সোমবার, ২১ জুলাই, ২০২৫

একটি অপারেশন ও বিকল আইপিএস থেকে শিক্ষা

 কিছু অভিজ্ঞতা জীবনে এমন শিক্ষা দিয়ে যায়, যা বইয়ে পাওয়া যায় না। সম্প্রতি, আমার জীবনে এমনই দুটি ঘটনা ঘটে গেল যা আমাকে শিখিয়ে দিল কিভাবে বাস্তব সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

কয়েকদিন আগে আমার স্ত্রী হঠাৎ তীব্র ব্যথা অনুভব করে। আমি ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই এবং দ্রুত তাকে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই। চিকিৎসক আল্ট্রাসনোগ্রামসহ বেশ কিছু পরীক্ষা করান। টেষ্ট রিপো্ট দেখে ডাক্তার তড়িঘড়ি করে বলেন, "অপারেশন করতে হবে, দেরি করা যাবে না!" আমি থমকে যাই, এত বড় সিদ্ধান্ত! তখন আমি সময় চেয়ে নিই এবং সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলি। তাদের পরামর্শে আমি আরেকজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। সেই চিকিৎসক পরীক্ষা করে বলেন, “এটা কোনো বড় সমস্যা না, অপারেশন লাগবে না।” তার পরামর্শে প্রয়োজনীয় ওষুধে স্ত্রী এখন ভালো আছেন। ভাবতে গিয়েই গা শিউরে ওঠে, প্রথম চিকিৎসকের কথায় যদি অপারেশন করিয়ে ফেলতাম, কী ভয়ংকর অপূরনীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারত!

আরেকটা ঘটনা ঘটে গেল আজকে। হঠাৎ করে বাসার আইপিএসটি বিকল হয়ে যায়। পরিচিত এক টেকনিশিয়ানকে ডেকে আনলাম। সে দেখে বলল, "এইটা আর ঠিক হবে না, নতুন আইপিএস কিনতে হবে।" আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম, লোডশেডিং এই লাগামহীন সময়ে বাসায় বিদুৎ না থাকলে আমার ছোট ছোট মেয়েরা খুব কষ্ট পাবে, ভাবলাম যেভাবেই হোক টাকা ম্যানেজ করে নতুন আইপিবসে কিনতে হবে, আবার মনে মনে বিকল্প উপায় খুঁজলাম

কিন্তু তখনই মনে পড়ে গেল আমার স্ত্রীর চিকিৎসার ঘটনার কথা। ভাবলাম, আরেকজনের মতামত নেই দেখি। আমি যেখান থেকে আইপিএসটি কিনেছিলাম, সেখানে যাই। তারা বলল, ওয়ারেন্টি শেষ, কিন্তু সাহায্য করবে। একজন দক্ষ টেকনিশিয়ানকে পাঠাল। তিনি এসে ভালোভাবে পরীক্ষা করে ছোট একটা যান্ত্রিক ত্রুটি খুঁজে পান এবং মিনিট দশেকেই আইপিএসটি মেরামত করে দেন। এখন আবার আগের মতো আইপিএসটি কাজ করছে! টেকনিশিয়ান বলল, সমস্যা হলে জানাবেন ভাবতে পারেন নতুন মেশিন কেনা মানে যে বড় অর্থনৈতিক চাপ ছিল, তা আপাতত এড়ানো গেল।

এই দুটি ঘটনার পর আমি একটি মূল্যবান শিক্ষা পেয়েছি: একটি সমস্যার সমাধান খুঁজতে কখনো এককভাবে সিদ্ধান্তে না গিয়ে, সময় নিয়ে আরও কিছু মতামত সংগ্রহ পরিচিতদের কাছ থেকে মতামত সংগ্রহ করা উচিত। একাধিক মত থেকে যাচাই-বাছাই করে আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত এবং অভিজ্ঞতায় বলে সে সিদ্ধান্তের ফলাফল হবে বাস্তবসম্মত, সাশ্রয়ী এবং নিরাপদ সত্যিই, জীবনের অনেক কঠিন মুহূর্তে ঠান্ডা মাথায় ভাবা আর বিকল্প খোঁজার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সঠিক পথের সন্ধান।

AI হোক আপনার চিন্তার সহযোগী কিন্ত আপনার চিন্তার বিকল্প নয়!

 সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে এক গুরুত্বপূর্ণ এবং কিছুটা উদ্বেগজনক তথ্য; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এর অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষের স্মৃতিশক্তি, উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা এবং সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ ক্ষমতা হ্রাস করতে পারে। গবেষকরা চার মাস ধরে ৫৪ জন শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন। দেখা যায়, যারা লেখার ক্ষেত্রে নিয়মিত AI-এর ওপর নির্ভর করছিলেন, তাদের মস্তিষ্কের কার্যক্রম তুলনামূলকভাবে কম সক্রিয়। এতে তাদের স্মৃতিশক্তি ও বিশ্লেষণী চিন্তার দক্ষতা হ্রাস পেয়েছে।

অন্যদিকে, যেসব শিক্ষার্থী প্রাথমিকভাবে AI ছাড়া গতানুগতিক পড়াশোনা শুরু করেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ChatGPT-এর মতো AI ব্যবহার করে ধারণা সংগ্রহ করেছেন, তাদের মস্তিষ্ক আরও বেশি সক্রিয় নিয়মিত AI ব্যবহারকারী তুলনায়। এ থেকে বোঝা যায়, AI তখনই সবচেয়ে কার্যকর যখন এটি চিন্তার বিকল্প না হয়ে চিন্তাকে সমৃদ্ধ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

গবেষকরা আরও সতর্ক করেছেন যে, যখন ব্যবহারকারীরা যাচাই-বাছাই না করে অ্যালগরিদমিক উত্তর গ্রহণ করেন, তখন "ইকো চেম্বার" তৈরি হয়, যা চিন্তাধারার বৈচিত্র্য নষ্ট করে ফেলে। এই গবেষণা একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়, AI হতে পারে এক মূল্যবান সহযোগী, তবে এটি যেন কখনো আমাদের নিজস্ব চিন্তাশক্তির বিকল্প না হয়ে ওঠে। তাই AI ব্যবহারে আমাদের হতে হবে পরোক্ষ অংশগ্রহণকারী, কেবল সক্রিয় ব্যবহারকারী নয়। নিজের বিশ্লেষণ, প্রশ্ন এবং চিন্তার ভিতের উপর দাঁড়িয়ে AI-কে ব্যবহার করলেই তা হয়ে উঠবে আমাদের প্রকৃত বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়ক। আমরা AI কে নিয়ন্ত্রন করব, AI আমাদেরকে নয়!

বুধবার, ২ জুলাই, ২০২৫

ইউএসএআইডি শুধুই একটি দাতা সংস্থা নয়, এটি ছিল বিশ্ব মানবতার এক শক্তিশালী হাত

যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (USAID) ১৯৬১ সাল থেকে বৈশ্বিক উন্নয়ন, দারিদ্র্যতা হ্রাস, গণতন্ত্রের বিকাশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, মানবাধিকার এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছিল। বিশ্বের নানা দেশে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর টেকসই উন্নয়নের পথে ইউএসএআইডি একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে কাজ করছিল। মার্কিন সরকারে রাস্ট্রীয় ঘোষণায় গত ০১ জুলাই ২০২৫ (USAID) আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। গত জানুয়ারী থেকে, ট্রাম্প প্রশাসন মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (USAID) কে পদ্ধতিগতভাবে ভেঙে দিয়েছে, হাজার হাজার চুক্তি বাতিল করেছে, বিদেশে হাজার হাজার কর্মীকে বরখাস্ত করেছে। বাংলাদেশেও ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে পরিচালিত সব উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ হয়েছে (বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম ছাড়া), প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট জনবল চাকুরী হারিয়েছে (বাংলাদেশে এর সংখ্যা প্রায় ৫০,০০০)। ফেব্রুয়ারির শুরুতে, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছেন যে USAID যে লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছিল, সেই লক্ষ্য থেকে ইউএসএআইডি অনেক আগেই সরে গেছে এবং অভিযোগ উঠেছে এর তহবিল মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহার হয়েছে”। যার ফলে এই আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাটি গত ০১ জুলাই বন্ধ হয়ে গেছে।

ইউএসএআইডি বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে টেকসই উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে। এই সংস্থার অর্থায়নে আফ্রিকার গ্রামীণ জনগোষ্ঠী সুপেয় পানি ও পুষ্টিকর খাদ্য, লাতিন আমেরিকায় উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা, দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্যোগ প্রস্তুতি ও জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়ে আসছিল।

বাংলাদেশের উন্নয়নে ইউএসএআইডির অবদান অনস্বীকার্য। স্বাধীনতার পর থেকেই ইউএসএআইডির  আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় এদেশে বহুমুখী উন্নয়ন ঘটেছে। যেমন: স্বাস্থ্য খাতে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা; সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ তৈরি; দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বহুমুখী প্রস্তুতি ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা; নারীর ক্ষমতায়ন ও মানবাধিকার রক্ষায় গ্রামীণ নারীদের প্রশিক্ষণ ও অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি; গণতন্ত্র ও সুশাসন, স্থানীয় সরকার জবাবদিহিকরণ, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ এবং নাগরিক সমাজকে সক্রিয় করা মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত । বিশেষ করে, এনজিও ও সুশীল সমাজের সঙ্গে কাজ করে ইউএসএআইডি গণতান্ত্রিক চর্চা ও উন্নয়নকে বেগবান করেছে।

সংশ্লিষ্ট বিশেজ্ঞরা মনে করছেন, ইউএসএআইডির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বৈশ্বিকভাবে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। মানবিক সহায়তা বা বরাদ্ধ কমে যাবে, দুর্যোগ-প্রবণ অঞ্চলে সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা হ্রাস পাবে, এবং অনেক দেশে গরিব মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে, স্বাস্থ্যখাত, স্থানীয় উন্নয়ন, দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং নাগরিক ক্ষমতায়নে যে সহায়তা আসতো তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সর্বোপরি, ইউএসএআইডি শুধুই একটি দাতা সংস্থা নয়, এটি ছিল বিশ্ব মানবতার এক শক্তিশালী হাত। এই সংকট উত্তরণে প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত পদক্ষেপ, বিকল্প উন্নয়ন অংশীদার খোঁজা এবং স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের উন্নয়নে কিভাবে আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারে, তার উপায় খোঁজা। একইসাথে, বাংলাদেশ সরকার ও এনজিওগুলোর উচিত ইউএসএআইডির বিকল্প উৎস খুঁজে পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা।