জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ ছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে, ভূমিকম্পের ঝুঁকির দিক থেকে বাংলাদেশ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশ ইউরেশিয়ান এবং ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেটের মধ্যে অবস্থিত। তাছাড়া বাংলাদেশে কিছু সক্রিয় সিসমিক ফল্ট রয়েছে যেমন সীতাকুণ্ড-টেকনাফ ফল্ট, রাঙ্গামাটি-বরকল ফল্ট, মধুপুর ফল্ট, সিলেট- আসাম ফল্ট ইত্যাদি। অতীতে এইসব ফল্ট বরাবর বহু ভূমিকম্প হয়েছে। সে জন্য ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা এই সব অঞ্চলকে ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে সতর্ক করেছেন। ১৮৯৭ সালে এই অঞ্চলে ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল যা, গ্রেট ইন্ডিয়া ভূমিকম্প নামে পরিচিত। এই ভূমিকম্পে সিলেট শহরের মারাত্মক ক্ষতি হয়, যেখানে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৪৫ এবং ধসে পড়ে বহু ভবন। সম্প্রতী তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমান্তে আঘাত হানা ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে জনে মনে আতংক দেখা দিয়েছে ভূমিকম্প নিয়ে। তুরস্কের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭.৮। সেই ক্ষেত্রে তুরস্কের ভূমিকম্পকে আমাদের দেশে সংঘটিত ভূমিকম্পের তুলনায় ছোটই বলা চলে। ভূমিকম্পের রিটার্ন পিরিয়ড ধরা হয় ১৫০-২০০ বছর। সে হিসেবে সাইকেলটি এখনো ফিরে আসেনি। সেটি কখন হবে কেউ জানে না। আসলে ভূমিকম্পের পূর্বানুমান করা সম্ভব না। পরিসংখ্যানগত রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে যে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ফ্রিকোয়েন্সি বেড়েছে। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে ঘন ঘন হালকা কম্পন একটি সংকেত দেয় যে একটি শক্তিশালী কম্পন আসছে, যা সবার জন্য উদ্বেগের বিষয়। তার জন্য আমাদের আতংকিত না হয়ে প্রস্ততি নিতে হবে, ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকি বিষয়গুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা্ নিতে হবে। আমরা যদি পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারি তাহলে এসব দুর্যোগ মোকাবিলা করে টিকে থাকা ও ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা আমাদের জন্য অনেক সহজ হবে। তাই জাতীয় দুর্যোগ প্রস্ততি দিবসে এই হউক আমাদের প্রত্যয়, ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের এখনি প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। সেই প্রেক্ষাপটে এবারের জাতীয় দুর্যোগ প্রস্ততি দিবস ২০২৩ এর প্রতিপাদ্য বিষয় “স্মার্ট বাংলাদেশের প্রত্যয় দুর্যোগ প্রস্ততি সবসময়”।
বিল্ডিং হল ভূমিকম্পের সময় বিপর্যয় সৃষ্টি করে অন্যতম প্রধান উপাদান । নগরায়নের ফলে শহরের জনসংখ্যা দিনদিন বেড়ে চলছে। এই ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠির চাগিদা মিটাতে শহরগুলোতে গড়ে ওঠছে অপরিকল্পিত আবাসন, মানা হচ্ছে না বিল্ডিং কোড। যার ফলে এই ভবনগুলো ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাড়িয়েছে। সম্প্রতী ঘটে যাওয়া তুরস্কের ভূমিকম্পে প্রায় ১ লক্ষ ভবন ধসে পরে, তার কারণ হিসেবে দেখা যায় ঐ শহরের বিদ্যমান পুরাতন বিল্ডিংগুলির খুব কম রেট্রোফিটিং (মজবুতিকরণ) হয়েছে এবং নতুন বিল্ডগুলিতে বিল্ডিং স্ট্যান্ডার্ডগুলির খুব কম প্রয়োগ করা হয়েছে বলে মতামত দিয়েছেন অক্সফোডের গবেষক প্রফেসর এলেক্সজেন্ডার। চুয়েটের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বন্দর নগরী চট্টগ্রামের ৭৮ শতাংশ ভবন বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) লঙ্ঘন করে নির্মিত হয়েছে। এবং ধারনা করা হচ্ছে চট্টগ্রাম শহরের প্রায় ৭০শতাংশ উচ্চ ভবন ধসে পড়বে যদি রিখটার স্কেলে ৭-৮ মাত্রার ভূমিকম্প চট্টগ্রাম শহরে আঘাত হানে। সেই তুলনায় রাজধানীর ঢাকায় আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমাদের দেশের পুরনো ২-৩ বা ৫ তলার যেসব ভবন আছে, যেগুলো ভূমিকম্প সহনীয় নয়, সেক্ষেত্রে এখনই সে ভবনগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল ভূমিকম্প অপ্রত্যাশিত, অনিয়ন্ত্রিত এবং ভূমিকম্প মোকাবেলায় আমাদের দেশের জনগণের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিল্ডিং কোড না মেনে চলা এবং বাসিন্দাদের ভূমিকম্পে সাড়াঁ দেবার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, শহর এলাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়াও, আমাদের শহরগুলোর রাস্তা তুরস্ক ও সিরিয়ার রাস্তার মতো এত চওড়া না, খুবই সরু। আমাদের পুরাতন ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে যদি ভূমিকম্প হয়, দেখা যাবে সেখানে উদ্ধারকর্ম পরিচালনা করার জন্য কোনো গাড়িই বা যন্ত্রপাতি ঢুকতে পারবে না। ফলে উদ্ধার অভিযান বিলম্বিত হবে, ভূমিকম্পে তাৎক্ষণিকভাবে যে পরিমাণ প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হবে তার চেয়ে বেশি প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে, উদ্ধার অভিযানের দীর্ঘতা ও সরঞ্জমাদির অভাবে। তাই আমাদের এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।
ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় আমাদেরকে প্রথমে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলির ম্যাপিং করতে হবে। সেক্ষেত্রে জিআইএস প্রযুক্তির ব্যবহার করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলির অবস্থান নির্ণয় করতে হবে। চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ বিল্ডিংগুলিকে রেট্রোফিটিং (মজবুতিকরণ) নিশ্চিতকরণ করতে হবে এবং নতুন বিল্ডগুলিতে বিল্ডিং স্ট্যান্ডার্ড বা বিল্ডিং কোড সঠিকভাবে মানা হচ্ছে কি না সেটা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন তৈরি করতে হবে। এইক্ষেত্রে জাপানের ভূমিকম্প প্রমাণ পরিকল্পনা পদ্ধতি অনুসরন করা যেতে পারে। কর্তৃপক্ষকে মাঝে মধ্যে মোবাইল কোট চলমান করে দেখতে হবে, বিল্ডিংগুলো অনুমোদিত প্লানে যেমন ছিল বাস্তবে সেরকম আছে কিনা। ফায়ার সার্ভিসের ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতা বাড়াতে হবে, প্রয়োজনীয় ও আধুনিক সরঞ্জাম কিনে দিতে হবে। স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারের ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং ওয়ার্ড অফিসে কিছু সরঞ্জাম রেখে দিতে হবে।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) মত আমাদের মহল্লায় মহল্লায়ও এরকম ভূমিকম্প প্রস্তুতি কর্মসূচি চালু করতে হবে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে ক্যাম্পেইন আয়োজন করতে হবে। ভূমিকম্প নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা করতে হবে এবং গবেষণার ফলাফল অভিষ্ট জনগোষ্ঠিকে জানাতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভূমিকম্প বিষয়ে জ্ঞানের চর্চা ও বিদ্যমান সম্পদ ব্যবহারে সমন্বয় করতে হবে। ভূমিকম্প নিয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সমূহ কর্মসূচি তৈরী ও বাস্তবায়ন করতে হবে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় ফান্ডিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো সরকারের সাথে সমন্বয় করে ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন মহড়া (মকড্রিল) আয়োজন করতে হবে। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের এই মহড়া (মকড্রিল) অংশ নিতে হবে। স্থানীয় কমিউনিটিকে ভূমিকম্পে সাড়াদানে ক্ষমতায়িত করতে হবে, কিছু সরঞ্জাম তাদের কাছে রেখে দিতে হবে এবং নিয়মিতভাবে তা ব্যবহারের চর্চা করতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরকে এই সমস্ত বিষয়গুলোকে সমন্বয় করতে হবে। প্রয়োজনে ভূমিকম্প নিয়েই সরকারের আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান দাড় করাতে হবে, যে প্রতিষ্ঠান শুধু ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলার কাজ করবে। সবার সামগ্রিক প্রচেষ্টায় পূর্ব প্রস্ততির মাধ্যমে ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলায় টিকে থাকা ও ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সহজ হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন