শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০২৫

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি কমিয়ে আনতে যুবদের ভূমিকা

পৃথিবীর জনসংখ্যার বড় একটি অংশ যুব শ্রেণির জনগোষ্ঠি, এই সংখ্যা প্রায়ই ১.২ বিলিয়ন। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৪% যুব, এই সংখ্যা প্রায়ই প্রায় ৫ কোটি। বাংলাদেশ বর্তমানে "ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড"-এর পর্যায়ে রয়েছে, এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। আমি মনে করি, টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত উন্নয়ন কার্যক্রমে যুবদের অংশগ্রহণ। তাই, উন্নয়ন চক্রে যুবদের সক্রিয়তা, অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশীদার, বাস্তবায়নের সহযোদ্ধা ও মনিটরিংয়ে যুবদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে  উন্নয়নের বিভিন্ন স্তরে নতুন ধারণা, উদ্ভাবন এবং ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। 

জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমানে বৈশ্বিক একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ এর অন্যতম । জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় যুবরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাদের অংশগ্রহণ, সৃজনশীলতা এবং জলবায়ু সহনশীল প্রযুক্তির ব্যবহার টেকসই পরিবর্তন আনতে যুবরা সহায়ক হতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন কি

আবহাওয়ার সেই চেনাজানা ধরন বদলে যাওয়াকেই বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। যেমন, বাংলাদেশে শীতকাল শুরু হবার কথা নভেম্বরের শেষ থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত, সেখানে ডিসেম্বর মাসেও কোন শীত অনুভূত হয়নি। ষড় ঋতুর বাংলাদেশে এখন বছরের ১০ মাসেই গ্রীষ্মকাল বা গরমকাল অনুভূত হয়। তার মানে বাকি যে চারটি ঋতু রয়েছে, তাদের উপস্থিতি এখন আর বুঝা যায় না। বাংলাদেশে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ও সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে, পৃথিবী গরম হয়ে পড়ছে এবং দ্রুত বদলে যাচ্ছে আবহাওয়ার বহুদিনের চেনাজানা আচরণ।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ

জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী একটি আলোচিত বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তন একটি দীর্ঘমেয়াদী ফল ও অন্যতম কারণ হল প্রাকৃতিকগত কারণ। প্রাকৃতিক কারণসমূহ কন্টিনেন্টাল ড্রিফট’ বা মহাদেশীয় সরণ, আইসোস্ট্যাসিস চলন, অরোজেনিক চলন, আগ্নেয়গিরির অগ্নি-উৎপাত ‘আরথস টিল্ট বা পৃথিবীর হেলে থাকা ২৩.৫০, ও সমুদ্রের স্রোতপ্রবাহ ইত্যাদি। পৃথীবীর বয়স ৪.৫৪ বিলিয়ন, জিওলজিক্যাল টাইম স্কেল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পৃথীবী এখন হলোসিন এপোক পার করছে, যেটি শুরু হয়েছে আজ থেকে ১০,০০০ হাজার বছর আগে। পৃথীবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ২০ টি বরফ যুগ ও বরফগলা যুগ (ইন্টার গ্লেসিয়াল যুগ) অতিক্রম করেছে। জলবায়ুগত পরিবর্তরে কারলে ডাইনুসরের মতে প্রানী পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে আমরা ইন্টার গ্লেসিয়াল যুগ অতিক্রম করছি, যেটি শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২.৭ মিলিয়ন বছর আগে। যখন পৃথীবীতে মানুষ ছিল না, শিল্প-কারখানা ছিল না তখন থেকেই বরফগলা যুগ শুরু হয়েছে।  তাহলে আমরা বলতে পারি জলবায়ু পরিবর্তন একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। তবে, বর্তমান দুনিয়া, বিশ্ব উষ্ণায়ন বা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কেন এ চিন্তিত! সাধামাটা উত্তর, জলবায়ু পরিবর্তন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া হলেও এটিকে ত্বরানিত করছে মানুষ ও মানুষের কর্মকান্ড। মানুষ যখন থেকে কল-কারখানা এবং যানবাহন চালাতে বা শীতে ঘর গরম রাখতে তেল, গ্যাস এবং কয়লা পোড়াতে শুরু করলো (১৮৮০ সাল,  শিল্প বিপ্লবের পর) সেই সময়ের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা এখন ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। বায়ুমণ্ডলে অন্যতম একটি গ্রিন হাউজ গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ উনবিংশ শতকের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে।। গত দুই দশকে বেড়েছে ১২ শতাংশ, বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণেও বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যান্য কারণগুলো হল; সামাজিক কারণ; সমাজের প্রচলিত নিয়ম, নীতি, আইন ও জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। বাস্তুচ্যুতি, খাদ্য নিরাপত্তা, নগরায়ন, পানির ঘাটতি এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা ইত্যাদি। তাছাড়া, রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোও জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে, সেগুলেকে বলা হয় জলবায়ু পরিবর্তনের রাজনৈতিক কারণ। তাই, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হিসেবে প্রাকৃতিক, মানব সৃষ্ট, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণকে ধরা হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

বিশ্বজুড়ে জৈব জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং বন ধ্বংসের ফলে বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড এর মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা বায়ুমন্ডলকে উত্তপ্ত করছে। এর ফলে মেরুর হিমবাহ ও পর্বতের চুড়ার বরফ দ্রুত গলছে যার ফলে দীর্ঘমেয়াদী বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে এবং সমুদ্রতলের উচ্চতা বাড়ছে। বায়ুমন্ডলের বাড়তি উত্তাপের ফলে পৃথিবীর কোন কোন অঞ্চলে অনাবৃষ্টিজনিত শুস্কতার ফলে মরুকরণ দেখা দিয়েছে এবং চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। আবার সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। গ্লোবাল কাইমেট রিস্ক ইনডেক্স-২০১৭ এর মতে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্থ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬ষ্ঠ । জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে একাধারে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা সমস্যা, নদীর তলা ভরাট, বন্যা, খড়া, অতিবৃষ্টি, বর্জ্রপাত, ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত তালিকায় বন্যার জন্য ঝুকিপূর্ণ ১২ টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অবস্থান ১ম। Bangladesh Institute of Water Modeling মতে বাংলাদেশে বন্যাপ্রবণ এলাকার পরিমাণ বেড়েছে, যেমন ২০২৪ সালে সংঘটিত ইস্টার্ন ফ্লাড, বাংলাদেশের প্রায় ১১টি জেলায় বন্যা আক্রান্ত হয় তার মধ্যে, ফেনী, লক্ষীপুর, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অন্যতম। এইসব জলবায়ুগত পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের ফলে ঐ সব এলাকায় বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে ঐ সব এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে এবং জনসাধারণ ঐ সকল এলাকা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবেই সৃষ্টি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত বা স্থানচ্যুত। সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক সংস্থা ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের (আইডিএমসি) মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষের সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় এবং এর সংখ্যা প্রায় ৫৭ লাখ। আর এই স্থানচ্যুত মানুষগুলো জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে আশ্রয় নিচ্ছে নগরে, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের বস্তিগুলোতে। দেশের মোট বস্তিবাসীর অর্ধেকের বেশি বসবাস করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে। আইওএম এর মতে, নগরের বস্তির ৫০ শতাংশই বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠি যারা নদী ভাঙ্গনসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত বস্তি শুমারী-২০১৪ অনুযায়ী বাংলাদেশে বস্তিবাসীর সংখ্যা গত দুই দশকে প্রায় তিনগুন বেড়েছে। বস্তি শুমারী-২০১৪ অনুযায়ী দেশে এখন সাড়ে ২২লাখ মানুষ বস্তিতে বসবাস করে। তবে, নগরবিদরা বলেছেন বাস্তবিকভাবে এই সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। বস্তি শুমারী-২০১৪ অনুযায়ী দেশের বস্তির মোট ১৬ শতাংশ চট্টগ্রাম সিটি এলাকায়, যেখানে ১লক্ষ ২৮ হাজার পরিবারের বসবাস। বস্তিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে তিনটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে তাদের মধ্যে নদী ভাঙ্গনসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ অন্যতম।  বঙ্গোপসাগরের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে ৭১০ কি.মি দীঘ উপকূলভাগ, UNFCCC মতে, বিংশ শতাব্দিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা ১০-২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে, ২০৫০ সাল নাগাত সমুদ্রপ্রষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি হলে ১৭% ভূমি সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। SCAIR মতে. যে হারে এন্টাকটিকার বরফ গলছে, তাতে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপুষ্ঠ উচ্চদা বাড়বে ৫ ফুট। ধারনা করা হচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি সাত জনের একজন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে স্থানচ্যুত হবেন এবং এর সংখ্যা হবে প্রায়ই ২০ মিলিয়ন। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ  ৩ কোটি মানুষ গৃহহীন হতে পারে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির মতে, বাংরাদেশে প্রতিবছর ১-১.৫ কোটি মানুষ বড় বড় শহরের দিকে ধাবিত হচ্চে। এসব উদ্বাস্তুর কারণে বড় বড় শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে চাপ পড়েছে রাজধানী ও বিভাগীয় শহরগুলোতে। ১৯৭২ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৬,৮৮,০০০ সেখানে ২০২৩ সালে হয় ২৩,২১০,০০০ । বিশ্বব্যাংকের মতে ২০২৫ সালে ঢাকার জনসংখ্যা হবে ২.৫ কোটি।

গবেষণায় দেখা যায় এই বাস্তুচ্যুত মানুষেরা নগরের বস্তিতে, বাঁধের পাশে, মহাসড়কের পাশে বা কোন পতিত জমিতে মানবেতরভাবে জীবন যাপন করছে। শহরে এসে তারা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন যেমন, নিরাপদ আবাসন সংকট, শোভন কর্মপরিবেশের অভাব, বিশুদ্ধ পানীয় খাবারের অভাব, পয়ঃনিস্কাশন অভাব, উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার অভাব, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাব, আইনি সহায়তা বা প্রবেশম্যতার সীমাবদ্ধতা, দক্ষতা ও নেতৃত্ব বিকাশ ব্যবস্থার অভাব, বিনোদনের অভাব ও সবধরনের নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। 

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি পুষিয়ে আনতে যুবদের করনীয়:

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও ক্ষতি পুষিয়ে আনতে যুবদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। যুবসমাজ তাদের উদ্যম, সৃজনশীলতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবিলায় বিভিন্নভাবে অবদান রাখতে পারে। যুবরা দুর্যোগ প্রস্ততি, সাড়া, পুনরুদ্ধার এবং অভিযোজন ধাপে কাজ করতে হবে। 

প্রস্তুতি: জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বা দুর্যোগে প্রস্তুতি বলতে বোঝায় সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। এর মধ্যে রয়েছে সচেতনতা বৃদ্ধি, দুর্যোগ মোকাবিলার পরিকল্পনা তৈরি, এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সামর্থ্য গড়ে তোলা। যুবসমাজ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাদের সম্ভাব্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে: সচেতনতা বৃদ্ধি: স্থানীয় মানুষদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে জানানো; বিদ্যালয়, মহল্লা বা কমিউনিটিতে কর্মশালা আয়োজন; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারাভিযান চালানো। প্রাক-দুর্যোগ প্রস্তুতি: নিরাপদ আশ্রয়স্থল চিহ্নিত করা এবং মানুষকে সেখানে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করা; প্রাথমিক চিকিৎসা বা উদ্ধার কার্যক্রমের প্রশিক্ষণ নেওয়া; বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, বা ভূমিধসের মতো পরিস্থিতিতে কীভাবে কাজ করতে হবে, তা শিখে রাখা।  পরিবেশ সুরক্ষা উদ্যোগ: গাছ লাগানো এবং বন সংরক্ষণ; বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ; পুনর্ব্যবহারযোগ্য জিনিস ব্যবহার ও প্রসার করা। যেমন; ইপসা’র যুবরা ইয়ুথ লিড ক্লাইমেট এ্যাকশন প্রকল্পের মাধ্যমে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য সমুদ্রের প্রাচীর/বাঁধে নির্মাণের জন্য জনসচেতনতা তৈরী করছে, মানবন্ধন করছে, সরকারের নিকট ম্মারকলিপি জমা দিচ্ছে। আবার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বীচ ক্যাম্পেইন করছে, যাতে করে পর্যটকদের ব্যবহ্রত বর্জ্য সমুদ্রে তীরে না ফেলে, নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা হয়। যার ফলে, মেরিন প্লাষ্টিক দূষণ কমে আসবে, সমুদ্রের বাস্তসংস্থান রক্ষা পাবে। আবার স্থানীয় জনগোষ্ঠিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও ক্ষতিকারকদিক ও মোকাবেলা সম্পর্কে স্বাক্ষরতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে পারে। স্থানীয় এলাকায় বিপদপূর্ণ স্থানের মানচিত্র তৈরি এবং আপডেট রাখতে সাহায্য করতে পারে। যুবসমাজ সঠিকভাবে অংশগ্রহণ করলে দুর্যোগের ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব এবং একটি নিরাপদ ও সহনশীল সমাজ গঠন করা যাবে।

সাড়া প্রদান: জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দুর্যোগে সাড়া দেওয়া বলতে বুঝায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ঝুঁকি ও বিপদের সময়ে তাৎক্ষণিক ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যুবরো যেসব সাড়াপ্রদান কাজে নিজেদেরকে অর্ন্তভূক্ত করতে পারে যেমন, দুর্যোগকালীন সময়ে, মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া, খাদ্য, পানি এবং চিকিৎসাসেবা প্রদান, এবং পরবর্তী পুনরুদ্ধার কাজে সহায়তা অন্তর্ভুক্ত। এই সাড়া দেওয়ার মূল লক্ষ্য হলো ক্ষয়ক্ষতি কমানো এবং মানুষের জীবন রক্ষা করা। ইপসা’র ইয়ুথ কমিউনিটি স্বোচ্ছাসেবকরা, চট্টগ্রাম শহরের যেকোন দুর্যোগে অংশগ্রহণ করছে।

পুনরুদ্ধার: জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ইভেন্ট বা দুর্যোগে পুনরুদ্ধার বলতে বোঝানো হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর পরিবেশ, জীবনযাত্রা এবং অবকাঠামোর পুনরায় স্থিতিশীলতা অর্জনের প্রক্রিয়া। এটি একটি সামগ্রিক উদ্যোগ, যার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়কে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সহায়তা করা হয়। যুবরা যেসব প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে যেমন; দুযোর্গের ফলে ক্ষয়ক্ষতির মূল্যায়ন: দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ও জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন চিহ্নিত করা; সাহায্য বিতরণ: খাদ্য, পানি, ওষুধ, ও আশ্রয় প্রদান; অবকাঠামো পুনর্গঠন: রাস্তা, ঘরবাড়ি, স্কুল ও হাসপাতালের মেরামত;  মানসিক সহায়তা: দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার।; পরিবেশ পুনর্বাসন: গাছপালা লাগানো, দূষণ পরিষ্কার করা; উদ্ভাবনী সমাধান: টেকসই কৃষি, পানি সংরক্ষণ প্রযুক্তি, ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় কাজ করা। যুবদের উদ্যম ও উদ্ভাবনী চিন্তা দুর্যোগ-পরবর্তী পুনরুদ্ধারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

অভিযোজন: জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ইভেন্ট বা দুর্যোগে অভিযোজন বলতে বুঝায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগের ক্ষতি ও প্রভাব কমিয়ে আনার জন্য গৃহীত পদক্ষেপ ও কর্মকৌশল। এটি মূলত মানুষের জীবন, সম্পদ, পরিবেশ, এবং অর্থনীতিকে টেকসই রাখার ও পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে পরিকল্পিত প্রস্তুতি এবং প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম গ্রহণের প্রক্রিয়া। যুবরা দুর্যোগে অভিযোজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অভিযোজনে যুবরা যেসব কাজ বা উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে; সচেতনতা বৃদ্ধি: জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাব সম্পর্কে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করা; সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা চালানো। স্থানীয় সমস্যা চিহ্নিতকরণ: নিজের কমিউনিটির দুর্বলতা এবং ঝুঁকি চিহ্নিত করা; স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সবুজায়ন এবং পরিবেশ সুরক্ষা: বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পরিচালনা; টেকসই কৃষি পদ্ধতি প্রচলন; জলবায়ু সহনশীল কৃষিজাতের প্রসার; পানি সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ। উন্নত টেকসই প্রযুক্তির ব্যবহার: সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহারে চর্চা ও উদ্ধুদ্ধ করা; আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং সতর্কতা সিস্টেম সম্পর্কে ধারণা প্রদান; ডেটা সংগ্রহ এবং শেয়ার করার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করা। উদ্যোক্তা কার্যক্রম: স্থানীয়ভাবে অভিযোজনযোগ্য পণ্য ও পরিষেবা তৈরি করা; নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার উৎসাহিত করা। সার্কুলার ইকোনমি বা বৃত্তাকার অর্থনীতি: সার্কুলারিটি গ্যাপ রিপোর্ট-২০২১ এ দাবি করা হয় সার্কুলার ইকোনমি’র মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ৩৯ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা সম্ভব; প্লাস্টিক বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদান খরচ ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব; 3R (হ্রাস, পুনর্ব্যবহার ও পুনঃচক্রায়ন) 7R পর্যন্ত প্রসারিত করে যেমন; নতুন করে ডিজাইন (redesign); কমাতে (reduce); মেরামত (repair); পুনর্নবীকরণ (renewal); পুনরুদ্ধার (recover); পুনঃচক্রায়ন (recycle)। যুবরা তাদের উদ্যম, শক্তি, এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করার মাধ্যমে দুর্যোগে অভিযোজনে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।

টেকসই উন্নয়ন: উন্নয়নের ধারণাটি ১৯৮৭ সালে ব্রান্টল্যান্ড কমিশনের রিপোর্টে প্রথম স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা হয়। টেকসই উন্নয়ন বলতে এমন উন্নয়নকে বোঝায় যা বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা পূরণ করে, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজন মেটানোর ক্ষমতা ব্যাহত করে না। এটি একটি উন্নয়ন প্রক্রিয়া যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, এবং পরিবেশ সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। টেকসই যুবরা টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে কার্যক্রর ভূমিকা রাখতে পারে, যেমন কমিউনিটিতে যেসব উন্নয়ন কর্মকান্ড গ্রহণ করা হয়, সেগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, এবং পরিবেশ সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য আছে কিনা সে বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও অধিপরামর্শ করা।  গ্রামের মানুষ একসময় অন্ধকারে থেকেছে বা কেরোসিন ল্যাম্পের উপর নির্ভর করতো। এই সমস্যার সমাধানে নবায়নযোগ্য শক্তির ওপর ভিত্তি করে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (IDCOL) এবং বিভিন্ন অংশীদাররা মিলে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। যেকোন উন্নয়ন কার্যক্রমে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করে, তারপর উন্নয়ন কাজ শুরু করতে হবে, সেখানে যুবরা অংশ নিতে পারে। যুব সমাজের উদ্যোগ ও সক্রিয় অংশগ্রহণ টেকসইতা নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ: যুবসমাজ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। তারা স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জলবায়ু নীতিমালা এবং জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে তাদের মতামত জানাতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকট। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, তাপপ্রবাহ, খরা এবং ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশ্বব্যাপী মানুষকে প্রভাবিত করছে। এই প্রভাবগুলো মোকাবিলা করতে এবং একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে যুবসমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবিলায় যুবসমাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তাদের উদ্ভাবনী চিন্তা, শক্তি এবং নেতৃত্বের গুণাবলী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে এবং একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সহায়তা করতে পারে। সঠিক দিকনির্দেশনা ও সহায়তা পেলে যুবসমাজ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারবে। এজন্য সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা, উন্নয়ন সংস্থা এবং সমাজের প্রত্যেকের উচিত যুবদের সমর্থন ও সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা।

শনিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০২৫

নিরাপদ ফুটপাত চাই , হাঁটতে চাই, হাঁটা নগরবাসীর অধিকার

শরীরচর্চার সবচেয়ে সহজ উপায়টি হলো হাঁটাহাঁটি করা। আমরা সবাই কমবেশি হাঁটি। কারণে-অকারণে হাঁটি। কিছু মানুষ আছেন, যারা নিয়ম করে প্রতিদিনই হাঁটেন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাঁটার অনেক উপকারিতা আছে। এর ফলে পেশী সুগঠিত হয়, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুরক্ষিত থাকে ও মেরামত হয়, হজমে সাহায্য করে এবং মস্তিষ্ককেও সতেজ রেখে বার্ধক্য প্রতিরোধ করে। হাঁটার ফলে মানুষের চিন্তার সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়, মেজাজ বা মুড ভালো থাকে, মানসিক চাপ কমে। দ্রুত নগরায়ণ ও যান্ত্রিক নির্ভরতার কারণে হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস কমে গেছে বা নগরের হাঁটাহাঁটি করা সহায়ক পরিবেশ নেই। নগরের হাঁটাহাঁটি করার পরিবেশ ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে।

হাজার বছরের ইতিহাস আর ঐতিহ্য বুকে নিয়ে জেগে আছে চট্টগ্রাম। পাহাড়, নদী আর সাগরের সম্মিলনে এই নগরী বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য মানুষের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। নগরে বিপুলসংখ্যক মানুষের বাস। কিন্তু নগরবাসীর নিরাপদে হাঁটার ব্যবস্থা নগরীতে তেমন নেই, যা ছিল তাও ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে। গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরে সড়কের তুলনায় ৭গুণ বেশি যানবাহন চলাচল করে। যে কারণে শহরে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। দিনে দিনে বাড়ছে ট্রাফিক জ্যাম। নগরবাসী ট্রাফিক জ্যামের ভয়ে অল্প দূরত্বে গন্তব্য হলে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে শ্রমজীবী, পোশাককর্মী সব সময় হেঁটে তাঁদের কর্মস্থলে যান। চসিকের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরে সড়ক আছে ১ হাজার ৪৪২ কিলোমিটার। বিপরীতে ফুটপাত আছে মাত্র ২৮১ কিলোমিটার; যা মোট সড়কের মাত্র ১৯ শতাংশ। এর মধ্যে অধিকাংশ অবৈধ দখলে। কেউ রাজনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে ফুটপাতের ওপর দোকান তৈরি করে ভাড়া দিচ্ছেন। কেউ কেউ ভ্রাম্যমাণ জুতার দোকান, ডাবের দোকান, শরবতের দোকান, চুড়ির দোকান, বইয়ের দোকান দিয়ে ফুটপাত চলাচলের অনুপযোগী করে ফেলেছেন। এমন অবস্থায় জনগন রাস্তা দিয়ে চলাচলের সময় মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।

ব্লমবার্গ ফিলানথ্রপিস ইনিশিয়েটিভ ফর গ্লোবাল রোড সেফটি (বিআইজিআরএস) এর মতে, ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫৬৯ জন। এর মধ্যে পথচারীর সংখ্যা ৩১৩, অর্থাৎ ৫৫ শতাংশ। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে সড়কে পথচারী মৃত্যুর হার বেড়েছে ৬০ শতাংশ। চট্টগ্রামে এই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হবার অন্যতম কারণ হল শহরে পথচারীরা নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত ফুটপাত নেই; যা আছে তার মধ্যে কিছু অবৈধ দখলে, কিছু ভাঙাচোরা। তাছাড়া যেখানে দখলমুক্ত ফুটপাত আছে, সেখানেও অসমতল ও ধারাবাহিকতা নেই। বাধ্য হয়ে সড়ক দিয়ে যাতায়াত করেন পথচারীরা, যার ফলে সহজেই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। গবেষকরা বলছেন, চট্টগ্রাম নগরের ২০টি মোড় ও ১০টি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে সিটি গেট, আউটার রিংরোডের খেজুরতলা, বারিক বিল্ডিং মোড়, সিঅ্যান্ডবি ও কালামিয়া বাজার মোড় সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। ৩ বছরে এ মোড়গুলোতে ২৯ জন নিহত হয়েছেন। রুটগুলোর মধ্যে সব চেয়ে বিপজ্জনক বহদ্দারহাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত সড়ক। এই পাঁচ কিলোমিটার সড়কে ২৪ জন নিহত হয়েছেন। তাছাড়াও এই নগরে ভারী যানবাহন চাপায় পথচারী নিহত হবার ঘটনাও ঘটছে। বন্দর নগরী হবার কারণে, এই শহরে পণ্যবাহী ভারী যানবাহন চলাচল করে। অনেকক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রীত গাড়ি চলাচলের কারণে দুর্ঘটনায় পথচারীরা গাড়ির চাপা পড়ে মারা যান। ড্রেনে পড়ে পথচারী ও কলেজ ছাত্রীর মৃত্যুরমত ঘটনাও এই শহরে ঘটেছে। নগরের রাস্তায় হাঁটার মতো পরিবেশে যে ধরনের অবকাঠামো দরকার, তা এই শহরে অনুপস্থিত।  

যানজট যেন চট্টগ্রাম শহরের নিত্তমৈত্রিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে । অক্সিজেন মোড় থেকে পতেঙ্গা কাঠগড় বাজার এবং কর্নেলহাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত পুরো নগরীতেই সড়কে চলছে চরম বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য। নিউমার্কেট মোড়, জুবিলী রোড, রিয়াজউদ্দিন বাজার, জহুর হকার্স মার্কেট, তামাকমুণ্ডি লেন, শাহ আমানত সিটি করপোরেশন মার্কেট, গোলাম রসুল মার্কেট, চকবাজার, ষোলশহর, অক্সিজেনসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক এলাকার অবস্থা আরো ভয়াবহ। এসব এলাকায় ফুটপাত হকারদের দখলে থাকায় যানবাহন থেকে যাত্রী ও মালামাল ওঠানামা হয়ে থাকে সড়কে। আবার অনেক সড়কে যানবাহন রাখা হয় এলোপাতাড়িভাবে। এর পাশাপাশি শহর জুড়ে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলমান থাকায় সড়ক সংকীর্ণ হয়ে গেছে। নগরীতে পর্যাপ্তসংখ্যক বৈধ বাস ও ট্রাক টার্মিনালের অভাবে শহরের তিনটি প্রবেশমুখে গড়ে উঠেছে অবৈধ টার্মিনাল। সেসব স্থানে যত্রতত্র বাস, অটোরিকশা ও প্রাইভেট কার পার্কিং করে রাখা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর ও ইপিজেডমুখী সবগুলো সড়কেই রয়েছে অসহনীয় যানজট। নগরীতে পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা ছাড়াই একের পর এক গড়ে উঠছে নতুন নতুন মার্কেট ও হাসপাতাল। মার্কেটে আসা ক্রেতা-বিক্রেতারা রাস্তার ওপর গাড়ি রাখেন। মার্কেটের দোকানপাটের মালামাল রাস্তায় ওঠানামা করানো হচ্ছে। এছাড়া নিউমার্কেট এলাকার আশপাশে পুরো এলাকা জুড়েই ফুটপাত ও রাস্তার প্রায় অর্ধেক অংশ হকারদের দখলে। ফুটপাত বেদখল থাকায় মানুষ রাস্তা দিয়ে হাঁটে। এতে যানজট আরো তীব্র হচ্ছে। নগরীর বায়েজীদ থেকে ষোলশহর হয়ে চকবাজার পর্যন্ত সড়কটিতেও সব সময় যানজট থাকে। এসব এলাকায় বেশ কয়েকটি শিল্পকারখানার পাশাপাশি অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক এলাকা রয়েছে। যানজটের কারণে এসব এলাকার বাসিন্দাদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়।

এদিকে, নগরীতে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় চলমান কাজের বিভিন্ন সরঞ্জাম ও খাল থেকে তোলা মাটি রাস্তার উপরেই স্তূপ করে রাখার কারণে রাস্তা সরু হয়ে পড়ায় যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। তার মধ্যে একটি হলো বন্দর ব্যবহারকারী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান পার্কিংয়ের জন্য কোনো টার্মিনাল নেই। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পণ্যবাহী যানবাহনগুলো বাধ্য হয়ে সড়কের এক পাশে পার্কিং করে রাখতে হচ্ছে। চট্টগ্রামের আবাসিক এলাকাগুলোতে নেই কোন ফুটপাথ, অনেক বাসিন্দা/বাড়িওয়ালা তার বাড়ির সামনে ফুটপাথ দখল করে নিয়েছে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে বাগান করে বা গাছ লাগিয়ে। যার ফলে, আবাসিক এলাকাগুলোতেও পথচারীরর নিরাপদের হাঁটার ব্যবস্থা নেই, সেখানেও পথচারীরা প্রতি নিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।

নগরীতে পথচারীদের নিরাপদে হাঁটা ও চলাচলের উপযুক্ত স্থান ফুটপাত। প্রশস্ত ফুটপাতের কারণে যানজট বা দুর্ঘটনাও কমে অনেক। পাশাপাশি রাস্তা বা সড়কের সৌন্দর্যও বাড়ায় ফুটপাত। বাড়তি সুবিধা, নিয়মিত হাঁটার কারণে নগরবাসীর বিভিন্ন শারীরিক ও মানষিক উন্নতি। নগরের ফুটাপাতগুলো নিরাপদ ও চলাচল উপযোগীর জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে;

  • নগর পরিকল্পনায় পথচারীর স্বার্থ বিবেচনা করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে;
  • পথচারী নিরাপত্তা প্রবিধানমালা ২০২১ দ্রুত প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন;
  • পথচারীদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করে ফুটপাত নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ; 
  • সহজে ও নিরাপদে জেব্রা ক্রসিংয়ের মাধ্যমে রাস্তা পারাপারের সুযোগ সৃষ্টি;
  • রাতে পথচারীদের (বিশেষ করে নারী ও বয়স্কদের) চলাচল নিরাপদ করার লক্ষ্যে ফুটপাথ ও সড়কে আলোর ব্যবস্থা করা;
  • ফুটপাতে ছাউনি, বসার ব্যবস্থা, খাওয়ার পানি, মোবাইল চার্জ ব্যবস্থা ও গণশৌচাগার নিশ্চিতকরণ;
  • সাইন সিগন্যাল স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাহিদাকে গুরুত্ব প্রদান;
  • হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীর জন্য ফুটপাতে ঢালু পথ (র‍্যাম্প) তৈরি;
  • দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যবহার উপযোগী করে ফুটপাতে টেকটাইলস স্থাপন;
  • অবকাঠামো দিয়ে পথচারীর নিরবচ্ছিন্ন চলাচলে বাধা তৈরি না করা;
  • বিল্ডিং তৈরীর সরঞ্জমাদি বা কাঠামোগত উন্নয়নের সরঞ্জমাদি   ফুটপাতে না রাখা হয়, তার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ানো;
  • ফুটপাত ও সড়কে অবৈধ পার্কিং বন্ধ করা;
  • আবাসিক এলাকাগুলোতে ফুটপাথ নির্মাণ ও দখলমুক্ত করা;
  • ফুটপাতে হকারদের ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসা। সকালে উচ্ছেদের পর সন্ধ্যায় যেন আবার দখল না পড়ে সে জন্যও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। হকারদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে;
  • যেখানে পথচারী চলাচলের ঘনত্ব বেশি, সেখানে কেবল পথচারীদের জন্য সড়কব্যবস্থা চালু করা;
  • গণ-পরিবহনের সেবার মান উন্নয়ন করে, ব্যক্তিক গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে আনা;
  • নগরের বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানের সাথে কানেকটেড ফুটপাথগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া এব সেখানকার প্রতিবন্ধকতাসমূহ দুর করা;
  • হাঁটা আমার অধিকার, নগরবাসীকে এই বিষয় নিয়ে সামাজিক উদ্ধেগ গ্রহণে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাসমূহ কার্যক্রর ভূমিকা রাখা;
  • নিরাপদ ফুটপাথ এর জন্য যুবরা বিভিন্ন উদ্ধেগ গ্রহণে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয়ে কাজ করা;
  • অনিরাপদ ফুটপাথের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ পথচারীর উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান।

উৎসঃ
  1. https://www.prothomalo.com/bangladesh/capital/7jwmioh7qu
  2. https://www.tbsnews.net/bangla/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6/news-details-167698
  3. https://www.bhorerkagoj.com/accident/760075
  4. https://www.ittefaq.com.bd/118740/
  5. https://www.bhorerkagoj.com/tp-editorial/764128
  6. https://www.bhorerkagoj.com/tp-editorial/749948