শুক্রবার, ১৬ জুন, ২০১৭

পাহাড়ধস জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব

সাধারণত জলবায়ু পরিবর্তন বলতে বুঝায় জলবায়ু নিয়ন্ত্রক নিয়ামক সমূহের অস্বাভাবিক আচরণকে। যেমন অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বায়ু-প্রবাহ, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ইত্যাদির ফলে, মরুকরণ, সুপেয় পানির অভাব, মাটির লবণাত্ততা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি (ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস, জলাবদ্ধতা, টর্নেডো, নদী ভাঙ্গন, পাহাড়ধস, ভূমিকম্প, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, বর্জপ্রাত), প্রাকৃতিক সম্পদ হ্রাস, খাদ্য সংকট, স্বাস্থ্য ঝুকিঁ ও সামাজিক অবক্ষয় প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। জলবায়ু পরিবর্তন এর কারণ হিসেবে দুটি কারণকে মূলত দায়ী করা হয় (১) প্রাকৃতিক কারণ (২) মানব সৃষ্ট কারণ। তবে একথা নিশ্চিত যে, জলবায়ু পরিবর্তন এর জন্য দুটি কারণই দায়ী। জলবায়ু পরিবর্তন একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রাকৃতিক ঘটনা তার প্রমাণ আমরা জিওলজিক্যাল টাইম স্কেল থেকে জানতে পারি। তবে এই নিয়মতান্ত্রিক প্রাকৃতিক ঘটনাকে ত্বরান্বিত করছে মানব সৃষ্ট কারনগুলো (দ্রুত শিল্পায়ন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, কার্বন নিঃসরন, গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরন)।

আর্ন্তজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ এর প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেস্ক অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০ টি ক্ষতিগ্রস্থ দেশের মধ্যে প্রথমেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ। বর্তমানে আরেকটি গবেষণা সংস্থার মতে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। এই সমস্ত  গবেষণার প্রমান আমরা গভীর অনুভব করছি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সম-সাময়িক বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটনার মাধ্যমে। গত এক দশকে প্রায় দশটির অধিক ছোট বড় ঘুর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হেনেছে। এবং একটির প্রভাব না কাটতে আরেকটি ঘুর্ণিঝড় আঘাত আনছে। যেমন গত মাসে আঘাত হানে প্রথম শ্রেণীর ঘুর্ণিঝড় মোরা, যার আঘাতে বাংলাদেশে দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের হাজার হাজার বাড়ি-ঘর  ধ্বংস হয় ও লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং মৃত্যু হয় দশের অধিক। এই সব ঘুর্ণিঝড়ের ক্ষত নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে বাংলাদেশের বিপুল-সংখ্যক উপকূলীয় মানুষ। ঘুর্ণিঝড় মোরার ক্ষত না পোষাতেই ঘটে গেল পাহাড়ধস যা কেড়ে নিল প্রায় দুইশত তাজা প্রাণ। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত নিম্ন চাপের প্রভাবে টানা বর্ষণের পর ১২-১৩ জুন ২০১৭ রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম ও বান্দরবান বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসে অন্তত ২০০ মত মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে রাঙ্গামাটিতে মৃত্যুও সংখ্যা অধিক যেখানে সেনাসদস্যও রয়েছে। এই প্রাণহানির সংখ্যা অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ২০০৭ সালে পাহাড়ধসে চট্টগ্রামে প্রায় ১৩০ জনের মৃত্যু ঘটে।

পাহাড়ধস 

পাহাড়ধস বলতে বুঝায় অতিরিক্ত বর্ষণের ফলে পাহাড়ের উপর থেকে মাটি ও পানি মিশে কাদা আকারে বিপুল পরিমাণে অভিকর্ষণ শক্তি দ্বারা ত্বারিত হয়ে নীচে নেসে আসা। অনেকক্ষেত্রে বর্জপ্রাত এতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। যার প্রমাণ আমরা চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া পাহাড়ধসগুলোতে দেখতে পায়।


পাহাড়ধসের কারনঃ 
পাহাড়ধসের অন্যতম কারণ হল পাহাড়ের ঢালের অস্থিশীলতা। এইক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন এর কারণ এরমত দুটি কারন রয়েছে (১) প্রাকৃতিক কারণ (২) মানব সৃষ্ট কারণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক কারণকে ত্বরানীত করছে মানব সৃষ্ট কারণ। চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের মূল কারণ হল মানব সৃষ্ট কারণ। যেমন বসবাস ও যাতায়তের জন্য মানুষ পাহাড় কাটছে, অনেকক্ষেত্রে লম্বালম্বিভাবে পাহাড় কর্তনের প্রভাবে পাহাড় তার মাটিকে ধওে রাখার প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। সেইক্ষেত্রে যখন ভারী বর্ষণ হয় তখন পাহাড়ের উপর থেকে মাটি ও পানি মিশে কাদা আকারে নিচে নেমে আসে ও পাহাড়ধস ঘটছে। পাহাড়ি এলাকায় কৃষি কর্মকান্ডের ফলে পাহাড়ধস ঘটতে পারে। যেমন কৃষি কাজের ফলে পাহাড়ের টপ সয়েল খনন করতে হয়। এইক্ষেত্রে অধিক বর্ষণ হলে পাহাড়ের অনাবৃত অংশের মাটির ক্ষয় ঘটে এবং অনেকক্ষেত্রে পাহাড়ের ঘর্তের সৃষ্টি হয়। এই ঘর্তে বৃষ্টি পানির প্রবেশ ঘটে এবং ভূমিস্থ পানির চাপকে বাড়িয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে প্রাকৃতিকভাবে পাহাড়ের পানি ধারন-ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং দুর্বল ফাটল স্থান দিয়ে প্রচন্ড শক্তি নিয়ে কাদা ও পানিসহ নিচে নেমে এসে পাহাড়ধস ঘটায়। তাছাড়াও যানবাহনের সৃষ্ট কম্পন ও বিস্ফোরনের ফলে পাহাড়ি এলাকায় পাহাড়ধস হতে পারে।
পাহাড়ের পাদদেশে ঝুকিঁ-পূর্ণ বসতি

উপরোক্ত মানব সৃষ্ট কারণ ছাড়াও প্রাকৃতিকভাবে পাহাড়ধস হতে পারে। যেমন নদী বা সমুদ্রের ঢেউয়ের ফলে ভূমিক্ষয়, বৃষ্টিপাত বা বরফগলে, ভূমিকম্পের ফলে, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যৎপাতের ফলে পাহাড়ধস হতে পারে (উৎসঃ উইকিপিডিয়া)। বাংলাদেশ এর ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থা বিবেচনা করলে পাহাড়ধসের প্রধান কারণ হলো মানব সৃষ্ট যেমন; উন্নয়নের নামে অনির্বিচারে পাহাড় কর্তন, আবাসনের জন্য পাহাড় কর্তন, পাহাড়ি এলাকায় অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার করে কৃষি কাজ ও পাহাড়ের বন উজার। তাছাড়াও বাংলাদেশের পাহাড় সমূহের মাটির গঠন ও বুননে বালির পরিমান বেশি থাকা পাহাড়ধসের পক্ষে সহায়ক।

পাহাড়ধসের ক্ষয়-ক্ষতি ও মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য কাজ এখন থেকে কাজ শুরু করতে হবে। প্রথমত আমাদেরকে গবেষণা করে পাহাড়ধসে প্রবণ এলাকার একটি মানচিত্র তৈরী করতে হবে। মানচিত্র তৈরী হলে সেখান থেকে জুনিং ম্যাপ করে অগ্রসর হতে হবে। পরবর্তীতে ঐ সমস্ত ঝুকিঁ-পূর্ণ এলাকায় লোক-জনের বসবাস নিষেধ করতে হবে। এবং বর্ষা মৌসুমে সর্তক বার্তা দিয়ে স্থানীয় জনগণকে নিরাপদ স্থানে পাঠাতে হবে। ঝুকিঁ-পূর্ণ এলাকায় পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। উন্নয়নের নামে পাহাড় কর্তন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। পাহাড়ি এলাকায় যোগাযোগের জন্য টেকষই উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পাহাড়ি এলাকায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার করে কৃষি কাজ প্রচলন করতে হবে। ব্যাপক বনায়ন করতে হবে। পাহাড়ধস এলাকায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স দলের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ধসের সর্তক বার্তা স্থানীয় গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার করতে হবে, তাহলেই পাহাড়ধসের ক্ষয়-ক্ষতি ও মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনগত প্রভাব অতিবৃষ্টির কারণে পাহাড়ধসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটছে এবং এর প্রবণতা ও তীব্রতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনগত ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় ক্লাইমেট নেগোসিয়েশন এর মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ আদায়ে কূটনৈতিক কৌশল প্রয়োগ করতে হবে। বৈশি^ক ভাবে কিয়োটো প্রটোকল ও বালি এ্যাকশন প্লান এর যথাযথ প্রয়োগ করা ও সর্বাধিক কার্বন নিঃসরনকারী দেশ সমূহকে কিয়োটো প্রটোকল এর আওতায় নিয়ে আনা। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অভিযোজন, প্রশমন, গ্রিন প্রযুক্তি ও টেকষই উন্নয়নে গবেষণা ও অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ক্ষয়-ক্ষতি মোকাবেলায় ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের শাখা কার্য্যলয় স্থাপন করতে হবে। স্থানীয় প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। উদ্ধার, ত্রান ও পূর্ণবাসন কর্মকান্ডে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানতে সম্পৃত্ত করতে হবে। তাহলেই জলবায়ু পরিবর্তনগত কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ দ¦ারা সংগঠিত ক্ষয়-ক্ষতি ও জীবন হানি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন