। ডেঙ্গু মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ওশেনিয়ার গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলে দেখা যায়। বাংলাদেশে ও এর প্রকোপ খুব বেশি, সাধারণত বৃষ্টিপাতের সাথে এর সম্পর্কযুক্ত। বিপরীতে, সাধারণত উচ্চ উচ্চতায় ও ঠান্ডা ঋতু সময় এর প্রভাব দেখা যায় না। 

ইতিকথাঃ পরিবেশ, জলবায়ু, মানব রোগ-ব্যাধির প্রকোপ ও বিস্তার আন্তসম্পর্কযুক্ত। পাশাপাশি বিশ্বায়ন, প্রযুক্তির উন্নয়ন, ও মানুষের মোবিলিটি বিভিন্ন রোগের বিস্তারে ভূমিকা রাখছে ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে বাড়িয়ে দিচ্ছে। রোগ-ব্যাধির প্রকোপ ও বিস্তার রুধে পাবলিক হেলথ বিশেজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা এই সমস্ত বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে ও করনীয় দিক নির্ধারণ করতে হবে। 


রেফারেন্সঃ 
Park, K. (n.d.). Park’s textbook of preventive and social medicine.
https://ourworldindata.org/malaria 
https://www.who.int/data/gho/data/themes/malaria 
https://roar.media/bangla/main/history/john-snow-and-his-cholera-map 
https://bn.wikipedia.org/wiki/স্বাস্থ্য-ভূগোল

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন